শারদ বিকেলে সাদা কাশফুলগুলো উড়ছে বাতাসে…

নাগরিক কোলাহল আর যাপিত জীবনের নানা ব্যস্ততার মাঝে বেশ গোপনেই এসেছে শরৎ। এ ঋতু আসেও যেমন চুপিসারে; আবার হারিয়ে যায় বেশ দ্রুতই। শরৎ মানেই নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা এবং কাশফুলের শুভ্রতা। শরৎ আসলে এমনই, স্নিগ্ধতার আবেশ ছড়িয়ে স্মৃতিতে দোলা দেয়।

শরৎকাল মানেই শুভ্রতা। শরৎ মানেই কাশফুলের সাদা হাসি। শরৎ ঋতুর কথা মনে এলেই আমাদের চোখের কোণে ভেসে উঠে ফুটন্ত সাদা কাশফুল, পাল তোলা নৌকার সারি, দূর আকাশের কোণে জমে থাকা ধূসর সাদা মেঘের ভেলার কথা। কখনো মিষ্টি রোদে আলোর খেলা আবার কখনো হঠাৎ বৃষ্টির হানা। মাঝে সাজেই দেখা যায় রৌদ্র মেঘের লোকুচুরি খেলা।

শারদ বিকেলে একগুচ্ছ কাশফুল স্নিগ্ধতার পরশ বুলিয়ে যায়, হাতের স্পর্শ পৌঁছে যায় হৃদয়ে … শরতের কাশফুল অগোচরে হৃদয়ে দোলা দিয়ে যায় তরুণ তরুণীর মনে। শারদীয় বিকেলগুলো শুধু কাশফুলের জন্যই হয়ে ওঠে মনোরম। তাইতো শরতের বিকেলে রোদ-বৃষ্টির লুকোচুরি উপেক্ষা করে শহুরে যান্ত্রিক পরিবেশকে পেছনে ফেলে প্রকৃতির কাছ থেকে একটু প্রশান্তি পেতে প্রায়ই কাশবনে ছুটে আসেন বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ। নীল আকাশে নরম তুলার মতো, শুভ্র মেঘের ভেলায় চড়ে , ধবধবে সাদা বিস্তীর্ণ কাশবনে হারিয়ে যেতে কার না ভালো লাগে। নাগরিক ব্যাস্ত জীবন আর কোলাহলময় যান্ত্রিক জীবন থেকে কিছুক্ষণের জন্য হলেও কাশফুলে ঘেরা অদ্ভুত নজরকাঁড়া স্নিগ্ধ পরিবেশ এনে দিবে প্রশান্তির ছোঁয়া।

চট্টগ্রাম শহরের কাছেই অক্সিজেন-কুরাইশ সংযোগ সড়কে অন্যন্যা আবাসিকের বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে সারি সারি শুভ্র কাশফুল যেন শুভ্রতার মেলা বসিয়েছে। দূর থেকে দেখলে মনে হবে শিল্পীর তুলিতে আঁকা কোন ছবি। প্রকৃতির নিজ হাতে গড়ে তোলা এ জীবন্ত দেখতে ভিড় লেগেই থাকে প্রতিদিন।  নানা শ্রেণী পেশার মানুষ, নারী- শিশু, স্কুল কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের পদভারে মুখরিত হয়ে উঠে পুরো প্রান্তর। ভ্রমন পিপুসুদের জন্য পসরা সাজিয়ে বসে আইসক্রিম, চটপটি-ফুচকা,ঝাল মুড়িসহ নানা ভ্রম্যমান দোকানি। আছে ঘোড়াগাড়ি চড়ে কাশবনের মাঝে ছুটে চলার ব্যবস্থাও…

বিশেষ করে শুক্রবার, শনিবার ও ছুটির দিন গুলিতে দর্শনার্থীদের উপচে পড়া ভিড় লক্ষ করা যায়। এখানে এলে দেখা যায় অনেকেই মুঠোফোন সেলফি তোলে ব্যাস্ত সময় পার করছে। তরুণীরা খোঁপায় কাশফুল গেঁথে ছবি তুলছে। এখানকার নীল আকশ আর বিস্তীর্ণ মাঠ জুড়ে শারদ বিকেলে সাদা কাশফুলগুলো উড়ছে বাতাসে… সাদা কাশবনে বাউরী বাতাসের দোল খাওয়ার নয়নাভিরাম দৃশ্য দেখে মন হারিয়ে যায় রুপের মায়ায়।

দূর থেকে কাশের বনে তাকালে মনে হয়, শরতের পেঁজা পেঁজা সাদা মেঘ যেন নেমে এসেছে ধরণির বুকে। একটু বাতাস পেয়ে দলে দলে কাশফুল যখন এদিক-ওদিক মাথা নাড়ায়, তখন মুগ্ধ না হয়ে উপায় নেই।
ছুটে আসা প্রকৃতি প্রেমিকদের দৃষ্টি জুড়ে অপলক মোহময়তা…

“আজি কি তোমার মধুর মূরতি  হেরিনু শারদ প্রভাতে!

হে মাত বঙ্গ, শ্যামল অঙ্গ  ঝলিছে অমল শোভাতে।

পারে না বহিতে নদী জলধার,

মাঠে মাঠে ধান ধরে নাকো আর- ডাকিছে দোয়েল গাহিছে কোয়েল   তোমার কাননসভাতে!

মাঝখানে তুমি দাঁড়ায়ে জননী,  শরৎকালের প্রভাতে।”

কার মন ছুয়ে না যায়? দিশেহারা হয়ে ছুটে যায় মন কোথায় আছে এমন ধবল সাদা কাশবন?

রোমানিয়ার আদি নিবাসী কাশফুল বেশ প্রাচীনকাল থেকেই বাংলাদেশে শুভ্রতা ছড়িয়ে আসছে। কাশফুল মূলত ছন গোত্রীয় একধরনের ঘাস। ঘাসজাতীয় উদ্ভিদটি উচ্চতায় সাধারণত ৩ মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়। গাছটির চিরল পাতার দুই পাশ বেশ ধারালো। নদীর ধার, জলাভূমি, চরাঞ্চল, শুকনো এলাকা, পাহাড় কিংবা গ্রামের কোনো উঁচু জায়গায় কাশের ঝাড় বেড়ে ওঠে। তবে নদীর তীরেই এদের বেশি জন্মাতে দেখা যায়। নদীর তীরে পলিমাটির আস্তর থাকে। এই মাটিতে কাশের মূল সহজে সম্প্রসারিত হতে পারে। বাংলাদেশের সব অঞ্চলেই কাশফুল দেখতে পাওয়া যায়।
কাশফুলের বেশ কিছু ওষধি গুণ রয়েছে। যেমন- পিত্তথলিতে পাথর হলে নিয়মিত গাছের মূলসহ অন্যান্য উপাদান দিয়ে ওষুধ তৈরি করে পান করলে পিত্তথলির পাথর দূর হয়। কাশমূল বেটে চন্দনের মতো নিয়মিত গায়ে মাখলে গায়ের দুর্গন্ধ দূর হয়। এ ছাড়াও শরীরে ব্যথানাশক ফোঁড়ার চিকিৎসায় কাশের মূল ব্যবহৃত হয়। কাশফুল আগাছা হিসেবে বিবেচিত হলেও শুকনো কাশগাছ খুব কাজের জিনিস। তাই এর বহুবিধ ব্যবহার রয়েছে।

চারাগাছ একটু বড় হলেই এর কিছু অংশ কেটে গরু-মহিষের খাদ্য হিসাবে ব্যবহার করা যায়। কাশ দিয়ে গ্রামের বধূরা ঝাঁটা, ডালি, মাদুর তৈরি করে থাকে। ঘরের চাল, বাড়ির সীমানার বেড়া ও কৃষকের মাথাল তৈরিতেও কাশগাছ ব্যবহার করা হয়। গ্রামবাংলায় বিশ্বাস করা হয়, কাশফুল মনের কালিমা দূর করে। তাই শুভ কাজে কাশফুলের পাতা বা ফুল ব্যবহার করা হয়।

বর্ষা ঋতুকে বিদায় জানিয়ে নীল আকাশের সাদা তুলোর মতো মেঘের সঙ্গে কাশফুলের মৃদু বাতাসে আন্দোলন প্রকৃতিতে ছড়ায় মুগ্ধতা। নীল আকাশের নিচে সাদা কাশফুল যখন বাতাসের দোলায় দুলতে থাকে, তখন মনে হয় শ্বেতবসনা একঝাঁক নৃত্যশিল্পী নৃত্য করছে। পালকের মতো নরম ও ধবধবে সাদা রঙের কাশফুল মনের কোমলতা জাগিয়ে তোলে…

গণমাধ্যমকর্মী ও প্রকৃতি প্রেমি মির্জা ইমতিয়াজ শাওনকে সাথে নিয়ে কশফুলের মাঠ থেকে জাহেদ কায়সার