::নিজস্ব প্রতিবেদক::
এবারের বিশ্ব ইজতেমা একদিন বাড়িয়ে চারদিন ধরে অনুষ্ঠিত হবে বলে জানিয়েছেন ধর্ম প্রতিমন্ত্রী শেখ মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ। সচিবালয়ে তাবলীগ জামাতের দুইপক্ষের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক শেষে ধর্ম প্রতিমন্ত্রী সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান।
ধর্ম প্রতিমন্ত্রী বলেন, গত ৩ ফেব্রুয়ারি মিটিংয়ে তাবলীগ জামাতের দুইপক্ষের সঙ্গে প্রথমদফা বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় ইজতেমা ১৫, ১৬ ও ১৭ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত হবে। আজ দ্বিতীয় দফা আলোচনায় উভয়পক্ষের মতামতের ভিত্তিতে ৩ দিনের স্থলে ৪ দিন হওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
সব জল্পনা কল্পনার অবশান ঘটিয়ে আগামী ১৫ ও১৬ ফেব্রুয়ারী ও ১৭ ও ১৮ ফেব্রুয়ারী দুই পর্বেই হচ্ছে আসন্ন বিশ্ব ইজতেমা। প্রথম পর্ব পাকিস্থান আলমী শুরাপন্থীরা (মাওলানা জুবায়ের) পরিচালনা করবেন আর দ্বিতীয় পর্ব তাবলীগের মূলধারার মুসল্লীরা (সৈয়দ ওয়াসিফ ইসলাম) পরিচালনা করবেন।
আলাদা আলাদা ইজতেমা হওয়ায় জায়গা সংকুলনসহ যাবতীয় জটিলতা সমাধান হল। একই সাথে বিবাদমান দুপক্ষের বিশ্ব ইজতেমা নিয়ে দেশজুড়ে ছিল চরম উৎকন্ঠা।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বারবার একত্রে বিশ্ব ইজতেমা করার ব্যাপারে দৃঢ় প্রত্যায় প্রকাশ করলেও তাবলীগের মুরুব্বীরা বলে আসছিলেন, নিজামুদ্দিন বিশ্ব মারকাজের মুরুব্বীদের একক নিয়ন্ত্রণ ছাড়া বিশ্ব ইজতেমা করলে বিশ্বব্যাপি তাবলীগের কাজ ক্ষতিগ্রস্ত হবে, বিদেশী মুসল্লীরা বিশ্ব মারকাজ ও বিশ্ব আমীর ছাড়া ব্যাপকভাবে ইজতেমায় অংশ গ্রহন করবে না। এতে করে মূলত বাংলাদেশ ও সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হবে আর বাংলাদেশ থেকে বিশ্ব ইজতেমার ক্ষমতা খর্ব করা ও ঐতিহ্য বিনষ্ট হতে পারে।
গত মঙ্গলবার ধর্মমন্ত্রনালয়ের সভাক্ষকে ধর্মপ্রতিমন্ত্রী শেখ মোহাম্মদ আব্দুল্লাহর সভাপতিত্বে এক বৈঠকে দুই পর্বে আলাদা বিশ্ব ইজতেমার সিদ্ধান্ত গৃহিত হয়। এসময় কাকরাইলের আহলে শূরা তাবলীগের শীর্ষ মুরুব্বী সৈয়দ ওয়াসিফুল ইসলাম, খান শাহাবুদ্দীন নাসিম, মাওলানা জুবায়ের ও মাওলানা উমর ফারুক উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে হেফাজতসহ তৃতীয়পক্ষের কোন মুরুব্বী উপস্থিত ছিলেন না। অনেকেই মনে করছেন, তৃতীয়পক্ষকে বাদ দিয়ে বসার কারণেই সুন্দর সমাধান তাবলিগের দুপক্ষ সরকারকে নিয়ে বসে করতে সক্ষম হয়েছে।
কয়েক লাখ লোকের জমায়েতের কারণে বিশ্ব ইজতেমাকে মুসলমানদের দ্বিতীয় বৃহত্তম সম্মিলন বলা হয়। প্রতিবছর জানুয়ারি মাসে টঙ্গীতে বিশ্ব ইজতেমার আয়োজন হলেও তাবলিগ জামাতের নেতৃত্বের দ্বন্দ্বে এবার তা স্থগিত হয়ে যায়। এ পরিস্থিতিতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল সম্প্রতি দুই পক্ষের ‘মুরুব্বিদের’ নিয়ে বৈঠক করে এ অচলাবস্থার নিরসন করেন।
তাবলিগের এক সূত্রে জানা যায়, উপমহাদেশে সুন্নি মতাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় সংঘ তাবলিগ জামাতের মূলকেন্দ্র ভারতের দিল্লিতে। মাওলানা সাদের দাদা ভারতের ইসলামী পন্ডিত মাওলানা ইলিয়াছ কান্ধলভি (রহ:) ১৯২০ এর দশকে তাবলিগ জামাত নামের এই সংস্কারবাদী আন্দোলনের সূচনা করেন।
মাওলানা ইলিয়াছ (রহ:)’র মৃত্যুর পর তার ছেলে মাওলানা মোহাম্মদ ইউসুফ এবং তারপর মাওলানা ইনামুল হাসান তাবলিগ জামাতের আমিরের দায়িত্ব পালন করেন। মাওলানা ইনামুলের মৃত্যুর পর একক আমিরের বদলে সাংগঠনিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভার দেওয়া হয় একটি শুরা কমিটির উপর।
মাওলানা জুবায়েরের মৃত্যুর পর মাওলানা সাদ কান্ধলভি আমিরের দায়িত্ব নেন এবং একক নেতৃত্বের নিয়ম ফিরিয়ে আনেন। কিন্তু মাওলানা জুবায়েরের ছেলে মাওলানা জুহাইরুল হাসান তখন নেতৃত্বের দাবি নিয়ে সামনে আসেন এবং তার সমর্থকরা নতুন করে শুরা কমিটি গঠনের দাবি জানান। কিন্তু এদাবি গৃহিত না হলে বিরোধ বড় আকার ধারণ করে।
অন্য আরেক সূত্রে জানা যায়, তাবলিগের এই চলমান বিরোধিতার মূল নেপথ্যের কারণ সম্পর্কে অনেকেরই অজানা, পাকিস্তানের মৌলভি ফাহিমের নেতৃত্বে ২০১৫ সালে পাকিস্তান ইজতেমার সময় কথিত আলমি শুরার নাম ব্যবহার করে নিজামুদ্দিন মারকাজের ভেতরে স্বার্থান্নেষী ক্ষুদ্র একটি গ্রুপকে ব্যবহার করে তাবলিগের বিশ্ব আমিরকে সরানোর চেষ্টা হয়। ভারতসহ মুসলিম বিশ্বে এরা পুরোপুরিই ব্যর্থ হয়ে শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশে ক্বারি জুবায়ের ও তার কতিপয় বন্ধুকে ব্যবহার করে বাংলাদেশে পাকিস্তানপন্থি কিছু আলেমকে সামনে নিয়ে বিশ্ব ইজতেমা বানচালের সুগভীর ষড়যন্ত্রের মিশন বাস্তবায়ন করেন ড. আব্দুল আউয়াল। প্রথমে কোনো সুবিধা না করে দেওবন্দের কাছে মাওলানা সা’দ কান্ধলভী সাতটি বয়ানকে কাটছিঁট করে ফতোয়া চাওয়া হয়। দেওবন্দ এ বিষয়ে তার মতামত জানতে চাইলে তিনি এর ব্যাখ্যা দেন। পরে একটি বিষয়ে দেওবন্দ আপত্তি করলে তিনি প্রকাশ্যে তা প্রত্যাহার করে নেন। কিন্তু বিরোধীরা নতুন চাল খেলতে থাকে এবং তাবলিগে বিভক্তির চেষ্টা করলে দেওবন্দ স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেয় যে, তার কোনো পক্ষের সঙ্গে নেই।
মূলত ২০১৬-এর শেষের দিকে পাকিস্তানের রায়বেন্ড মারকাজের মুরুব্বি মৌলভি ফাহিমের প্রচেষ্টায় আনুষ্ঠানিকভাবে তাবলিগ নিয়ে ফিৎনা শুরু হলেও দেওবন্দের দোহাই দিয়েই বাংলাদেশর কিছু আলেম সরাসরি পাকিস্তানের প্রস্তাবিত আলমি শুরার পক্ষে চলে যান। পাকিস্তান ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর থেকে তাবলিগের বিশ্ব মারকাজ দিল্লির নিজামুদ্দিন মারকাজের নেতৃত্ব মেনে নিতে পারছিল না। তারা বিশ্ব মারকাজ ও বিশ্ব ইজতেমাকে সারা দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন করে এর ক্ষমতা খর্ব করা ও সরিয়ে নেওয়ার ষড়যন্ত্র হয়ে আসছিল।
ইসরায়েলি ষড়যন্ত্রে পাকিস্তানের মৌলভি ফাহিম আমেরিকাতে বসে বাঙালি ড.আউয়াল, ইহুদি লবির শক্তিশালী এজেন্ট তার ঘনিষ্ঠ দুই বন্ধু আব্বাস প্যাটেল, সাবের কাপাডিয়াকে নিয়ে, তাবলিগ নিয়ে চলমান সংকট তৈরির মাষ্টার প্লেন তৈরি করেন। তাবলিগ নিয়ে আন্তর্জাতিক মোসাদ, আইএসআইসহ নানা গোয়েন্দা সংস্থার ষড়যন্ত্রের ভয়ংকর তথ্য বেরিয়ে এসেছে নানা সময়।
কীভাবে বিভিন্ন বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থা ও এজেন্টদের সরাসরি হস্তক্ষেপে বাংলাদেশে তাবলিগ বিরোধী আন্দোলন ও ধর্মীয় সংঘ নীলনকশা তৈরি করা হয়। বাংলাদেশের কয়েকজন ইসলামী ডাকসাইটে পাকিস্তানপন্থি নেতাকে হাত করে বাংলাদেশে জমহুর নামক একটি আন্দোলনের জন্ম দেন। আমেরিকা থেকে ড. আউয়াল এ বিষয়ে ঘন ঘন পাকিস্তান সফর করেন। নানা সূত্রে জানা যায়, বেশ কয়েকবার আব্বাস প্যাটেল, সাবের কাপাডিয়া ও আব্দুল আউয়ালের সঙ্গে পাকিস্তানে বাংলাদেশের মাওলানা উমর ফারুক, মাওলানা আব্দুল মতিন, উবায়দুল্লাহ ফারুকদের বৈঠক হয় আইএসআইর মধ্যস্থতায়। তাদের পাসপোর্ট চেক করলেই প্রশাসনের কাছে এসব তথ্য স্পষ্ট হয়ে উঠবে।
অপরদিকে মিশরের নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন ইখওয়ানুল মুসলিমিনের বাংলাদেশের এজেন্ট হিসেবে জেলখাটা উত্তরার খতিব এক বাদ্রারহুড নেতা ও মাওলানা শাহরিয়ারকে ব্যবহার করে ওজাহাতি ফান্ডিং আমেরিকা ও পাকিস্তান থেকে আসতে থাকে। তাদের সাথে ঢাকার মোহাম্মদপুরের অর্থলোভী দুই সহোদর সাহেবজাদা সংযুক্ত হয়ে মাঠে নামেন। মোটা অংকের টাকা দিয়ে খরিদ করা হয় চট্টগ্রামের এক সাহেবজাদাকে। এভাবে গড়ে তুলা হয় পাকিস্তানি চক্রান্তে বাংলাদেশে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক সংঘাত তৈরির নীল নকশা।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সরাসরি হস্তক্ষেপে দুই পর্বের ইজতেমা ও তাবলিগের বিবদমান দুপক্ষের যার যার কাজ স্বতন্ত্রভাবে করতে পারাই মূলত বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রতি বজায় থাকার উত্তমপন্থা। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার বিচক্ষণতা ও দূরদর্শী নেতৃত্বে বাংলাদেশ সকল চক্রান্ত মোকাবিলা করে ধর্মীয় সম্প্রীতি ও সকল সহিংসতা এড়িয়ে সবাইকে নিয়ে এগিয়ে যাবে বহু দূর বলে মনে করেন এদেশের ইসলামি চিন্তাবিদগন।