দিনাজপুর থেকে অপরূপ পবর্তশৃঙ্গ কাঞ্চনজঙ্ঘা’র মিলছে দেখা !

শাহ্ আলম শাহী, দিনাজপুর থেকেঃ আর তেঁতুলিয়া নয়,এবার দিনাজপুর থেকেবরফ আচ্ছাদ্দিত কাঞ্চনজঙ্ঘার অপরূপ দৃশ্য মিলছে,দেখা। হিমালয়ের পাদ ঘেষা সীমান্তবেষ্টিত এই দিনাজপুর জেলার বিভিন্ন স্থান থেকে এখন ভারতের রূপালি কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যাচ্ছে। ঝকঝকে কাঁচের মতো স্বচ্ছ নীল আকাশ আর পরিচ্ছন্ন প্রাকৃতিক পরিবেশের ঋতু শরৎ প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। এমনই সময়ে পঞ্চগড় তেঁতুলিয়া ছাড়াও এবার দিনাজপুরে দেখা মিলছে,বিশ্বের তৃত্বীয় সবোর্চ্চ পবর্তশৃঙ্গ কাঞ্চনজঙ্ঘার।
চলতি শীত মৌসুমের শুরুতে আকাশে তেমন মেঘ আর কুয়াশা না থাকায় উত্তরের এই সাদা পাহাড় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।কোনও রকম কৃত্তিম যন্ত্র ব্যবহার না করে দূর পাহাড়ের অপরূপ দৃশ্য দেখে বিমোহিত দিনাজপুরবাসী। গত দু’দিন থেকে এমনি কিছু ছবি ও স্ট্যাটাস ভাইরাল হচ্ছে,সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে। শুধু তাই নয়,দিনাজপুর থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘার অপরূপ দৃশ্য দেখা’র বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন,দিনাজপুর জেলা প্রশাসক মো. মাহমুদুল আলম বাবু।তিনি বলেন,শনিবার জেলার বিভিন্ন স্থান থেকে দেখা মিলেছে,কাঞ্চনজঙ্ঘার অপরূপ দৃশ্য। এমন তথ্য তাঁকে তৃণমুল পর্যায়ের কর্মকর্তারা অবগত করেছেন।
অন্যদিকে,দিনাজপুর আবহাওয়া অধিদপ্তরের দায়িত্বরত কর্মকর্তা তোফাজ্জল হোসেন এর সত্যতা নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেছেন,“আগে বৃষ্টি হওয়ায় আকাশ ধুলিকণা ও নাইট্রোজেন মুক্ত রয়েছে। তাই,বর্তমানে মেঘমুক্ত আকাশে রূপোলি চকচকে কাঞ্চনজঙ্ঘা’র দেখা মিলছে। আকাশ মেঘমুক্ত থাকা ও উত্তরাঞ্চলে সা¤প্রতিক বৃষ্টির কারণে বাতাসে ধূলিকণার পরিমাণ কমে যাওয়াতেই কাঞ্চনজঙ্ঘা দৃশ্যমান হয়েছে।”
দিনাজপুরের বোচাগঞ্জ,বিরল,কাহারোল,বীরগঞ্জ উপজেলা ছাড়াও জেলা শহর থেকেও দেখা মিলছে কাঞ্চনজঙ্ঘার অপরূপ দৃশ্য। জেলা শহরের পূণর্ভবা নদীর পাড়,হাজী দানেশ বিশ^বিদ্যালয়,রাম সাগর জাতীয় উদ্যান,রাজবাড়ী,সরকারী কলেজ, গোর-এ শহীদ বড় ময়দান থেকে অনেকেই কাঞ্চনজঙ্ঘার অপরূপ দৃশ্য প্রত্যক্ষ করেছে।
দিনাজপুর হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়ের রেজিষ্টার বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রফেসর ডা.মো.ফজলুল হক বিশ^বিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের ছাদের উপর থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘার অপরূপ দৃশ্য দেখার সত্যতা স্বীকার করেছেন।
জেলার শিক্ষক কবি সাবিনা ইয়াসমিন ইতি তার ফেসবুক আইডি’তে কাঞ্চনজঙ্ঘার অপরূপ দৃশ্যে ছবি পোস্ট করেছেন। বলেছেন,এই কাঞ্চনজঙ্ঘার অপরূপ দৃশ্য দেখার কথাও।
দিনাজপুরের সংগঠক ও উদ্ভিদবিদ মোসাদ্দেক হোসেন এবং সাংবাদিক মোমেন তাদের ফেসবুকের আইডি’তে দিনাজপুরে দেখা কাঞ্চনজঙ্ঘা’র অপরূপ দৃশ্যের ছবি আপলোড করেছেন। এমন অনেকেই দিনাজপুরে দেখা পোস্ট ও আপলোড করেছেন,কাঞ্চনজঙ্ঘা’র অপরূপ দৃশ্য।
শনিবার সকাল ও বিকেলেবোচাগঞ্জ উপজেলায় বিভিন্ন এলাকার মানুষকাঞ্চনজঙ্ঘা’র অপরূপ দৃশ্য স্পষ্ট দেখাছেন। মুঠোফোনে সেই ছবি তুলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্টও করেছেন,অনেকে।
এছাড়াও বিরল,কাহারোল,বীরগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে খালি চোখে দেখা মিলেছে কাঞ্চনজঙ্ঘা অপরূপ দৃশ্য। যে ছবি ভাইরাল হয়েছে,সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।
সাধারণত পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায়অক্টোবর থেকে নভেম্বর মাস পর্যন্ত শীতের আগে মেঘমুক্ত নীলাকাশে ভেসে ওঠে তুষার শুভ্র হিমালয় পর্বত ও কাঞ্চনজঙ্ঘা। বছরের এই নির্দিষ্ট সময়ে বাংলাদেশ থেকে দৃশ্যমান হিমালয় পর্বত ও কাঞ্চনজঙ্ঘাকে দেখতে প্রতি বছরই অসংখ্য পর্যটক আসে। তবে,এবার দিনাজপুরেও দেখা মিলেছে,কাঞ্চনজঙ্ঘার অপরূপ দৃশ্য।
শনিবার (৩১ অক্টোবর)সকালে সূর্যোদয়ের পর থেকেই দিনাজপুরের বিভিন্ন স্থান থেকে প্রথমবারের মতো চোখে ধরা পড়ে কাঞ্চনজঙ্ঘার নয়নাভিরাম নৈসর্গিক রূপ। সূর্যকিরণের তেজ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কাঞ্চনজঙ্ঘা আরও বেশি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সকাল দশটা থেকে এগারটা পর্যন্ত বেশ ভালোভাবেই দেখা যায়। তারপর ক্রমান্বয়ে আবার ঝাপসা হয়ে হারিয়ে যায় কাঞ্চনজঙ্ঘা। তবে,শেষ বিকেলে সূর্যকিরণ যখন তির্যকভাবে বরফাচ্ছাদিত পাহাড়ে পড়ে তখন অনিন্দ্য সুন্দর হয়ে আবারও ধরা দেয় কাঞ্চনজঙ্ঘা।কাঞ্চনজঙ্ঘা অপরূপ দৃশ্যে দেখা মেলে দুই মেরু রেখার বাইরে সবচেয়ে বেশি বরফ ধারণ করে রেখেছে হিমালয় পর্বতমালা। আর সূর্য্যরে সব রঙেই যেন নিজের মধ্যে ধারণ করে রেখেছে হিমালয়ের সর্বোচ্চ পর্বত কাঞ্চনজঙ্ঘা। তাই সুর্যের আলো বাড়ার সাথে সাথে ক্ষণে ক্ষণে পাল্টাতে থাকে হিমালয় ও কাঞ্চনজঙ্ঘার রূপ। প্রথমে লাল রঙ দেখা গেলেও সেই রং লাল থেকে পাল্টে গিয়ে কমলা রঙের হয়, তারপর হলুদ রঙ হয়ে সর্বশেষ সাদা দেখা যায় কাঞ্চনজঙ্ঘা অপরূপ সৌন্দর্য্য।
উইকিপিডিয়ার তথ্যানুযায়ী, কাঞ্চনজঙ্ঘা পর্বতশৃঙ্গ নেপাল ও ভারতের সিকিম সীমান্তে অবস্থিত।বাংলাদেশের সর্ব-উত্তরের জেলা পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ার বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর থেকে নেপালের দূরত্ব ৬১ কিলোমিটার,ভুটানের দূরত্ব ৬৮ কিলোমিটার, চীনের দূরত্ব ২’শ কিলোমিটার, ভারতের দার্জিলিংয়ের দূরত্ব ৫৮ কিলোমিটার,শিলিগুড়ির দূরত্ব ১০ কিলোমিটার। অন্যদিকে হিমালয়ের এভারেস্ট শৃঙ্গের দূরত্ব ৭৫ কিলোমিটার আর কাঞ্চনজঙ্ঘার দূরত্ব ১১ কিলোমিটার। তাই,মেঘ-কুয়াশামুক্ত আকাশের উত্তর-পশ্চিমে তাকালেই দেখা মেলে বরফ আচ্ছাদিত সাদা পাহাড় কাঞ্চনজঙ্ঘার।হিমালয়ের পাদদেশে তেঁতুলিয়া উপজেলা অবস্থিত হওয়ায় খালি চোখে দেখা যায় কাঞ্চনজঙ্ঘা।
পর্বতশৃঙ্গ নেপাল ও ভারতের সিকিম সীমান্তে অবস্থিত এই কাঞ্চনজঙ্ঘা হিমালয় পৃথিবীর সবোর্চ্চ পর্বতমালা। এই পর্বতমালার তিনটি চূড়া আবার পৃথিবীর সবোর্চ্চ চূড়া। এরমধ্যে প্রথম অবস্থানে থাকা মাউন্ট এভারেস্টের উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৮ হাজার ৮’শ ৪৮ মিটার বা ২৯ হাজার ২৯ ফিট। দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা চূড়া কেটু’র উচ্চতা ৮ হাজার ৬’শ ১১ মিটার বা ২৮ হাজার ২’শ ৫১ ফিট। তৃতীয় অবস্থানে থাকা কাঞ্চনজঙ্ঘার উচ্চতা ৮ হাজার ৫৮৬ মিটার বা ২৮ হাজার ১’শ ৬৯ ফিট। যদিও ১৮৫২ সালের আগে কাঞ্চনজঙ্ঘাকে পৃিিথবীর সর্বোচ্চ শৃঙ্গ বলে মনে করা হতো। ১৯৫৫ সালের ২৫ মে মাসে ব্রিটিশ পবর্তারোহী দলের সদস্য জোয়ে ব্রাউন এবং জর্জ ব্যান্ড সর্বপ্রথম কাঞ্চনজঙ্ঘায় আরোহণ করেন।
সুউচ্চ এই চূড়া দেখতে প্রতি বছর অসংখ্য দেশি-বিদেশি পর্যটক ছুটে যান ভারতের পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং জেলা শহরের টাইগার হিল পয়েন্টে। টাইগার হিলই হচ্ছে,কাঞ্চনজঙ্ঘার চূড়া দেখার সবচেয়ে আদর্শ জায়গা। তবে,কেউ কেউ যান সান্দাকপু বা ফালুট। আবার কেউ কেউ সরাসরি নেপালে গিয়েও কাঞ্চনজঙ্ঘায় পর্যবেক্ষণ করে থাকেন।তবে,যাদের এসব সুযোগ মেলে না সেইসব বাংলাদেশি পর্যটকেরা কাঞ্চনজঙ্ঘার রূপ অবলোকন করতে ছুটে আসেন তেঁতুলিয়ার বাংলাবান্ধায়। এখানে মেঘমুক্ত আকাশে দিনের প্রথম সূর্যকিরণের সঙ্গে সঙ্গেই চোখে পড়ে কাঞ্চনজঙ্ঘা। একটু বেলা বাড়লেই তেজোদীপ্ত রোদ যখন ঠিকরে পড়ে বরফাচ্ছাদিত পাহাড়ের গায়ে,কাঞ্চনজঙ্ঘা তখন ভিন্নরূপে ধরা দেয় পর্যটকের চোখে। যে রূপের টানে প্রতি বছর হাজারো পর্যটক আসেন তেঁতুলিয়ায়।
তবে,এবার প্রথম দিনাজপুরে শনিবার দিনের শুরুতে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা মেলে। প্রথমে একটু কালচে, এরপর ক্রমান্বয়ে টুকটুকে লাল,কমলা, হলুদ এবং সাদা বর্ণ ধারণ করে। আর সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এ পরিবর্তন দেখতে দূরবীন বা বাইনোকুলারের প্রয়োজন হয়নি কারো।
অনেকে,দিনাজপুর থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে পাওয়ার বিষয়টি অপেক্ষাকৃত কম সামর্থ্যবান মানুষের জন্য “সৃষ্টিকর্তার উপহার” বলে অবহিত করেছেন।