উখিয়া ও টেকনাফের স্থানীয় ক্ষতিগ্রস্থ লোকজনের মাঝে রোহিঙ্গাদের সেবায় নিয়োজিত দেশী-বিদেশী এনজিও গুলোর বিরুদ্ধে উত্তেজনা, ক্ষোভ ও প্রতিবাদ-বিক্ষোভ বিরাজ করছে। গত ডিসেম্বর শেষ থেকে এ পর্যন্ত বিভিন্ন এনজিও গুলো প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার অজুহাতে কয়েক শত স্থানীয় বেকার দরিদ্র কর্মজীবিদের তাদের চাকুরী থেকে ছাঁটাই করেছে। অথচ রোহিঙ্গা ক্যাম্প গুলোতে এসব এনজিও সমূহে কর্মরত কক্সবাজার জেলার বহিরাগত ও শত শত রোহিঙ্গাদের চাকুরী বহাল তবিয়তে রয়ে গেছে। মূলত এসব অনিয়ম ও দুর্ণীতির অভিযোগ এনে স্থনীয় ক্ষতিগ্রস্থ লোকজন এনজিও গুলোর বিরুদ্ধে রোহিঙ্গা ও স্থানীয়দের মুখোমুখি করে বিশৃংখলা সৃষ্টির অভিযোগ করে আসছে।
শফিকুর রহমান (৩০) একজন রোহিঙ্গা যুবক। আশ্রয়, রেশনপাতি, চিকিৎসা সহ প্রায় সব মৌলিক চাহিদা বিনা মূল্যে পেয়ে আসছে। সে ওব্যাট হেলপার নামের একটি বিদেশী এনজিওতে প্রোগ্রাম কর্ডিনেটর পদে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের চাকুরী করছে মাসিক ৪০ হাজার টাকা বেতনে। একই এনজিওতে লজেস্টিক অ্যান্ড অ্যাডমিন অফিসার পদে জাহিদ আলম সহ ফিল্ড অফিসার পদে ১০ জন এবং সাইড ডেপলাবমেন্ট স্পেশিয়ালিষ্ট পদে সকলে মাসিক ৩৫/৪০ হাজার টাকার বেতনে বেআইনি ভাবে চাকুরী করছে। এনজিওটির বিভিন্ন ক্যাম্পে শিক্ষা কার্যক্রমে ৬৪জন জনবলের মধ্যে মাত্র ১৩জন বাংলাদেশী এবং বাকি ৫১ জন রোহিঙ্গা। প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবা কার্যক্রমে ১১৮জন জনবলের মধ্যে মাত্র ৯জন বাংলাদেশী আর বাকি ১০৯ই রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক পরিচালিত হলেও ওব্যাট হেলপার এনজিওটির যাবতীয় কার্যক্রম পরিচালনায় রয়েছে ঢাকার পাকিস্তানী কতিপয় বিহারী। তাদের সাথে আমেরিকা, বৃট্রেন, ফ্রান্স, মালয়েশিয়া সহ বিভিন্ন দেশের পাকিস্তানী বংশোদ্ভূত দাতারা নিয়মিত অন অ্যারাইভ্যাল ভিসা নিয়ে অবৈধ ভাবে রোহিঙ্গা ক্যাম্প গুলোতে কার্যক্রম চালাচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। এনজিওটি স্থানীয় প্রোগ্রাম ম্যানেজার হিসেবে দীর্ঘদিন বেআইনি ভাবে দায়িত্ব পালন করছে পাকিস্তানী বংশোদ্ভূত ডাক্তার ইমাদ আলী। সম্প্রতি প্রান্তিক নামের অন্য একটি এনজিওর সাথে পার্টনারশীপে কার্যক্রম চালাচ্ছে ও তাদের কর্মকান্ড নিয়ে বিভিন্ন স্পর্শকাতর অভিযোগ রয়েছে। নানা অভিযোগের প্রেক্ষিতে এনজিওটিতে সম্প্রতি উখিয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার অভিযান চালান। অভিযানকালে কর্মরত ডাক্তার, কর্মচারী ও কর্মকর্তাদের তথ্য চাইলে তারা দিতে ব্যর্থ হন এবং অনেকে চাকুরী ছেড়ে পালিয়ে গেছেন বলে উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোঃ নিকারুজ্জামান চৌধুরী জানান।
মেডিসিন স্যান্স ফ্রন্টিয়ার বা এমএসএফ (হল্যান্ড) নামের আন্তর্জাতিক দাতব্য প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে স্থানীয় লোকজন ও প্রশাসনের অনেক অভিযোগ। সংস্থাটি মূলক স্বাস্থ্য সেবার ওপর কার্যক্রম চালিয়ে থাকে। তাদের কর্মকান্ড সম্পর্কিত কোন তথ্য দিতে গড়িমশি করে থাকে বলে উখিয়ার ইউএনও সহ অনেকে জানান। তাদের হাসপাতালে কাউকে প্রবেশ করতে দেওয়া হয় না। রোহিঙ্গা ও একটি বির্তকিত মহলের লোকজনদের অধিকহারে বিভিন্ন পদে নিয়োগ দিয়ে থাকে বলে অভিযোগ এমএসএফের বিরুদ্ধে। উদ্বাস্তু রোহিঙ্গা জাকের হোসেনকে সম্প্রতি কালচারাল অফিসার পদে নিয়োগ দিয়েছে সংস্থাটি প্রায় ৪৮ হাজার টাকার বেতনে, লিয়াজোঁ অফিসার পদে সেখানে চাকুরীরত রয়েছে রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু রুহুল আমিন।
গত ৩১ জানুয়ারী প্রকল্প মেয়াদ শেষের অজুহাতে এমএসএফ অন্তত স্থানীয় বিভিন্ন পদে চাকুরীরত ৩৭ জনকে ছাঁটাই করেছে। তৎমধ্যে দুই সন্তানের জননী উখিয়ার দরগাহ বিল গ্রামের মৃত হাজী দুদু মিয়ার মেয়ে মরিয়ম বেগম। দাম্পত্য জীবনে সমস্যায় পড়ে ভাইদের কাছে দুই ছোট শিশু নিয়ে আশ্রয় থেকে সে চাকুরী করছিল। চাকুরী হারিয়ে মরিয়ম যেন খুবই মানষিক ভাবে ভেঙ্গে পড়ে পর দিন এক ফেব্রুয়ারী মানষিক চাপে ষ্টোক আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। উখিয়া কলেজের অধ্যাপক তহিদুল আলম তার ছাত্রী মরিয়মের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করে ঐ অকাল মৃত্যুর জন্য এমএসএফ (হল্যান্ড)কে দায়ী করেন।
এমএসএফ (হল্যান্ড) এ টিম লিডার পদে স্থানীয় চার জনের বিপরীতে রোহিঙ্গা চাকুরী করছে ৩২ জন। স্থানীয় ৩৩জন আউটরিচ ওয়ার্কারের বিপরীতে ঐ পদে রোহিঙ্গা চাকুরী করছে দেড় শতাধিক। স্থানীয় ৪০জন আউটরিচ টিম সুপারভাইজারের বিপরীতে রোহিঙ্গা কর্মরত রয়েছে দুইশ জনের বেশী। এমএসএফ (ফ্রান্স) এ আরো কঠিন অবস্থা স্থানীয়দের নিয়োগের ক্ষেত্রে। উক্ত এনজিওতে গার্ড পদে বাংলাদেশী ১০ জনের বিপরীতে রোহিঙ্গা নিয়োজিত রয়েছে ৩৭ জন। যাদের বেতন মাসিক ২২ হাজার টাকা। হেল্থ ওয়ার্কার পদে বাংলাদেশী কোন কর্মী না থাকলেও রোহিঙ্গা কর্মরত রয়েছে ১৮৪ জন। যাদের বেতন মাসিক ২৫-২৮ হাজার টাকা। তাদের ১২০ জন ন্যাশনাল স্টাফের অধিকাংশ কক্সবাজার জেলার বাইরের।
রিলিফ ইন্টারন্যাশনাল নামের এনজিওটিতে স্বাস্থ্যকর্মী, স্কুল ও শিশুবান্ধব কেন্দ্রের তিন শতাধিক কর্মীর মধ্যে ২৬০ জনের মত রোহিঙ্গা কর্মরত রয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে খবর পাওয়া গেছে। এ ছাড়াও ব্র্যাক, সেভ দ্যা চিলন্ড্রেন, খ্রিষ্টান এইড, প্লান ইন্টারন্যাশনাল, গনস্বাস্থ্য, গন উন্নয়ন কেন্দ্র, ডেনিস রিফিউজি কাউন্সিল, আইআরসি, এডিআরএ, ঢাকা আহসানিয়া মিশন, ইসলামিক হেল্প, ইন্টারন্যাশনাল ইসলামীক রিলিফ, ওয়াল্ড ভিশন, কারিতাশ, সহ শতাধিক দেশী-বিদেশী এনজিওতে অন্ততপক্ষে সাত হাজারের বেশী রোহিঙ্গা ও কক্সবাজার জেলার বাইরের আরও ৫হাজারের বেশী কর্মরত রয়েছে বলে স্থানীয় লোকজনের অভিযোগ।
সম্প্রতি বাংলাদেশে রোহিঙ্গা রেসপন্স এনজিও প্লাটফর্ম এক বিবৃতিতে মিথ্যাচারের আশ্রয় নিয়েছে বলে স্থানীয় ক্ষতিগ্রস্থ লোকজনের অভিযোগ। উক্ত সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে এনজিও গুলোতে কর্মরতদের অধিকাংশ কক্সবাজার জেলার অধিবাসী। ১০২টি দেশী-বিদেশী এনজিওতে মোট ১৭ হাজার ২৬৫টি পদে ১৬ হাজার ৮৪৩ জন বাংলাদেশী। তৎমধ্যে ১১ হাজার ৪০২ জন কক্সবাজার জেলার বাসিন্দা। বিদেশী কর্মরত রয়েছে ৪৪৩ জন। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সংগ্রাম কমিটির সদস্য সচিব ও পালংখালী ইউপি চেয়ারম্যান গফুর উদ্দিন চৌধুরী বলেন, সম্ভবত এনজিও গুলোতে রোহিঙ্গা যারা বেআইনি ভাবে চাকুরী করছে তাদেরও স্থানীয়দের কাতারে হিসেব করেছে। তাদের দেওয়া তথ্য মতে বিদেশী, রোহিঙ্গা ও কক্সবাজার জেলার বহিরাগতরা অবৈধভাবে রোহিঙ্গা ক্যাম্প গুলোতে চাকুরী করছে। বিদেশীদের অনেকের বৈধ সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র না থাকার দায়ে পুলিশ সহ আইন শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী কয়েক দফা অভিযান চালিয়ে দুই শতাধিক বিদেশী কর্মীদের আটক করেছিল। পরবর্তীতে মুছলেখায় মুক্তি পেলেও তাদের স্বভাব বদলাচ্ছে না বলে তিনি জানান।
উক্ত কমিটির সভাপতি অধ্যক্ষ হামিদুল হক চৌধুরী বলেন, হাজার হাজার রোহিঙ্গা ও বহিরাগতদের জন্য এনজিও গুলো প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয় না। শুধুমাত্র রোহিঙ্গাদের কারণে ক্ষতিগ্রস্থ উখিয়া ও টেকনাফে বেকার জনগোষ্ঠির ক্ষেত্রে তাদের বিভিন্ন প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ে না। এতে করে সেবা সংস্থার নামে এনজিও গুলো বিশ্ব দরবারে সরকারকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে রোহিঙ্গা সংকট দীর্ঘস্থায়ী করতে স্থানীয় ক্ষতিগ্রস্থ জনগোষ্ঠি ও আশ্রিত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠির মধ্যে বিভেদ, বিশৃংখলা সৃষ্টি করে উভয়কে মুখোমুখি করে পরিস্থিতি ভিন্নতর রূপ দেওয়র ষড়যন্ত্র করছে। তিনি সহ স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা বলেছেন মানবতাকে আশ্রয়, লালন করতে গিয়ে উখিয়া ও টেকনাফের মানুষদের পিঠ দেওয়ালে ঠেকে গেছে।
উখিয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোঃ নিকারুজ্জামান চৌধুরী বলেন, সম্প্রতি এনজিও গুলোতে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার অজুহাতে অনেক স্থানীয় ক্ষতিগ্রস্থ লোকজনদের চাকুরী থেকে ছাঁটাই করা হয়েছে। গত মাসখানেক ধরে বেকার লোকজন বিভিন্নভাবে বিভিন্ন স্থানে এনজিও গুলোর বিরুদ্ধে ক্ষোভ, বিক্ষোভ, প্রতিবাদ করে যাচ্ছে। কক্সবাজার জেলা প্রশাসক সহ উপজেলা নির্বাহী অফিসারের নিকট হাজার খানেক চাকুরী চ্যুত স্থানীয় ক্ষতিগ্রস্থ লোকজন চাকুরী ফিরে পাওয়ার আবেদন করেছেন বলে জানা গেছে। এ অবস্থায় স্থানীয় ক্ষতিগ্রস্থ জনগোষ্ঠির কর্মস্থানের পুন: ব্যবস্থা করা না হলে যে কোন সময় কোন ধরনের অপ্রীতিকর কিছু ঘটলে সংশ্লিষ্ট দেশী-বিদেশী এনজিও গুলোতে এর দায়ভার নিতে হবে বলে বেকার চাকুরীচ্যুত লোকজন হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করেছেন।