সৌন্দর্যের লীলাভূমি ন’কাটা ও মুপ্পোছড়া ঝর্ণা

মোঃ নজরুল ইসলাম লাভলু, কাপ্তাই।
চাকমা ভাষায় ন” কাবাছড়া ঝর্ণা আবার কেউ বলে ন” কাটাছড়া ঝর্ণা। যে যেই নামেই ডাকুক না কেন, ঝর্ণা হতে নিঃস্বরিত জলতরঙ্গ বাদ্য যন্ত্রের রিনিঝিনি নুপুরের ধ্বনি যেন সহশ্র ধারার শ্রুতিমাধুর্যে মানুষকে মুগ্ধ করছে। এর রূপ, রস, মাধুরী প্রকৃতির শোভাবর্ধন করছে, ধরিত্রীকে করছে সুশীতল। অনুপম রূপসজ্জায় সজ্জিত এই ঝর্ণার সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে যে কেউ হারিয়ে যাবে কল্পনার রাজ্যে, ঝর্ণার হিমশীতল জলে ভিজে দেহ মনকে আন্দোলিত করবে।
রাঙামাটি জেলার বিলাইছড়ি উপজেলার ২ নং কেংড়াছড়ি ইউনিয়নের ৯ নং ওয়ার্ডের বাঙ্গালকাটা এলাকায় এই ন”কাটাছড়া ঝর্ণা অবস্থিত। এর কিছুদূর পথ পাড়ি দিতেই দেখা মিলবে আরো একটি ঝর্ণা। মোপ্পাছড়া ঝর্ণা নামে এটি ৩শ’ ফুট “পরি হলা মৌন” পাহাড়ের উপর হতে ঝিরিঝিরি শব্দে তার অপূর্ব সুরের মোর্ছনা শুনিয়ে যাচ্ছে তার সুরধ্বনি।
পর্যটকদের কাছে এই দুটি ঝর্ণা এখন স্বপ্নরাজ্যে পরিণত হয়েছে। বর্ষাকালে ঝর্ণা দুটি নবযৌবন লাভ করে।
“ওই আসে এই অতি ভৈরব হরষে/ জলসিঞ্চিত ক্ষিতিসৌরভ রসে/ ঘনগৌরবে নবযৌবনা বরষা/ শ্যাম গম্ভীর সরসা। কবির এই পঙক্তি গুলো যেনো ন”কাটাছড়া ঝর্ণা আর মোপ্পাছড়া ঝর্ণার সৌন্দর্যের সাথে মিলে যায়। প্রায় ২শ’ ফুট উপর থেকে ন”কাটাছড়া ঝর্ণার পানি প্রবাহিত হচ্ছে। এই ঝর্ণা দু’টির জলধারা মিশে গেছে কাপ্তাই হ্রদের নীল জল রাশিতে।
এই ঝর্ণা গুলোর নামকরণ নিয়ে রয়েছে কিংব্যদন্তি। যেখানে লুকিয়ে আছে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর জীবনাচরণ আর দুঃখের গল্প কথা। স্থানীয় বাঙ্গালকাটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক তপন কুমার চাকমা জানালেন কিংব্যদন্তির সেই মর্মান্তিক কথা।
শত বছর আগে ওই এলাকার মোপ্পু মারমা নামে এক যুবক “পরি হলা মৌন” পাহাড়ের চুড়ায় মাছ এবং বেঙাচি ধরতে যায়। জঙ্গলের এক ধরণের শক্ত লতা কোমরে বেঁধে মাছ আর বেঙাচি ধরতে গিয়ে লতাটি ছিড়ে নিচে পড়ে সে মারা যায়। তখন থেকে এই মোপ্পু মারমার নামানুসারে স্থানীয়রা এই ঝর্ণার নাম রাখেন মোপ্পাছড়া ঝর্ণা।
মোপ্পাছড়া ঝর্ণার ৩শ’ প্রায় ফুট উপর “পরি হলা মৌন” পাহাড়। কথিত আছে, ৫০ বছর আগে অমাবস্যা পূর্নিমা রাতে এই পাহাড়ে পরিদের নাচ গানের আওয়াজ শোনা যেতো। তাই স্থানীয়রা একে “পরি হলা মৌন ” পাহাড় নামে ডাকে। পাহাড়ের উপরে দু’টি সমতল মাঠ আছে। ৪৫টি চাকমা পরিবারের বসবাস এই পাহাড়ে।
আর ন”কাটাছড়া ঝর্ণা বা ন”কাবা ছড়া ঝর্ণার নামকরণ নিয়েও একটি ইতিহাস আছে। স্থানীয় এক লোক একটি বড় গাছ কেটে একটি নৌকা তৈরী করেন। এরপর হতে এই ঝর্ণার নাম ন”কাবা ছড়া ঝর্ণা নামে পরিচিতি পায়।
রাঙামাটি জেলা কিংবা কাপ্তাই উপজেলা হতে স্পীড বোট বা ইঞ্জিন চালিত বোটে কাপ্তাই হ্রদ পাড়ি দিয়ে অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি
বিলাইছড়ি উপজেলার দেখা মিলে। দূরে শ্যামল গ্রাম, পাহাড়, আদিগন্ত জল বিস্তারে শস্য-শিশুর নৃত্য, আকাশে কৃষ্ণ ধূসর মেঘবিন্যাস, দিগন্ত বিলাসী বক-পক্ষীর নিরুদ্দেশ যাত্রা, সবই যেন বিলাইছড়ি উপজেলার আনাচে-কানাচে লুকিয়ে আছে। বিলাইছড়ি সদর থেকে নলছড়ি ঘাট কিংবা উপজেলা সদর হাসপাতাল ঘাট হতে নৌপথে ২০ মিনিট পাড়ি দিয়ে বাঙ্গালকাটা ঢেবার মাথায় পৌঁছাতে হয়। পথিমধ্যে কাপ্তাই হ্রদের দু’পাড়ে দৃষ্টিনন্দন পাহাড়ি গ্রাম আর বৈচিত্র্যময় উপজাতিয়দের জীবনধারা উপভোগ করতে পারবেন।
ঢেবার মাথা থেকে পায়ে হেঁটে ন”কাটা ছড়া আর সবুজ ক্ষেত্র পাড়ি দিয়ে প্রায় ৩০ মিনিট পর প্রথমে চোখে পড়বে ন”কাটাছড়া ঝর্ণা। এরপর একই পথ ধরে একটি ছোট পাহাড় ডিঙিয়ে মোপ্পাছড়া পার হয়ে আরো কিছুদূর পার হলেই মোপ্পাছড়া ঝর্ণার দেখা মিলবে।
পাশাপাশি দুটি ঝর্ণার সৌন্দর্য উপভোগ করতে বর্ষা মৌসুমে এখানে পর্যটকদের ঢল নামে। তবে ঢেবার মাথা থেকে ঝর্ণা পর্যন্ত চলাচলের রাস্তা বেশ নাজুক হওয়ায় পর্যটকদের আসতে খানিকটা দূর্ভোগ পোহাতে হয়।
১২৭ নং কেরনছড়ি মৌজা এবং ন”কাবা ছড়া ভিজিএফ কমিউনিটি বেইজড ইকো-ট্যুরিজম পরিচালনা কমিটির সভাপতি সুনিক জ্যোতি তালুকদার জানান, ১৯ জন ভিজিএফ পরিচালনা কমিটি এবং ১১ জন উপদেষ্টা কমিটির তত্ত্বাবধানে এই দুইটি ঝর্ণা পরিচালিত হয়। এখানে প্রতি সপ্তাহে গড়ে ৩ শতাধিক পর্যটক আসে।
৯ নং বাঙ্গালকাটা ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য হলধর চাকমা জানান, এই এলাকায় ২শ’ চাকমা ও মারমা পরিবারের বসবাস। কৃষি আর জুম চাষের উপর তাদের জীবন নির্ভরশীল। এখানে আসার পথটুকু যদি সংস্কার হয়, তাহলে এই এলাকায় প্রচুর পর্যটক আসবে।
২ নং কেংড়াছড়ি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান অমরজীব চাকমা জানান, এই এলাকার ঝর্ণা দু’টি দেখতে খুব সুন্দর, তবে এখানকার যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটলে এখানকার জনগণের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ঘটবে।
বিলাইছড়ি উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোঃ মিজানুর রহমান বলেন, দেশের সবচেয়ে সুন্দর উপজেলা বিলাইছড়ি। এই উপজেলায় যতগুলো ঝর্ণা রয়েছে দেশের আর কোন উপজেলায় নেই। এই ঝর্ণার সৌন্দর্য সকলকে মুগ্ধ করবে। প্রকৃতির এই সৌন্দর্যকে কাজে লাগিয়ে তারা এলাকাবাসীর উন্নয়ন ঘটাতে চায়।’ তিনি আরো জানান, বিলাইছড়ি উপজেলা সদর হতে বাঙ্গালকাটা ঢেবার মাথা পর্যন্ত ২ টি গার্ডার ব্রিজ নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহন করা হয়েছে। এই ব্রিজ ২ টি নির্মিত হলে বিলাইছড়ি সদর হতে চাঁদের গাড়ীতে ঝর্ণার কাছাকাছি যাওয়া সম্ভব হবে।
বিলাইছড়ি উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান বীরোত্তম তঞ্চঙ্গ্যা ও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান উৎপলা চাকমা জানান, বিলাইছড়ির অপরূপ ঝর্ণাগুলোর সৌন্দর্যকে কাজে লাগিয়ে স্থানীয় অধিবাসীদের সম্পৃক্ত করে ইকো -ট্যুরিজম গড়ে তুললে তারা স্বাবলম্বী হবে। তারা জীববৈচিত্র্য এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের ভারসাম্য রক্ষা করে যাতে পর্যটকরা আসে, সেজন্য সকলের প্রতি তারা অনুরোধ জানান।
ঝর্ণা দেখতে আসা পর্যটকরা তাদের অনুভূতি ব্যক্ত করতে গিয়ে বলেন, পর্যটকদের জন্য যেনো ঝর্ণাগুলো সাজিয়ে রাখা হয়েছে। ঝর্ণাগুলো দেখতে খুবই সুন্দর। বিলাইছড়ি উপজেলার এই ঝর্ণা দেখতে অনেকেই আগেরদিন এসে রাত্রি যাপন করেন উপজেলা সদরে। বিলাইছড়ি উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে পাহাড়ের চুড়ায় নির্মাণ করা হয়েছে নীলাদ্রি রিসোর্ট। এখানে ৪ টি কটেজ রয়েছে। কটেজ
দু’টার নামকরণ করা হয়েছে মোপ্পাছড়া আর ধুপপানি ঝর্ণার নামে। এবং বাকি ২ টার নামকরণ করা হয়েছে রাইংখং নদী ও পুকুরপাড়া নামে। এই কটেজের করিডোরে বসে দূরপাহাড়ের মেঘ বৃষ্টির লুকোচুরি খেলা মূহুর্তে আপনাকে নিয়ে যাবে কল্পলোকে। আর কটেজ সংলগ্ন উপজেলা ক্যাফেতে উন্নত মানের খাবারের ব্যবস্থাও রয়েছে।