’বর্তমান সরকারের সময় পররাষ্ট্রনীতিতে বিশেষ গুরুত্ব পাচ্ছে অর্থনৈতিক কূটনীতি। উন্নয়ন সহযোগী রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে পারস্পরিক সম্পর্ক উন্নয়নের পাশাপাশি বিনিয়োগ আহরণ ও বাজার সৃষ্টির জন্য বিভিন্ন স্তরে যোগাযোগ বাড়ানোই এ কূটনীতির মূল লক্ষ্য। বাংলাদেশকে উন্নত, সমৃদ্ধ ও মর্যাদাসম্পন্ন দেশে উন্নীত করার যে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা রয়েছে, তা বাস্তবায়নে বিপুল অর্থের প্রয়োজন। এ প্রয়োজন ও বিবেচনা থেকেই অর্থনৈতিক কূটনীতির ওপর বিশেষভাবে জোর দেওয়া হচ্ছে।’ সমকালকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে এ কথা বলেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন।
১৯৪৮ থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত ভাষা আন্দোলনে সিলেট অঞ্চলের অন্যতম প্রধান সংগঠক সৈয়দা শাহার বানু চৌধুরীর সন্তান ড. এ কে আব্দুল মোমেন। তার বাবা অ্যাডভোকেট আবু আহমদ আব্দুল হাফিজও সিলেটের প্রভাবশালী রাজনীতিবিদের একজন ছিলেন। ড. এ কে আব্দুল মোমেন চাকরিজীবনের শুরুতে মুক্তিযুদ্ধের সময় মুজিবনগর সরকারের দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তী সময়ে তিনি জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি হিসেবে সাফল্যের সঙ্গে কাজ করেছেন। সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচনে তিনি সিলেট-১ থেকে এমপি নির্বাচিত হয়ে নতুন সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন। একসময় সৌদি আরবে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের অধীনে পরিচালিত প্রকল্পে অর্থনৈতিক উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী ড. মোমেন ১৯৯৮ সাল থেকেই অর্থনৈতিক কূটনীতি বিশেষজ্ঞ হিসেবে আন্তর্জাতিক মহলে পরিচিত। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়েও তিনি বাংলাদেশের জন্য এ মুহূর্তে অর্থনৈতিক কূটনীতিকেই বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে দেখছেন। সমকালের সঙ্গে আলাপে তিনি অর্থনৈতিক কূটনৈতিক তৎপরতার পরিকল্পনাসহ রোহিঙ্গা সংকট এবং আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক কূটনীতির নানা দিক নিয়েও আলাপ করেন।
অর্থনৈতিক কূটনীতির ক্ষেত্রে নিজের পরিকল্পনা তুলে ধরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সুদূরপ্রসারী নানামুখী অর্থনৈতিক রূপরেখা তুলে ধরেছেন। গত ১০ বছরে তিনি রাষ্ট্র পরিচালনার সর্বক্ষেত্রে অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করেছেন। বিশেষত, এ দেশের অসাধারণ অর্থনৈতিক অগ্রগতি বিশ্বজুড়ে প্রশংসিত হয়েছে। ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়া, ২০৩০ সালের মধ্যে জাতিসংঘের স্থিতিশীল লক্ষ্যমাত্রা অর্জন ও ২০৪১ সালের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠা বা উন্নত দেশে পরিণত হওয়ার ধারাবাহিক সুনির্দিষ্ট রূপরেখা রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা জাতির সামনে দিয়েছেন। এই রূপরেখা বাস্তবায়নে অনেক বিনিয়োগ প্রয়োজন হবে।’
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘হিসাব করে দেখা গেছে, শুধু স্থিতিশীল উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্যই আগামী ১৩ বছরে প্রয়োজন হবে প্রায় ছয় হাজার ২৩০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বা প্রায় চার কোটি ৯৮ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকার। এত টাকা কোথায় পাওয়া যাবে? সরকারের কাছে তো এত টাকা নেই। এ কারণে দরকার প্রচুর বিনিয়োগ। আর বিনিয়োগের জন্য দরকার ব্যাপক অর্থনৈতিক কূটনীতি।’
আব্দুল মোমেন জানান, সম্পদকে তিনি দু’ভাগে ভাগ করে দেখেন। যে দুটির একটি ক্যাপিটাল বা ক্যাশ টাকা, আরেকটি প্রযুক্তি। ভালো প্রযুক্তি নিশ্চিত করা গেলে অনেক কম খরচেই প্রকল্প বাস্তবায়ন সম্ভব। এখন অর্থনৈতিক চাহিদা বিবেচনায় রেখে সরকার নানাভাবে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সরকারের এই চেষ্টায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও বিশেষভাবে সম্পৃক্ত। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা দিয়ে বেশি বিনিয়োগ এবং সঠিক প্রযুক্তি নিয়ে আসার জন্য চেষ্টা করবে। বিনিয়োগের ক্ষেত্রে অন্য দেশগুলোর সঙ্গে যৌথ অংশীদারিত্ব গড়ে তুলবে। যারা বিনিয়োগ করবে, তাদের সঙ্গে সমঝোতা হবে উইন-উইন ভিত্তিতে। অর্থাৎ বিনিয়োগে শুধু বাংলাদেশেরই লাভ হবে না; যারা বিনিয়োগ করবে, তাদেরও লাভ হবে। সবাই জানেন, এ মুহূর্তে বাংলাদেশের অর্থনীতি অত্যন্ত গতিশীল। এখানে বিনিয়োগ করলে যা কিছু উৎপাদিত হবে, তার একটা স্থিতিশীল বাজারও নিশ্চিত হয়ে আছে। বাংলাদেশে লাভজনক বিনিয়োগে যৌথ অংশীদারিত্ব গড়ে তোলাই হচ্ছে অর্থনৈতিক কূটনীতি।
কোন কোন দেশকে অর্থনৈতিক কূটনীতির জন্য গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে- জানতে চাইলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘উন্নয়ন সহযোগী দেশগুলো তো বটেই, যাদের বিনিয়োগের সামর্থ্য আছে, তাদের সবার কাছেই যাওয়া হবে। এখানে বিশেষ কয়েকটি দেশকে নয়, সবাইকে গুরুত্ব দেওয়া হবে। নতুন ধরনের বিনিয়োগের ক্ষেত্র তৈরি করে সেখানে লাভজনক বিনিয়োগ নিশ্চিত করা হবে।’
তিনি বলেন, ‘অর্থনৈতিক কূটনীতির পাশাপাশি পাবলিক ডিপ্লোম্যাসি’ বা ‘জনকূটনীতির’ ওপরও গুরুত্ব দেওয়া হবে। বিভিন্ন দেশের মানুষের সঙ্গে এ দেশের মানুষের যোগাযোগ ও সম্পৃক্ততা বাড়ানোর প্রচেষ্টাই হচ্ছে জনকূটনীতি, যা অর্থনৈতিক কূটনীতির সাফল্য নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয়।
রোহিঙ্গা সংকট মোকাবেলার পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে চাইলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, এ মুহূর্তে এটি অনেক বড় একটি চ্যালেঞ্জ। এ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় যত ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব, তার সবক’টিই নেওয়া হবে। এ সংকটের সমাধান কীভাবে হবে, তা নতুন করে বলার নেই। রোহিঙ্গাদের তাদের দেশ মিয়ানমারে নিরাপদ ও সম্মানজনক প্রত্যাবাসন করতে হবে। এ লক্ষ্যে কূটনৈতিক তৎপরতা অব্যাহত আছে, যা আরও জোরদার করা হবে। তিনি বলেন, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন কবে শুরু করা সম্ভব হবে, সেটা এখনই বলা যাচ্ছে না। কিন্তু প্রত্যাশা আছে, যত দ্রুত সম্ভব রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু করতে হবে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও রোহিঙ্গা সংকটকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে দেখছে। অতএব বলা যায়, এ সংকটের স্থায়ী সমাধান নিশ্চিত করতে খুব বেশি দিন অপেক্ষা করতে হবে না।
প্রতিবেশী ও আঞ্চলিক রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে কোনো পরিবর্তন আসবে কি-না জানতে চাইলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, পররাষ্ট্রনীতি ও কূটনীতিতে বাংলাদেশের অবস্থান কী হবে, সেটা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই স্পষ্ট করে দিয়ে গেছেন। সেটা হচ্ছে- ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়।’ এটিই বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির মূলমন্ত্র। এ নীতি অনুসরণ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অনেক উঁচু মর্যাদার আসনে নিয়ে গেছেন। যার ফলাফলও চোখের সামনেই দেখা যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক পরিসরে বিভিন্ন সংস্থায় বাংলাদেশ এখন নেতৃত্বের অবস্থানে রয়েছে। বঙ্গবন্ধুর নীতি এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দক্ষ নেতৃত্বের কারণেই এ সাফল্য অর্জন করা গেছে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মোমেন সমকালকে বলেন, প্রতিবেশী এবং আঞ্চলিক রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষার ক্ষেত্রেও বঙ্গবন্ধুর পররাষ্ট্রনীতিই অনুসরণ করা হচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও করা হবে। প্রতিবেশী ও আঞ্চলিক রাষ্ট্র- সবার সঙ্গে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক অত্যন্ত চমৎকার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সালে ভারতের সঙ্গে ঐতিহাসিক গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি করেছিলেন। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর তিনি অসাধারণ দক্ষতার সঙ্গে স্থলসীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়ন করেছেন। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক এখন অনন্য উচ্চতায় পৌঁছেছে। অন্যান্য প্রতিবেশী ও আঞ্চলিক রাষ্ট্রের সঙ্গেও সম্পর্ক আগের চেয়ে বহু গুণ উন্নত হয়েছে। আঞ্চলিক কূটনীতিতে বাংলাদেশের অবস্থানকে এখন সবাই মর্যাদা ও গুরুত্বের দৃষ্টিতে দেখে। দেশের এ অবস্থানকে আরও জোরদার করাই হবে আঞ্চলিক কূটনীতির মূল লক্ষ্য।