বিএনপিকে ছাড়ছে জামায়াত

বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ও বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী- রাজনীতির মাঠে এ দুই দলের পারস্পরিক নির্ভরতা গত ২০ বছর ধরে। একে অন্যের জোটসঙ্গী, ভোটসঙ্গী। কিন্তু যুদ্ধাপরাধের দায়ে নিবন্ধন বাতিল হওয়া জামায়াতের সঙ্গে সাম্প্রতিককালে বিএনপির সম্পর্ক ছিল অনেকটাই শীতল।

বিএনপি নেতৃত্বেরই একটি অংশ চাইছিলেন, জামায়াতকে ছাড়াই পথ চলতে যেন যুদ্ধাপরাধের তকমা দলের গায়ে না লাগে। তাই অনেকটা গা বাঁচিয়ে চলার চেষ্টা করেছে দলটি। অন্যদিকে জামায়াতের একের পর এক কেন্দ্রীয় নেতার যুদ্ধাপরাধের দায়ে ফাঁসির দণ্ডাদেশ, উপরন্তু জোটেও দিন-দিন দলের গুরুত্ব হ্রাস পাওয়ায় জামায়াতও ছিল মনক্ষুণ্ন। তবুও দুই দলের সম্পর্ক ছিল, শীতল হলেও। সেই সম্পর্কে শেষ পর্যন্ত ইতি টানা হচ্ছে।

জামায়াতের কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরায় সিদ্ধান্ত হয়েছে, বিএনপির সঙ্গে আর থাকবে না দলটি। এরই ধারাবাহিকতায় এখন থেকে ২০-দলীয় জোটের কোনো কর্মসূচি ও বৈঠকেও অংশ নেবে না জামায়াত। একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্র এ তথ্য নিশ্চিত করেছে।

জানা গেছে, এমন সিদ্ধান্ত হলেও সেটি আপাতত আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করবে না জামায়াত। পরিস্থিতি বুঝে যথাসময়ে আনুষ্ঠানিকভাবে এ সিদ্ধান্ত জনসমক্ষে ঘোষণা করা হবে। তবে জামায়াতের সব ইউনিটকে মজলিসে শূরার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এ নিয়ে দলীয় নেতাদের কিছু দিকনির্দেশনাও দিচ্ছে জামায়াত। অন্যদিকে জামায়াতের এমন সিদ্ধান্তে খুশি বিএনপিও। দুই দলের মধ্যে যে শীতল সম্পর্ক চলছে অনেক দিন ধরে, তাতে জোটবদ্ধ না থাকাই শ্রেয়তর বলে মনে করছেন বিএনপির নীতিনির্ধারকরা।

বিএনপির বড় একটি অংশ এবং দলটির সমর্থনকারী বুদ্ধিজীবীরা জামায়াতের সঙ্গ ছাড়তে অনেক দিন ধরেই পরামর্শ দিয়ে আসছিলেন। জামায়াত ছাড়তে দেশি-বিদেশি নানা মহলও বিএনপির ওপর চাপ সৃষ্টি করে আসছিল। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর জামায়াত ত্যাগের বিষয়টি নিয়ে দলের ভেতরও অল্পবিস্তর আলোচনা সৃষ্টি হয়। এমন অবস্থার মধ্যে নাটকীয়ভাবে জামায়াতই বরং বিএনপিকে ছেড়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

একাদশ সংসদ নির্বাচন কেন্দ্র করে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠনের পর জামায়াতের গুরুত্ব অনেকটাই কমে যায়, বিশেষ করে বিএনপির কাছে। নির্বাচনে জামায়াতকে তাই আশানুরূপ আসন দেয়নি বিএনপি। এ নিয়ে জামায়াত নেতারাও অসন্তুষ্ট। তদুপরি ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষনেতা ড. কামাল হোসেন জামায়াতকে কটাক্ষ করে নানা মন্তব্যও করেছেন।

বিএনপির সঙ্গ ত্যাগের বিষয়ে জামায়াতের নায়েবে আমির মিয়া গোলাম পরওয়ার অবশ্য বলেছেন, এখনো এমন সিদ্ধান্ত হয়নি। আমাদের যে কোনো সিদ্ধান্ত সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে গণমাধ্যমে জানানো হবে। তিনি আরও বলেন, বিএনপি-জামায়াতের জোট দীর্ঘদিনের। বললেই তো তা শেষ হবে না।

জামায়াতের কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য এহসানুল মাহবুব জুবায়ের বলেন, ২০ দল একটি নির্বাচনী জোট। জাতীয় নির্বাচন হয়ে গেছে। এখন আছে উপজেলা নির্বাচন। এতে অংশ নেবে না বিএনপি। এ ছাড়া ২০-দলীয় জোটের কোনো কার্যক্রম আপাতত নেই। বিএনপির কার্যক্রম চলছে; ২০-দলীয় জোটের অন্য শরিকরাও দলগতভাবে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। জাতীয় নির্বাচনে অনিয়মের অভিযোগ এনে হাইকোর্টেও নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালে বিএনপি প্রতীকী মামলা করার সিদ্ধান্ত নিলেও জামায়াত এ ধরনের কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি।

অবশ্য বিএনপি নেতাদের দাবি, সরকারের রোষানল থেকে বাঁচতে এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে জামায়াত। সরকারের সঙ্গে জামায়াতের একটি অংশের আঁতাত আছে বলে মনে করেন বিএনপি নীতিনির্ধারকরা। সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনে জামায়াত পৃথক প্রার্থী দেওয়ার পর বিএনপি-জামায়াত দূরত্ব বাড়তে থাকে। জাতীয় নির্বাচনে জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচন করলেও আসনপ্রাপ্তি এবং ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচন নিয়ে দুদলের মধ্যে মতের মিল ছিল না।

প্রসঙ্গত, ১৯৯৯ সালের জানুয়ারি মাসে ৮ম জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে আন্দোলন ও নির্বাচনকেন্দ্রিক ৪-দলীয় জোট গঠন করা হয় বিএনপির নেতৃত্বে, জামায়াতের যোগদান সাপেক্ষে। নির্বাচনে জয়লাভের পর ৪-দলীয় জোট গঠন করে সরকার। পরবর্তী সময়ে তা ২০-দলীয় জোটে রূপ নেয়।

জামায়াতের ২০-দলীয় জোট ছাড়ার বিষয়ে বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের এক নেতা বলেন, দুই দলের মধ্যে সম্পর্ক এখন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, জামায়াতের জোটে থাকা না-থাকা একই কথা। তারা চলে গেলেই বরং ভালো। ছাড়তে চাইলেও আমরা তাদের ছাড়তে পারছিলাম না নানা কারণে। তারা চলে যেতে চাইলে বিএনপি বারণ করবে না বা তাদের আটকাবে না।

জানতে চাইলে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, নির্বাচনপরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটেও শরিক দলগুলোর মধ্যে ভিন্নমত দেখা দিয়েছে। আমাদের জোটেও এমন মতানৈক্য থাকতে পারে। সে ক্ষেত্রে আমাদের জোট থেকে কেউ চলে গেলে কোনো মন্তব্য নেই।

জামায়াতের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা বলছেন, বিএনপির সঙ্গে থাকার কারণে সরকার তাদের ওপর নির্যাতন বেশি করছে। আবার বিএনপিও তাদের গুরুত্ব দিচ্ছে না। এ অবস্থায় এককভাবে চলার পক্ষে দলটির বেশিরভাগ নেতা।

প্রসঙ্গত, ৪-দলীয় জোট সরকারে যুদ্ধাপরাধী মতিউর রহমান নিজামী ও আলী আহসান মুজাহিদকে তার মন্ত্রিপরিষদে স্থান দেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। এ নিয়ে তখন নানা মহলে সমালোচনার ঝড় ওঠে। প্রতিবেশী দেশ ভারতের সঙ্গেও তৎকালীন জোট সরকারের দূরত্ব সৃষ্টি হয়। জামায়াতের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের যুদ্ধাপরাধের দায়ে ফাঁসির রায় হওয়ার পর বিএনপির সঙ্গে দলটির জোটবদ্ধতা নিয়ে সমালোচনা আরও বেড়ে যায়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ বলেন, জামায়াত নিজ থেকে চলে গেলে আমরা খুশিই হব। বিএনপিরও উচিত হবে না জামায়াতকে জোটে রাখা। সূত্র: আমাদের সময়।