ভাঙ্গনের কবলে মা-বাবার কবর, শেষবারের মতো জিয়ারত পুত্রের

 হিউম্যান ২৪ ডেস্ক:  ভাঙ্গনের কারণে হাহাকার এখন পদ্মা নদীর তীরবর্তী শরীয়তপুর ও রাজবাড়ি জেলার জনপদে। ভাঙনের খবর শুনে ছুটে এসেছেন ব্যবসায়ী মো. ইউনুস আলী শেখ। তিনি পরিবার নিয়ে থাকেন গোয়ালন্দে। এসেই দ্রুত বাবা-মায়ের কবরের পাশে দাঁড়িয়ে জিয়ারত করলেন।

জিয়ারত শেষে বলেন, ‘বড় ভাই, চাচারা সবাই এখানে থাকতেন। নদীতে ভাঙনের খবর পেয়ে ছুটে এসেছি। মনে হয়ে আজকের মধ্যে সব নদীতে যাবে। বাবা-মায়ের কবর হয়তো আর জিয়ারত করতে পারব না। তাই শেষবারের মতো কবর জিয়ারত করতে এলাম।’

ইউনুস আলীর মতো এমন হাহাকারের গল্প এখন ওই এলাকাজুড়ে। আরেক ব্যবসায়ী ভাঙনের হাত থেকে আসবাবপত্র বাঁচাতে বসতবাড়ি ফাঁকা করেছেন। কিন্তু ভিটায় থাকা অর্ধশত গাছ কী করবেন? রাতারাতি তো কিছু করা সম্ভব না। তাই নামমাত্র মূল্যে লাখ খানেক টাকায় বিক্রি করে দিলেন গাছগুলো।

রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ উপজেলার দৌলতদিয়া, দেবগ্রাম ও ছোটভাকলা ইউনিয়নের পদ্মা নদীর তীরবর্তী এলাকায় ব্যাপক ভাঙন চলছে গত তিন সপ্তাহ ধরে। দেবগ্রাম ও ছোটভাকলা ইউনিয়নের পর দৌলতদিয়ায় ব্যাপক আকারে ভাঙন দেখা দিয়েছে। স্থানীয় লোকজনের মতে, ভাঙ্গনের ঝুঁকিতে বসবাস করছে প্রায় ১ হাজার ৫০০ পরিবার। গত দুই সপ্তাহে প্রায় ৪০০ পরিবারের বসতভিটা পদ্মায় বিলীন হয়ে গেছে। ঘর হারিয়ে মানবেতরভাবে জীবন যাপন করছে অনেকে।
মঙ্গলবার দৌলতদিয়ার ঢল্লাপাড়া গ্রামে দেখা যায়, পদ্মার পাড়ে ঢল্লাপাড়া জামে মসজিদের কিছু অংশ নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। স্থানীয় লোকজন আশঙ্কা করছেন, দিন শেষে পুরো মসজিদ বিলীন হয়ে যাবে।
আগের দিন গতকাল সোমবার মসজিদ থেকে কয়েক গজ দূরেই ছিল ঢল্লাপাড়া মাজার শরিফ। গতকাল সন্ধ্যার পর সম্পূর্ণ বিলীন হয়ে যায়। অনেকে তাঁদের বাড়িঘর দ্রুত সরিয়ে ফেলছেন। নদীর কাছে অধিকাংশ বসতভিটা শূন্য পড়ে আছে।
মসজিদ থেকে একটু দূরে শূন্য ভিটায় গাছ কাটছেন কয়েকজন শ্রমিক। শ্রমিকদের সর্দার মাইনউদ্দিন শেখ (৬০) বলেন, বাড়িটি ছিল মোস্তফা মুন্সির। মোস্তফা মুন্সি গোয়ালন্দের মোস্তফা পিভিসি মেটারসের মালিক। এখানে বিশাল বাড়ি ছিলো। মালিক সবকিছু তিন দিন আগে সরিয়ে নেন। ভিটেয় থাকা মেহগনি, আম, জামসহ ৫৫টি গাছ গোয়ালন্দ মোড়ে নিমতলার নান্নু মিজির কাছে অর্ধেক মূল্যে মাত্র এক লাখ পাঁচ হাজার টাকায় বিক্রি করেছেন।

গ্রামের রোকন মুন্সির স্ত্রী আনোয়ারা বেগম (৪৫) জানালেন, “বিঘা দশেক জমি, দুটি বড় টিনের ঘর—সব নদীতে চলে গেল। অহন পাশের নাসির সরদারপাড়ায় অন্যের জমির ওপর ঘর নিয়ে ফেলাইছি। আপাতত ওহানে থাকমু। তারপর জমি কিনতে পারলে আরেক জায়গায়, না হলে রাস্তার ওপর থাকমু।’
দৌলতদিয়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম মণ্ডল বলেন, এক মাস ধরে নদীভাঙন দেখা দিয়েছে। দুই সপ্তাহ ধরে ব্যাপক ভাঙন অব্যাহত থাকায় ২ নম্বর ওয়ার্ড ঢল্লাপাড়া, ৩ নম্বর ওয়ার্ড আফছের শেখেরপাড়া ও লালু মণ্ডলপাড়ার প্রায় ৩০০ পরিবারের বসতভিটা বিলীন হয়েছে।
চলতি সপ্তাহে ১০০ পরিবার ভাঙন থেকে রক্ষা পেতে অন্যত্র সরে গেছে। প্রতিদিন অনেক পরিবার সরে যাচ্ছে। এ ছাড়া ১ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্তার মেম্বারপাড়া, সিদ্দিক কাজীপাড়া ও মজিদ শেখেরপাড়ার প্রায় ১ হাজার ৫০০ পরিবার ভাঙনের আতঙ্কে রয়েছে।”
তিনি জানান, ভাঙন রোধে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী ও রাজবাড়ী-১ আসনের সংসদ সদস্য কাজী কেরামত আলী এবং জেলা প্রশাসককে জানানো হয়েছে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আবু নাসার উদ্দিন বলেন, দৌলতদিয়ায় বন্যা ও নদীভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত ১ হাজার ৭০০ পরিবারের তালিকা পাওয়া গেছে। ইতিমধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের মধ্যে জিআরের চাল ও শুকনা খাবার বিতরণ কার্যক্রম শুরু হয়েছে। ভাঙন প্রতিরোধের বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।

মাইনউদ্দিন শেখ বলেন, ‘নান্নু মিজির হয়ে তাঁরা নয়জন শ্রমিক পাঁচ দিন ধরে গাছ কাটছেন। ভাঙনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পারছেন না। গতকাল কয়েকটি মেহগনির টুকরো রেখে অন্য গাছ কাটছিলাম। মুহূর্তের মধ্যে সব নদীতে চলে গেল।’

নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে ঢল্লাপাড়া রাস্তার ইট তুলে নেওয়া দেখছিলেন স্থানীয় বাসিন্দা ও জলিল সরদারপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক লুৎফর রহমান।
তিনি বলেন, প্রায় এক কিলোমিটার রাস্তা নদীগর্ভে চলে গেছে। শতাধিক পরিবারের বসতভিটা, একটি মাজার শরিফ বিলীন হয়েছে। ঢল্লাপাড়া জামে মসজিদ নদীতে বিলীন হচ্ছে। যেকোনো মুহূর্তে পদ্মার পেটে চলে যাবে। নদী থেকে কয়েক শ গজ দূরে তাঁর বাড়ি। যাওয়ার মতো জায়গা না থাকায় কোথায় যাবেন সেই দুশ্চিন্তায় রয়েছেন।