পরকীয়ার কাঁটা দূর করতেই ইভানাকে হত্যা করে স্বামী

স্কলাসটিকার ক্যারিয়ার গাইডেন্স কাউন্সিলর ইভানা লায়লা চৌধুরীর মৃত্যুর ঘটনায় রাজধানীর শাহবাগ থানায় লিখিত অভিযোগ করা হয়েছে। শুক্রবার সন্ধ্যায় ইভানার বাবা এএসএম আমান উল্লাহ চৌধুরী এ অভিযোগ করেন। শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মওদুদ হাওলাদার জানিয়েছেন, অভিযোগটি গ্রহণ করা হয়েছে।
অভিযোগপত্রে ইভানার মৃত্যুর ঘটনায় তার স্বামী ব্যারিস্টার আবদুল্লাহ মাহমুদ হাসান, তার প্রেমিকা ব্যারিস্টার সানজানা ইয়াসিন খান ও অধ্যাপক ডা. মুজিবুল হক জড়িত বলে উল্লেখ করা হয়েছে। বিয়ের পর থেকেই ইভানাকে তার স্বামী শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করতেন। কিছুদিন আগে ইভানা জানতে পারেন, তার স্বামী ব্যারিস্টার সানজানা ইয়াসিন খানের সঙ্গে পরকীয়ায় লিপ্ত । এতে ক্ষুব্ধ হয়ে পরকীয়া সম্পর্ক নির্বিঘ্ন করার জন্য পথের কাঁটা দূর করতে ইভানাকে তার স্বামী পরিকল্পিতভাবে হত্যা করে বলে অভিযোগপত্রে উল্লেখ করেন পিতা আমান উল্লাহ চৌধুরী ।
অভিযোগপত্রে তিনি উল্লেখ করেন, গত ২০১১ সালে আমার সর্বকনিষ্ঠ কন্যা ইভানা লায়লা চৌধুরী (৩২) এর সঙ্গে আবদুল্লাহ মাহমুদ হাসান (৪২) (রুম্মান) এর বিবাহ হয়। পরবর্তীতে তাদের দুজন পুত্রসন্তান আরমান (৮) এবং আয়মান (৬) এর জন্ম হয়।
ইভানা পরবর্তীতে স্কলাস্টিকায় ক্যারিয়ার গাইডেন্স কাউন্সিলর হিসেবে কাজ শুরু করে।
কিন্তু সেখানে রুম্মান তাঁকে বাধা দেয় এই বলে যে, ইভানার একমাত্র কাজ সন্তানদের দেখাশোনা করা। রুম্মান জোর করে ইভানাকে স্কলাস্টিকার ‘ফুল টাইম’ কাজ থেকে ‘পার্ট টাইম’ কাজ নিতে বাধ্য করে।
ইভানা তাঁর সন্তানদের খুবই ভালোবাসতো এবং তার সন্তানদের জন্য যে কোন ত্যাগ স্বীকার করতে দ্বিধা করতো না। আমি সম্প্রতি জানতে পারি, বিয়ের শুরু থেকেই রুম্মান ইভানাকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করত। কিছুদিন আগে ইভানা জানতে পারে যে, রুম্মান আরেকজন বিবাহিত মহিলা ব্যারিস্টার সানজানা ইয়াসিন খানের সঙ্গে পরকীয়া প্রেমে লিপ্ত। সে নিজে রুম্মানের ফোনে হোয়াটস আপে সানজানার সঙ্গে প্রেমালাপ এর প্রমাণ পায় এবং তার স্ক্রিনশট তুলে তার বন্ধু এবং শুভানুধ্যায়ীদের কাছে মেসেঞ্জারে পাঠায়। ইভানা সেখানে আরো জানায় যে, বেশ কিছুদিন ধরে রুম্মান ইভানাকে ঘুমের ওষুধ খাওয়াচ্ছিলো যাতে রুম্মান নির্বিঘেœ ইভানাকে লুকিয়ে সানজানার সঙ্গে ফোনে প্রেমালাপ করতে পারে।
গত ১৩ই সেপ্টেম্বর ইভানা আমাকে রুম্মানের পরকীয়া সম্পর্কের বিষয়ে জানায়। ১৪ই সেপ্টেম্বর সকাল ১১ টায় আমার মেঝো মেয়ে ফারহানা সুফিয়ান চৌধুরীকে ফোন করে আমার বড় মেয়ে জানায় যে, সে রুম্মানকে সকাল সাড়ে দশটায় ফোন করে ইভানার খবর জানতে চাইলে রুম্মান জানায় যে, ইভানা ওভারডোজ ওষুধ খেয়ে ফেলেছে। এখন ঘুমাচ্ছে। চিন্তার কোন কারণ নেই। ফারহানা তখন ইভানাকে দেখতে আনুমানিক ১টার দিকে তার শ্বশুরবাড়ি গিয়ে পৌঁছায়। এর আগে বাসার কাছাকাছি পৌঁছে সে ইভানাকে ফোন করে না পেয়ে ইভানার শাশুড়িকে ফোন করে। তিনি ভীষণ বিরক্ত হয়ে আমার মেয়ে কেন তাদের বাসায় যাচ্ছে এই নিয়ে প্রশ্ন করেন। আমার মেয়ে তখন বলে ইভানা যেহেতু ওভারডোজ ওষুধ খেয়ে ফেলেছে বলে জানতে পেরেছে তাই দেখা করতে যাচ্ছে। এর মধ্যে ফারহানা রুম্মানদের বাসার নিচে পার্কিং এ গিয়েও ফিরে আসে কারণ ইভানা তাঁকে বাসায় যেতে মানা করে। ইভানার শাশুড়ির চাপে গলায় একধরনের ভয় এবং শঙ্কা নিয়ে আমার মেঝো মেয়েকে বাসায় না ঢুকে চলে যেতে বলে। ফারহানা তখন আমার বাসায় আমাকে দেখতে আসে। বিকেলে ইভানা ভিডিও কল করে আর অনেক কান্নাকাটি করতে থাকে। তখন ইভানা তাঁর বোন ফারহানা কে দুঃখ করে বলে যে, ‘রুম্মান কেন তাঁকে আর পছন্দ করে না। কেন অন্য নারীকে ভালোবাসে ইত্যাদি।’ রাত সাড়ে ৯টায় আমার মেঝো মেয়ে ফারহানা যখন ইভানাকে ফোন করে তখন আবারো রুম্মানই ফোন ধরে এবং বলে ইভানা ঠিক আছে, ডিনার করেছে এবং ঘুমিয়ে পড়েছে।
১৫ই সেপ্টেম্বর বেলা ১১ টা থেকে সাড়ে ১১টার দিকে ইভানার শ্বশুর আমাকে ফোন করে বলে যে, রুম্মান এবং ইভানার মধ্যে একটা সমস্যা হয়েছে এবং আমি যেন তাঁর বাসায় যাই মিটমাট করার জন্য। আমি আমার মেঝো মেয়ে ফারহানাকে নিয়ে ইভানার শ্বশুর বাড়ির দিকে রওনা হওয়ার অব্যাবহিত পূর্বে রুম্মানের বাবাকে ফোনে জানাই যে আমরা আসছি এবং ফোনে তখনি ইভানার সাথে কথা বলতে চাই। ইভানার শ্বশুর ফোনে কিছুক্ষণ ডাকাডাকি করে জানান যে, ইভানাকে কোথাও দেখতে পাচ্ছেন না। আমরা যখন ইভানার শ্বশুর বাড়িতে পৌঁছাই তখন ইভানার শ্বশুর তাদের বাড়ির সিসিটিভি রুম থেকে বের হয়ে আমাদের বললেন যে, ইভানাকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তারপর আমাদের নিয়ে নানা জায়গা খুঁজলেন। তারপর আমি একটু অসুস্থ থাকার জন্য আমাকে তাঁর বাসায় বসিয়ে আমার মেয়ে কে নিয়ে বিল্ডিং এর পেছনে যান। পরে আমার মেয়ে ফারহানার মাধ্যমে জানতে পারি যে তিনি সবাইকে এই কথা জিজ্ঞেস করছিলেন যে, কোন ভারি আওয়াজ হয়েছে?” বা “কোন মানুষ কি পড়ে গেছে?”। সবাই তখন খোঁজাখুঁজি করে ইভানার মৃতদেহ পায়। আমার মেঝো মেয়ে সেখানেই অসুস্থ হয়ে পড়ে। পরে আমাকে এসে খবর দেয় যে আমার মেয়ে আর নেই। একথা শুনে আমি স্তম্ভিত হয়ে যাই। কিন্তু ইভানার শাশুড়ি সঙ্গে সাথে বলে ‘এখানে মরতে গেলো কেন, বনানীতে (আমাদের বাসা) গিয়ে মরতে পারলো না?’ কিছুক্ষণ পর ইভানার শ্বশুর এসে বলে যে, এখন পুলিশকে খবর দিতে হবে, পোস্টমর্টেম হবে, অনেক সময় লাগবে। আমি তখন আমার স্ত্রীকে খবর দেয়ার জন্য আমার বাসায় আসি। সাথে করে ইভানার দুই ছেলে আর অপু (যে মেয়েটি বাচ্চাদের দেখাশোনা করে) কে নিয়ে আসি। পরবর্তীতে জানতে পারি যে পুলিশ খবর পেয়ে আসে এবং ময়নাতদন্তের জন্য ইভানার মৃতদেহ নিয়ে যায়।
অপুর কাছে পরে জানতে পারি যে, ১৫ই সেপ্টেম্বর সকালে রুম্মান এবং তাঁর মা বাবা সবাই ইভানাকে বকাঝকা করে এই বলে যে, মারা যাওয়া কি এতো সোজা? তারা ইভানাকে আরো নানা কটু কথা বলে উত্তেজিত করে। পরে ইভানা ফোনে কথা বলতে বলতে অপু এবং ইভানার শ্বশুর এবং শাশুড়ির সামনে দিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে যায়।
উল্লেখ্য যে, ইভানার মৃত্যুর পর ইভানার লেখা একটি ইমেইল (তারিখ- ৩রা মে, ২০১৬) সম্পর্কে আমি অবগত হই। সেখান থেকে আমি জানতে পারি যে রুম্মান ইভানার ওপর বিয়ের পর
থেকেই শারীরিক ও মানসিক অত্যাচার করতো। এমনকি ইভানা যদি তার চাকরি না ছাড়ে তাহলে তাকে ডিভোর্স দেয়া হবে বলেও হুমকি ও দিয়েছিল। ইভানার ফেসবুকের পোস্ট এবং মেসেঞ্জারে তাঁর বন্ধু ও শুভানুধ্যায়ী দের কাছে পাঠানো মেসেজ দেখে আমি আরো নিশ্চিত হয়েছি যে, রুম্মান পরকীয়ার কারণে আমার মেয়ের সাথে দুর্ব্যবহার করতো, তাঁকে শারীরিক ও মানসিক ভাবে নির্যাতন করতো এবং তাদের সন্তানদের উপর ও শারীরিক ও মানসিক অত্যাচার করতো।
রুম্মান নিয়মিতভাবে তাঁর পরিচিত একজন নেফ্রোলজিস্ট প্রফেসর ডাঃ এম মুজিবল হক মোল্লার কাছে নিয়ে যেতো। ওই নেফ্রোলজিস্ট তাঁর প্রেসক্রিপশন সমূহে ইভানার শারীরিক বা মানসিক অভিযোগের কোন বর্ণনা না লিখে বা কোন রোগের নাম উল্লেখ না করে এমন সব ওষুধ প্রেসক্রাইব করেন যা মানসিক রোগের জন্য প্রযোজ্য। অথচ প্রেসক্রিপশন থেকে প্রতীয়মান হয় যে, তিনি মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ নন। যেমন ট্যাবলেট কুইটা (tablet Quite 50mg), যার পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হচ্ছে যে এই ওষুধ আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ায় এবং ডিপ্রেশন বাড়িয়ে দেয়। প্রথমত তাঁর এই প্রেশক্রিপশনে কোন সিন্ড্রোম তিনি লিখেন নাই। এই ওষুধগুলো দেয়ার আগে ডায়াগনোসিস করতে হয়। সেটাও তিনি করেন নি। দ্বিতীয়ত, দুই মাসের জন্য ডোজ দিয়েছেন যা কখনোই উচিত নয়। সাধারনত দুই/তিন সপ্তাহের পর একটা ফলোআপ থাকতে হবে, মনিটর করতে হবে। ঐ ওষুধ ইভানাকে এডজাস্ট করেছে কিনা, নাকি ক্ষতি করছে এসব কিছুই বিশ্লেষণ করা হয় নাই।
এছাড়া ঘটনার প্রায় পূর্ব থেকেই রুম্মান ইভানাকে নিয়মিত ঘুমের ঔষধও খাওয়াতো যাতে তাঁর পরকীয়া ফোনালাপ করতে সুবিধা হয়। ইভানার ল্যাপটপ এখনো রুম্মানের জিম্মায় আছে এবং আমরা আশংকা করছি যে রুম্মান অনেক প্রমাণ নষ্ট করতে পারে।
এভাবেই ১ নং আসামি ২ নং আসামির সাথে তাঁর পরকীয়া সম্পর্ক নির্বিঘ্ন করার জন্য তাঁর পথের কাঁটা ইভানাকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেয়ার অভিপ্রায়ে ইভানাকে অমানবিক শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রণা দিয়ে, ঘুমের ওষুধের নামে ক্ষতিকর দ্রব্য সেবন করিয়ে এবং ৩ নং আসামির
প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় উদ্দেশ্যমূলকভাবে ক্ষতিকর ও আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়িয়ে দেয় এমন ওষুধ প্রেসক্রাইব করিয়ে ও সেই ওষুধ ওভারডোজ ইভানার উপর প্রয়োগ করে ধীরে ধীরে তাকে হত্যা করে। ১ নং আসামি এমনি অমানবিক যে তাঁর স্ত্রীর দুর্ঘটনার খবর সোনার পর তাকে চিকিৎসা দেয়ার কোন চেষ্টা করে নি। তাঁর দাফন, জানাজা থেকে শুরু করে কোন সামাজিক দায়িত্ব পালন করে নি, এমনকি তাঁর সন্তানদেরও এ পর্যন্ত কোন খোঁজ খবর নেয়নি। এসব বিষয়ে ওই থানায় মামলা রুজু করে আসামিদের গ্রেপ্তার করত প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ