ক্যানসার চিকিৎসা ব্যয়, দরিদ্রসীমার নীচে নেমে যাচ্ছে মধ্যবিত্ত

হিউম্যান ২৪ ডেস্ক : বাংলাদেশে ক্যান্সারে আক্রান্তের সংখ্যা উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে বলে বিশেষজ্ঞরা জানিযেছেন। এবছর দেড় লাখের বেশি মানুষ ক্যান্সারে আক্রান্ত হতে পারে বলে জানিয়েছে ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি ফর রিসার্চ অন ক্যান্সার ।

কিন্তু বাংলাদেশে ক্যান্সারের চিকিৎসা ব্যবস্থা যা আছে, তা একদিকে অপ্রতুল এবং অন্যদিকে দীর্ঘ মেয়াদে অনেক ব্যয়বহুল। আক্রান্তরা চিকিৎসা ব্যয় সামলাতে গিয়ে জমিজমা বিক্রি করে নিঃস্ব হয়ে পড়ছে।

ঢাকায় জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট এর ৩০০ শয্যার হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, বেশির ভাগ রোগীই নিম্ন আয়ের পরিবারের নারী এবং পুরুষ। রোগীদের কয়েকজন বলেছেন, বেসরকারি হাসপাতালের তুলনায় সরকারি এই হাসপাতালে খরচ কিছুটা কম। কিন্তু লম্বা সময় ধরে সেটাও সামাল দিতে তাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। সময়মতো হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা পাওয়ার জন্যও তাদের অনেক ভোগান্তি পোহাতে হয়।

“আমি ঢাকার বাইরে থেকে আসি। কিন্তু এখানে সময়মতো সিরিয়াল পাই না। আসলে বলে ১০দিন পরে আসেন। আবার কয়েকদিন পর আসতে বলে। আমি সময়মতো চিকিৎসা পাই না। টাকাও অনেক খরচ হয়। সেটা যোগাড় করাও আমাদের মতো নিম্ন আয়ের মানুষের সমস্যা, খুব সমস্যা।”

বেশি বিপদে মধ্যবিত্তরা
জামাললপুরের একজন গৃহিনী ইসমত আরা নাজমা ক্যান্সারে আক্রান্ত হন নয় বছর আগে। তাঁর শরীরে ক্যান্সার ধরা পড়ার পর প্রথম পর্যায়ে অপারেশন করতেই পাঁচ লাখ টাকার বেশি ব্যয় হয়। আক্রান্ত হওয়ার দুই বছরের মাথায় তাঁর স্বামী স্ট্রোক করে মারা যান। এখন তার পরিবার চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে গিয়ে এখন অনেকটা সর্বশান্ত।

স্কুল শিক্ষার্থী দুই ছেলে মেয়ের পড়াশুনা এবং অন্যদিকে নিজের ব্যয়বহুল চিকিৎসা সামলাতে গিয়ে বেশ কষ্ট হয় মধ্যবিত্ত পরিবারের ইসমত আরা নাজমার।

“তখন আমার স্বামী ছিল। চাকরি করতো। দুইটা ছেলে মেয়ে লেখা-পড়ার মধ্যে ছিল। ঐ সময় ক্যান্সার ধরা পড়লো। তারপরে অপারেশন হওয়ার পরে তো আমার স্বামী নিজেই স্ট্রোক করে মারা গেলো। শুধু টেনশন করে উনি মারা গেলেন। যাই হোক, আমার জন্য একটু জুলুমই হচ্ছে, তারপরও চিকিৎসা না করলে তো হয় না।”

“চেক আপ করাতে যাই। অনেক টেস্ট দেয়, তাতে অনেক টাকা লাগে। মাঝখানে একটা টেস্ট দিয়েছিলো, তাতে ৬৫ হাজার টাকা লাগে। এত টাকা লাগে, আমার জন্য জুলুম হয়ে যায়। ধরেন, স্বামী মারা যাওয়ার পর আমার আব্বা বেঁচে ছিলেন। তিনি এবং আমার ভাইরা সাহায্য করেছেন। কত আর তাদের কাছ থেকে নেই। তো এখন ঐ জমিজমার মধ্যে হাত দেই।”

ক্যান্সারের চিকিৎসা ব্যবস্থা কতটা আছে?
ক্যান্সারের চিকিৎসার জন্যে ঢাকায় একটি মাত্র বিশেষায়িত সরকারি হাসপাতাল এবং কয়েকটি বেসরকারি হাসপাতাল রয়েছে । ঢাকার বাইরে মাত্র দু’টি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সীমিত আকারে এই রোগের চিকিৎসা দেয়া হয়। তবে, এই রোগের চিকিৎসা সেবা মূলত ঢাকা কেন্দ্রিক।

জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক হাবিবুল্লাহ তালুকদার বিবিসিকে বলছিলেন, ক্যান্সার আক্রান্তের সংখ্যা যে হারে বাড়ছে, সে কারণে রোগীদের সেবা পেতেও সময় লেগে যাচ্ছে।

“যা করছি আমরা ঢাকায় করছি। কিন্তু ১ লাখ ৫০ হাজার রোগী যদি নতুন করে আক্রান্ত হয়, এর যদি তিন ভাগের একভাগ রোগীও ডায়াগনসিস হয়, তাহলে যে ক’টা হাসপাতাল আছে, তাতে ৫০ হাজার রোগীর চিকিৎসা ঢাকা শহর কি করে দেবে?”
“লম্বা সময় লেগে যাচ্ছে। কেমোথেরাপি দিতে এক সপ্তাহ থেকে এক মাস এবং রেডিও থেরাপির সিরিয়াল পেতে চার পাঁচ মাস পর্যন্ত সময় লেগে যাচ্ছে। অপারেশনেই এরকম সময় লাগছে। ফলে ঢাকার বাইরে অন্তত বিভাগীয় শহরে এই চিকিৎসা গড়ে তুলতে না পারলে মানুষের সাধ্যের মধ্যে চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব নয়।”

পুরোপুরি ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসায় হরমোন থেরাপি থেকে শুরু করে রেডিওথেরাপি, কেমোথেরাপি এবং অনেক ঔষধের প্রয়োজন হয়।এর প্রতিটি ধাপেই বড় অংকের অর্থ গুনতে হয়।

চিকিৎসা ব্যয়ের জন্য অনেকে দারিদ্র সীমার নীচে নেমে যাচ্ছে’

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নিজামউদ্দিন আহমেদ একজন চিকিৎসক হিসেবে তাঁর অভিজ্ঞতা থেকে উল্লেখ করেন, চিকিৎসা ব্যয় পরিবারগুলোকেই পঙ্গু করে দিচ্ছে। “একটা ক্যান্সার ইনস্টিটিউট আছে। কেউ কেউ ক্যান্সার চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরেও যান। কিন্তু সেটা দিয়ে কি আমরা বলতে পারি, জাতীয়ভাবে আমরা সমর্থ, মোটেও না।”
তিনি আরও বলেছেন, “প্রতিবছর অনেক মানুষ চিকিৎসা ব্যয়ের জন্য দরিদ্র সীমার নীচে নেমে যাচ্ছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। অনেক মানুষই ধারণা না থাকায়, এই সেবা নিতে গিয়ে সর্বশান্ত হচ্ছেন, নিজে মারা যাচ্ছেন, তার পরিবারকেও মেরে রেখে যাচ্ছেন।

সঠিক কোন পরিসংখ্যান নেই কেন?
ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি ফর রিসার্চ অন ক্যান্সার সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে বলেছে, ২০১৮ সালে বাংলাদেশে নতুন করে ক্যান্সারে আক্রান্ত হতে পারে ১ লাখ ৫০ হাজারেরও বেশি মানুষ। গত বছর ক্যান্সারে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ১ লাখ ২২ হাজার।
আন্তর্জাতিক সংস্থাটি দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর পরিস্থিতি এবং বাংলাদেশের জনসংখ্যা বিবেচনায় নিয়ে এই পরিসংখ্যান দিয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের নিজস্ব কোনো পরিসংখ্যান নেই। এর কোনো উদ্যোগ কখনও নেয়া হয়নি।

হাবিবুল্লাহ তালুকদার মনে করেন, বাংলাদেশের নিজেদের করা বাস্তবসম্মত কোনো পরিসংখ্যান না থাকায় চিকিৎসা সেবার পরিকল্পনা করাও সম্ভব হচ্ছে না।

“২০০৯ সালে ক্যান্সার প্রতিরোধে একটা নীতিমালা করা হয়েছিল যেটা আর আপডেট করা হয়নি। সেই নীতিমালা অনুযায়ীও যে সব হচ্ছে, সেটা বলা যায় না। এরজন্য সবার আগে দরকার আমাদের নিজস্ব একটা পরিসংখ্যান। রোগীর সংখ্যা কত..কি ধরণের ক্যান্সার বেশি হচ্ছে, এগুলো যদি না জানতে পারি, তাহলে কিভাবে আমরা পরিকল্পনা নেবো।”

তবে বিশেষজ্ঞরা ধারণা করে বলেন, পুরুষের তুলনায় নারীদের ক্যান্সারে আক্রান্তের সংখ্য কম ছিল। গত পাঁচ বছর ধরে নারীদের আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে চলেছে বলে বলা হচ্ছে।

চিকিৎসকদের বক্তব্য হচ্ছে, উচ্চবিত্তরা ক্যান্সারে আক্রান্ত হলেই দেশের বাইর যাচ্ছেন চিকিৎসার জন্য। নিম্ন আয়ের এবং নিম্ন মধ্যবিত্তরাই দেশে চিকিৎসা করছেন। ফলে চিকিৎসকরা ধারণা করেন, নিম্নবিত্তরাই এই রোগে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে।

অধ্যাপক সাবেরা খাতুন বলছিলেন, “পুরুষরা খাদ্যনালী এবং ফুসফুসের ক্যান্সারে বেশি ভোগেন। আর নারীরা আক্রান্ত হচ্ছেন বেশি স্তন এবং জরায়ুর ক্যান্সারে। এর মূল কারণ বাল্য বিয়ে এবং অল্প বয়সে বাচ্চা নেয়া। এগুলো প্রতিরোধে আরও জোর দেয়া প্রয়োজন।”

পেলিটিভ কেয়ার ইউনিটের ধারণা কতটা গুরুত্ব পাচ্ছে?                                                                   ক্যান্সারে আক্রান্তদের শেষ পর্যায়ে গিয়ে যখন বাঁচার সম্ভবনা আর থাকে না, তখন যাতে যন্ত্রনা কম হয়, সে ধরণের চিকিৎসা সেবারও প্রয়োজন আছে বলে চিকিৎসকরা বলছেন। কিন্তু সে ব্যাপারে নজরই নেই। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালেই শুধু এ ধরনের পেলিটিভ কেয়ার ইউনিট আছে। সেখানে মাত্র ১৯টি শয্যা রয়েছে।

এই বিভাগের প্রধান অধ্যাপক নিজামউদ্দিন আহমেদ বলছিলেন, ক্যান্সারের রোগীর জন্য গুরুত্বপূর্ণ এই সেবার ব্যাপারে বেসরকারি উদ্যোক্তারাও গুরুত্ব দিচ্ছে না।

“বাংলাদেশে পেলিটিভ কেয়ারের ব্যবস্থাটা কোনো দিনই ছিল না। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আমি বলবো এখনও নাই। বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি বিভাগ হয়েছে, এটা নিয়ে অহংকার করি, গর্ববোধ করি। ছোট ছোট দু’একটি উদ্যোগ হয়েছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ চেষ্টা করে যাচ্ছে। ক্যান্সার ইন্সটিটিউট এখন এনিয়ে কথা বলছে। কিন্তু এই বিশাল সমুদ্রে এটা এক ফোঁটা পানি ছাড়া আর কিছুই না।”
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের এই পেলিটিভ কেয়ার ইউনিটের ওয়ার্ডে কথা হয় ২৪ বছর বয়সী একজন নারীর সাথে।

তিনি গার্মেন্টসে চাকরি করতেন। তিনি যে শেষ অবস্থায় এসে পৌছেছেন, সে ধারণাও তাঁকে দেয়া হয় নি।
দু’বছর আগে ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার পর থেকে চিকিৎসার টাকা যোগাতে তাঁর পরিবারের যে কষ্ট হয়েছে, সে কথাই তিনি এখন বার বার বলেন।

চিকিৎসকরা বলছেন, ক্যান্সারের আক্রান্তদের চিকিৎসার বড় অংকের টাকা যোগাড়ের বিষয়টিই তাদের আরও সংকটের দিকে ঠেলে দেয়।তবে, সরকারের পাশাপাশি চিকিৎসকদেরও অনেকে এটাও বলেন, সারা বিশ্বেই ক্যান্সারের চিকিৎসা ব্যয়বহুল।