বাইডেন এগিয়ে ট্রাম্প যাবেন আদালতে

যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এগিয়ে ডেমোক্রেট প্রার্থী জো বাইডেন। তার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প যাবেন আদালতে। ফলে নির্বাচনের চূড়ান্ত ফয়সালা কি আদালতেই হচ্ছে? কিন্তু কেন? যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এ প্রশ্ন এখন সবার মাঝে। মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত নির্বাচনে গত রাতে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত নিশ্চিত বিজয়ী হননি কোনো প্রার্থীই। সর্বশেষ পরিস্থিতিতে জো বাইডেনের বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনা বেড়েছে। এমন অবস্থায় মিলিয়ন মিলিয়ন ভোট গণনা বাকি থাকতেই নিজেকে বিজয়ী দাবি করে নির্বাচন বন্ধে সুপ্রিম কোর্টে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন ট্রাম্প। ফলে ‘যুক্তরাষ্ট্রে সাংবিধানিক সঙ্কট সৃষ্টি করতে পারেন ট্রাম্প’-এমন প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন জার্মানির প্রতিরক্ষামন্ত্রী অ্যানেগ্রেট ক্রাম্প-কারেনবাউয়ার।

ট্রাম্পের আগাম বিজয় ঘোষণায় ব্যাপক সমালোচনা উঠেছে মিডিয়ায়, রাজনৈতিক মহলে।
মিডিয়ায় তার এমন ঘোষণাকে ‘ভিত্তিহীন’ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। রাশিয়ান টিভিতে এই নির্বাচনকে ‘উন্মাদনা’ বলে আখ্যা দেয়া হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের এই নির্বাচনের ফলে কি সেখানে রাজনৈতিক সংস্কৃতিরও পরিবর্তন ঘটছে- এমনও আলোচনাও চলছে সর্বত্র। এদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন শহরে, রাজ্যে শুরু হয়েছে ট্রাম্পবিরোধী বিক্ষোভ। তাতে ধস্তাধস্তি হয়েছে। আগেভাগেই ব্যবসায়ী নেতারা সতর্কতা জারি করেছেন। দোকানপাট, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে অতিরিক্ত সতর্কতা অবলম্বন করা হয়েছে। সব মিলে এক অস্থির পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে গোটা আমেরিকায়। বেড়েছে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা। যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নিয়ে এমন উদ্বেগ এর আগে কখনও দেখা যায়নি। আছে সহিংসতার আতঙ্কও। যুক্তরাষ্ট্রের এমন অবস্থাকে বিস্ফোরণমূলক বলে আখ্যায়িত করেছেন জার্মান প্রতিরক্ষামন্ত্রী। তিনি বলেছেন, ট্রাম্প সাংবিধানিক সংকট সৃষ্টি করতে পারেন। রুশ গণমাধ্যম এ নির্বাচনকে ‘পাগলামি’ বলে আখ্যায়িত করেছে।
মঙ্গলবারের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নিয়ে বিক্ষোভ হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন শহরে ও রাজ্যে। গ্রেপ্তার করা হয়েছে কয়েকজনকে। কিন্তু চূড়ান্ত ফল নিশ্চিত হয়নি। যুক্তরাষ্ট্রে স্মরণকালে এমনটা হয়নি। নানা জটিলতায় এবার নির্বাচনের ফল বিলম্বিত হচ্ছে। ফলে রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষা উভয় শিবিরে। বিশ্ব তাকিয়ে আমেরিকার দিকে। এরই মধ্যে বিশ্বের বৃহত্তর গণতন্ত্রের এ দেশে নির্বাচনের ফল নিয়ে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সুপ্রিম কোর্টে যাওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। যদি সত্যি তাই হয়, তাহলে এবারের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফল আদালত থেকে নির্ধারিত হতে পারে! কিন্তু কেন? এমন জিজ্ঞাসা সারাবিশ্বে। ওয়াশিংটন পোস্টের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সংকটে সংকটে যে দেশটি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে নাড়া খেয়েছে, সেই যুক্তরাষ্ট্র বুধবার সকালেই আইনগত শোডাউনের দিকে ধাবিত হতে যাচ্ছে। ডেমোক্রেট দলের প্রার্থী জো বাইডেনের জয়ের পথ খোলা থাকা সত্ত্বেও ‘অপরিপক্ব’ভাবে নিজের বিজয় ঘোষণা করেছেন ট্রাম্প।
৬টি রাজ্যে ভোট গণনা বাকি থাকতেই বিজয় ঘোষণা করেছেন তিনি। সঙ্গে সঙ্গে তার এ ঘোষণাকে ‘ফলসলি’ বলে মন্তব্য করেছে আন্তর্জাতিক মিডিয়া। তাতে ৬টি রাজ্যে ভোট গণনা বাকি থাকতে তার বিজয় ঘোষণাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন নিজে। বিবিসি’র প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্র ধারালো ছুরির প্রান্তসীমায় অবস্থান করছে। ট্রাম্পের ওই ঘোষণাকে বিরোধী ডেমোক্রেটরা ‘গর্হিত, নজিরবিহীন এবং ত্রুটিপূর্ণ’ বলে অভিহিত করেছে। এই ৬টি রাজ্যের ভোটের ওপর নির্ভর করছে হোয়াইট হাউসের চাবি কার হাতে যাবে। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে সেখানে গণতান্ত্রিক যে প্রক্রিয়া অবলম্বন করা হয় তেমনটা বিশ্বের খুব কম দেশেই হয়।

এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত জো বাইডেন ইলেক্টোরাল কলেজ ভোটে ২৩৮টিতে জয় পেয়েছেন। ডনাল্ড ট্রাম্প পেয়েছেন ২১৩টি ভোট। বিজয়ী হতে হলে একজন প্রার্থীকে কমপক্ষে ২৭০টি ইলেক্টোরাল কলেজ ভোট পেতে হয়। সেই হিসাবে বাইডেনকে পেতে হবে আরো ৩২টি ভোট। ট্রাম্পকে পেতে হবে ৫৭ ভোট।
এই অবস্থায় ফল ঘোষণার বাকি আছে ৬টি রাজ্যে। এগুলো হলো উইসকনসিন, মিশিগান, পেনসিলভ্যানিয়া, মেইনে, নর্থ ক্যারোলাইনা ও জর্জিয়া। এসব রাজ্যে ভোট বন্ধের জন্য সুপ্রিম কোর্টে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন ট্রাম্প। লাখ লাখ ভোট গণনা বাকি থাকতেই তিনি বিজয় ঘোষণা করেছেন। ‘ফলস্‌লি’ তিনি এমন ঘোষণা দিয়েছেন বলে সংবাদ শিরোনাম করেছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স। এখন ফল আদালতেই নাকি ভোটের ওপর ভিত্তি করে নির্ধারিত হবে তাও অনিশ্চিত।

উইসকনসিনে জো বাইডেন এগিয়ে আছেন সামান্য ভোটের ব্যবধানে। সেখানে বাইডেন পেয়েছেন শতকরা ৪৯.৪ ভাগ ভোট। ট্রাম্প পেয়েছেন শতকরা ৪৯.১ ভাগ ভোট। এ রাজ্যে মোট ইলেক্টোরাল কলেজ ভোট ১০টি। নর্থ ক্যারোলাইনায় জো বাইডেন ভোট পেয়েছেন শতকরা ৪৮.৭ ভাগ। ট্রাম্প পেয়েছেন ৫০.১ ভাগ। এখানে আছে ১৫টি ইলেক্টোরাল কলেজ ভোট। জর্জিয়াতে বাইডেন পেয়েছেন ৪৮.৩ ভাগ ভোট। ট্রাম্প পেয়েছেন ৫০.৫ ভাগ। এখানে ইলেক্টোরাল কলেজ ভোট আছে ১৬টি। তবে মেইনে বিজয়ী হয়েছেন বাইডেন। সেখানে আছে ৪টি কলেজিয়েট ভোট। গুরুত্বপূর্ণ মিশিগানে চমক সৃষ্টি করতে যাচ্ছেন বাইডেন। প্রথমদিকে তিনি এ রাজ্যে পিছিয়ে থাকলেও পরে এগিয়ে গেছেন। তিনি পেয়েছেন শতকরা ৪৯.৪ ভাগ ভোট। ট্রাম্প পেয়েছেন ৪৯.১ ভাগ। ধারণা করা হচ্ছে এই ব্যবধান আরো বাড়বে। কারণ, মেইলে দেয়া ভোট বিলম্বে গণনা শুরু হয়েছে এবং এসব ভোটের বেশির ভাগই ডেমোক্রেটদের। ফলে শুধু মিশিগান নয়, অন্য রাজ্যগুলোতেও বাজিমাত করতে পারেন জো বাইডেন। সব মিলে বাইডেনের ঘরে জমা পড়েছে ২৩৮ ভোট। এ রাজ্যগুলোতে চলছে মেইলে দেয়া এবং আগাম ভোট গণনা। নির্বাচনের কয়েকদিন আগেই বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম খবর দিচ্ছিল, যারা আগাম ভোট বা মেইলে ভোট দিয়েছেন তার মধ্যে বেশির ভাগই ডেমোক্রেট সমর্থক। যদি তাই হয় তাহলে এই ৬টি রাজ্যে সামান্য পিছিয়ে থাকা জো বাইডেন ঝলক মারতে পারেন। পেতে পারেন নাটকীয় জয়। উইসকনসিন, নর্থ ক্যারোলাইনা, জর্জিয়া ও মিশিগান মিলিয়ে মোট ইলেক্টোরাল কলেজ ভোট আছে ৫৭টি। বাইডেনের জয়ের জন্য এতো কলেজ ভোট প্রয়োজন নেই। তার আর ৩২টি ভোট হলেই চলে। মেইলের ভোটগুলো গণনা হলে তার জন্য এই ৩২টি ভোট সংগ্রহ অসম্ভব নয়। ফলে আশা না ছেড়ে তিনি নেতাকর্মী, সমর্থকদের শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন। এখানেই রাজনীতির ঘুঁটির চাল দিয়ে থাকতে পারেন ট্রাম্প। তিনিও হয়তো এই হিসাব কষেছেন। তাতে হয়তো পরাজয়ের আভাস পেয়ে তিনি বিজয় ঘোষণা করে দিয়েছেন। একই সঙ্গে সুপ্রিম কোর্টে যাওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। গত রাতে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত ওইসব রাজ্যের ভোট গণনা একটি নির্দিষ্ট স্থানে এসে স্থবির হয়ে পড়েছিল। তারপর কোনোই অগ্রগতি জানা যাচ্ছিল না।

পর্যবেক্ষকরা বলছেন, এমনিতেই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বেশ কয়েকদিন আগে জানান দিয়েছিলেন, ভোট গণনায় বিলম্ব হলে তিনি সুপ্রিম কোর্টের আশ্রয় নেবেন। রাজনীতির কৌশলে তিনি সেই তুরুপের তাস চেলেছেন বলেই দৃশ্যমান। যখন ভোট গণনা চলছে, তখন কেন তিনি বিজয় ঘোষণা করলেন? কেনই বা সুপ্রিম কোর্টে যাওয়ার ঘোষণা দিলেন? তবে কি তিনি পরাজয় আঁচ করতে পেরেছেন! হয়তো তাই। কারণ, স্থবির হয়ে থাকা রাজ্যগুলোতে জো বাইডেনের বিজয় পাওয়া অসম্ভব নয়। যদি তিনি সেখানে বিজয় পান, তাহলে ট্রাম্পের স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়ে যাবে। বাকি ৬টি রাজ্যের বেশির ভাগেই এগিয়ে আছেন ট্রাম্প। তবে তার মার্জিন খুবই সামান্য। এ সময়ে তিনি সুপ্রিম কোর্টে যদি ভোট গণনা বন্ধের আবেদন করেন এবং তা আদালতে গৃহীত হয়, তাহলে এগিয়ে থাকার কারণে ওইসব রাজ্যে আদালত তাকে বিজয়ী ঘোষণা করতে পারে। হয়তো সেই ট্রাম্পকার্ড চেলে থাকবেন ট্রাম্প।