জোয়ারের পানিতে ডুবে চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতাল

বৃষ্টির দরকার হয় না, জোয়ারের পানিতে ডুবে যায় বন্দরনগরীর আগ্রাবাদ সিডিএ আবাসিক এলাকা। সেখানেই অবস্থিত নগরীর বৃহত্তম বেসরকারী চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতাল। প্রায় সারাবছরই দুর্ভোগ সঙ্গী করে চালাতে হয় হাসপাতালটির সেবা কার্যক্রম। চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী এবং চিকিৎসাসেবা গ্রহণ করতে আসা রোগী ও স্বজনদের ভোগান্তি যেন নিয়তিতে পরিণত হয়েছে। জোয়ারের পানি ঠেকাবার কার্যকর ব্যবস্থা এখনও বাস্তবে রূপ পায়নি। আর কতকাল এ দুর্ভোগ। এ প্রশ্ন এলাকার অধিবাসীদের।

রবিবার বিকেল ৩টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় চট্টগ্রামে বৃষ্টিপাত রেকর্ড হয়েছে ২৪ দশমিক ৮ মিলিমিটার। বর্ষাকালে এ বর্ষণ খুব বেশি নয়। কিন্তু পানিতে ডুবেছে হাসপাতালটির নিচ তলায় অবস্থিত সকল ওয়ার্ড এবং কার্যালয়। কোথাও সে পানির উচ্চতা হাঁটু পর্যন্ত। সকল বিভাগের রোগীদের চলতে হয়েছে হাঁটুপানি মাড়িয়ে। অনেককেই দেখা গেল চেয়ারে বসে পা উঁচিয়ে রাখতে। শিশু ও বৃদ্ধ রোগীদের নিয়ে স্বজনদের কষ্ট বর্ণনাতীত। এরই মধ্যে চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীরা ছুটছেন এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। হাসপাতালে পানির ‘ছ্যালাৎ ছ্যালাৎ’ শব্দ। এমন ভাবা না গেলেও এটাই যেন বাস্তবতা। চট্টগ্রাম মহানগরী এমনিতেই দেশের অন্যান্য শহরের তুলনায় আলাদা বৈশিষ্ট্যের। এখানে দৈনিক দু’বার জোয়ার হয়। পূর্ণিমা-অমাবশ্যা তিথিতে সে জোয়ার হয় অপেক্ষাকৃত উঁচু। ফলে আগ্রাবাদ আবাসিক এলাকার নিচু সড়ক শুষ্ক মৌসুমেও তলিয়ে যায়। বর্ষায় যদি এর সঙ্গে যুক্ত হয় জোয়ারের পানি, তবে সর্বনাশের ষোলোকলা। দিনে দিনে অনেকটা পরিত্যক্ত হয়ে পড়েছে আগ্রাবাদ সিডিএ আবাসিক এলাকা। শুধু হাসপাতাল নয়, সকল বাড়ি-ঘর পড়েছে এহেন দুর্ভোগের কবলে।

চট্টগ্রাম মহানগরীর আগ্রাবাদ ছিল সবচেয়ে অভিজাত এলাকা। বাণিজ্যিক এলাকার কাছাকাছি অবস্থান হওয়ায় বড় বড় শিল্পপতি ও ধনীরা সেখানে জায়গা কিনে বিলাসবহুল বাড়ি বানিয়েছিলেন। সে সকল বাড়ির নিচ তলার প্রায় অর্ধেক পর্যন্ত পানিতে ডুবে থাকে। সেই নিচতলা ডিঙ্গিয়ে যেহেতু উপরে ওঠার সুযোগ নেই সেহেতু বাড়িগুলো পরিত্যক্ত হয়ে গেছে। অনেক টাকায় নির্মাণ করা এসব বাড়ি এখন বসবাসের অযোগ্য। ফলে সেই ধনী বাড়ি মালিকরা অন্যত্র বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকছেন। নিজের বাড়ি ফেলে ভাড়া বাড়িতে বসবাস করা যে কত কষ্টকর, তা একমাত্র ভুক্তভোগীরাই উপলব্ধি করেন।

চট্টগ্রাম মহানগরীর আগ্রাবাদ থেকে বড়পুল পর্যন্ত সড়কটি বছরখানেক আগেও কোমরপানিতে তলিয়েছে। বর্ষা মৌসুমে ওপথে যেতে পারত না যানবাহন। গত বছর থেকে সড়কটি বেশ উঁচু হয়েছে বটে, কিন্তু আবাসিক এলাকা রয়ে গেছে নিচু। সড়ক এখন আর ডুবে না। তবে পানিতে থৈ থৈ অবস্থা আবাসিক এলাকার। একদা অভিজাত এ এলাকায় বর্ষা মৌসুমে বসবাস যেন দুর্ভোগকে মেনে নিয়ে প্রকৃতির সঙ্গে যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়া। বাড়িগুলো বেশ বিলাসবহুল হলেও সেখানে আর বিলাসী লোকরা বসবাস করেন না। বরং সেগুলো পরিণত হয়েছে কম ভাড়ার বাড়িতে।

রবিবার আগ্রাবাদ মা ও শিশু হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায় রোগী ও স্বজনদের অবর্ণনীয় দুর্ভোগ। এ হাসপাতালটি বেসরকারী হলেও চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পর এটিই নগরের দ্বিতীয় বৃহত্তম হাসপাতাল। এর সঙ্গে রয়েছে একটি মেডিক্যাল কলেজও। নগরবাসী বেশ অল্প খরচে এই বেসরকারী হাসপাতাল থেকে উন্নতমানের সেবা পেয়ে থাকে। কিন্তু দিন দিন অবস্থা করুণ থেকে করুণতর হচ্ছে। নগর উন্নয়ন ও জলাবদ্ধতা দূরীকরণে অনেক প্রকল্পের কাজ চলমান থাকলেও আগ্রাবাদ আবাসিক এলাকার উন্নতি নেই। দুর্গতি যদি শুধুমাত্র বর্ষা মৌসুমে হতো তাহলেও মনে সান্ত¡না খুঁজে পেতেন অধিবাসীরা। কিন্তু বৃষ্টি লাগছে না, জোয়ারেই প্লাবিত হয় পরিকল্পিত এই আবাসিক এলাকা। এই অবস্থায় শুধু বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনেই মুক্তি নয়, বরং খালের মুখে যথাযথ ব্যবস্থা নিয়ে জোয়ারের পানি ঠেকানো আরও জরুরী হয়ে পড়েছে।

বরিশালের নিম্নাঞ্চল ॥ স্টাফ রিপোর্টার বরিশাল থেকে জানান, জোয়ারের পানিতে তলিয়ে গেছে বরিশালের নিম্নাঞ্চল। বিপদসামীর ওপর দিয়ে বইছে কীর্তনখোলাসহ নয়টি নদীর পানি। জোয়ারের পানি ঢুকে পড়েছে বরিশাল নগরীতে। প্লাবিত হয়েছে নগরীর অপেক্ষাকৃত নিম্নাঞ্চল। ফলে দুর্ভোগে পড়েছেন এসব এলাকার বাসিন্দা।

নদীর পাড় উপচে জোয়ারের পানির সাথে ড্রেনের পানি যুক্ত হয়ে পানি ঢুকে পড়েছে নগরীতে। শনিবার সকাল থেকে নদ-নদীর পানি বাড়তে শুরু করার পর ওইদিন সন্ধ্যার মধ্যে নগরীর রসুলপুর, ভাটিখানা, সাগরদী, ধান গবেষণা রোড, ব্যাপ্টিস্ট মিশন রোড, স্টেডিয়াম কলোনি, সদর উপজেলার চরবাড়িয়া, লামছড়িসহ বিস্তীর্ণ নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। নগরীর নিম্নাঞ্চলের রাস্তা-ঘাট, অলিগলি পানিতে তলিয়ে গেছে।

পাউবো সূত্রে জানা গেছে, কীর্তনখোলা, নয়াভাঙ্গুলী, তেঁতুলিয়া, সুরমা-মেঘনার মিলিত প্রবাহ, কচা, বিষখালী, বুড়িশ্বর-পায়রা নদীর মিলিত প্রবাহ এবং বরগুনায় বিষখালীর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পূর্ণিমার কারণে বরিশাল অঞ্চলে নদ-নদীর পানি অস্বাভাবিক বেড়ে গেছে। কীর্তনখোলা, নয়াভাঙ্গুলী, তেঁতুলিয়াসহ নয়টি নদীর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

পাউবোর সহকারী প্রকৌশলী এআই জাবেদ বলেন, পূর্ণিমার জোর কারণে কীর্তনখোলাসহ এ অঞ্চলের নদ-নদীর পানিপ্রবাহ বৃদ্ধি পেয়েছে। শনিবার সন্ধ্যায় কীর্তনখোলার পানি বিপদসীমার ২ দশমিক ৬০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে।

নিজস্ব সংবাদদাতা মোংলা থেকে জানান, চলতি পূর্ণিমার ভরা কটালে স্বাভাবিকের তুলনায় ২৩ সেন্টিমিটার পানি বৃদ্ধি পেয়েছে সুন্দরবনের নদ-নদী ও মোংলার পশুর নদে। নদীর পানি ছাপিয়ে বনের অভ্যন্তরে প্রবেশ করায় তিন থেকে চার ফুট পানিতে প্লাবিত হয়েছে গোটা সুন্দরবন। এছাড়া এক থেকে দেড়ফুট পানিতে তলিয়ে গেছে করমজলসহ বিভিন্ন পর্যটন কেন্দ্র, বন বিভাগের স্টেশন ও ক্যাম্পের রাস্তাঘাট এবং নিচু অবকাঠামো। এদিকে পশুর নদের পানি বৃদ্ধিতে তলিয়ে গেছে মোংলার কানাইনগর, কাইনমারী, চিলা, সিন্দুরতলা, জয়মনি, বুড়িরডাঙ্গাসহ বিভিন্ন এলাকা। অস্বাভাবিক জোয়ারের পানিতে তলিয়ে গেছে পশুর নদের পাড়ের ওই সকল এলাকার ঘরবাড়ি ও রাস্তাঘাট। আকস্মিক নদীর পানি বেড়ে সুন্দরবন ও উপকূলের বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত হওয়ায় এখানে এক রকম বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।

সুন্দরবনের করমজল বন্যপ্রাণী প্রজনন কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোঃ আজাদ কবির বলেন, বিশেষ করে প্রতি পূর্ণিমার গোনেই স্বাভাবিকের তুলনায় জোয়ারের পানি কিছুটা বেড়ে থাকে। তবে এবার পূর্ণিমার জোয়ারে অনেক বেশি পানি হয়েছে, যা আগে কখনও এত পানি হয়নি। রবিবারের দুপুরের জোয়ারে করমজলের বনের ভেতরে ৩ থেকে ৪ ফুট পানি বেড়েছে। এক/দেড় ফুট পানিতে তলিয়ে গেছে কেন্দ্রের উঁচু রাস্তাঘাট ও নিচু স্থাপনাও।

বাগেরহাট পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী বিশ্বজিৎ বৈদ্য বলেন, পূর্ণিমার ভরা গোনের প্রভাবে সুন্দরবনের বিভিন্ন নদ-নদী ও মোংলা বন্দরের পশুর নদে স্বাভাবিকের চেয়ে ২৩ সেন্টিমিটার পানি বেড়েছে। মূলত শুক্রবার থেকে নদ-নদীর পানি বাড়তে শুরু করে। শুক্রবার ১৫ সেন্টিমিটার, শনিবার ২১ সেন্টিমিটার ও রবিবার ২৩ সেন্টিমিটার পানি বেড়েছে। চলতি এ গোন শেষের সাথে সাথে নদীর পানিও কমে আসবে বলে জানান তিনি।

নিজস্ব সংবাদদাতা লক্ষ্মীপুর থেকে জানান, বঙ্গোপসাগরে বিরূপ আবহাওয়ার প্রভাবে লক্ষ্মীপুরে উপকূলীয় এলাকায় অস্বাভাবিক জোয়ারে মেঘনা নদীর তীরবর্তী অন্তত ২৫টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। তলিয়ে গেছে আমন বীজতলা, আউশসহ অন্যান্য কয়েক হাজার একর ফসলি জমি। রবিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত বঙ্গোপসাগরে নিম্নচাপ থাকায় নদীতে স্বাভাবিক উচ্চতার চেয়ে প্রায় ৩/৪ ফুট পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে লোকালয়ে জোয়ারের পানি ঢুকে পানিবন্দী হয়ে পড়েছে প্রায় ২০ হাজার পরিবার।

এদিন সন্ধ্যা পর্যন্ত জোয়ারের পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে বলে জানান, কমলনগর মতিরহাট নিবাসী সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান রফিক উল্যা চৌধুরী। রামগতি উপজেলার আলেকজান্ডার থেকে সমাজকর্মী মেজবাহ উদ্দিন হেলাল জানান, এদিন রবিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত গত দিনের মেঘনার প্রচ- জোয়ারে আলেকজান্ডার ইউপির সবুজগ্রাম, পৌরসভার ৭নং ওয়ার্ড খন্দকারপাড়া ও সমবায় গ্রামসহ ৮টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। ডুবে গেছে ফসলি জমি ও কয়েক হাজার বাড়িঘর। এলাকার বিভিন্ন সূত্র থেকে আরও জানা গেছে, মেঘনার প্রচন্ড জোয়ারের তোড়ে কমলনগরের এস আলম সড়কসহ কয়েকটি সড়ক বিছিন্ন হয়ে পড়েছে। এ ছাড়া বলিরপোল থেকে নাছিরগঞ্জ সড়কের ২টি স্থান বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। এতে আমনের বীজতলার ব্যাপক ক্ষতির আশঙ্কা করা হচ্ছে। রায়পুর থেকে সদর ও কমলনগর হয়ে রামগতি পর্যন্ত ৬০ কিলোমিটার নদী এলাকার বেশিরভাগ গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। কমলনগরের চরকালকিনি, চর সেকান্দর, পাটওয়ারীহাট, চরফলকন, সাহেবেরহাট, চরমার্টিন, চরলরেন্স, নবীগঞ্জ, মাতাব্বার হাট ও রামগতির আলেকজান্ডার, জেলা সদরের চররমনিমোহন, চরমেঘা, রায়পুরের চর আবাবিল, চরটুনটুনি, চরলক্ষ্মী, চরবংশীসহ প্রায় ২৫টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। নদীর তীর থেকে এসব এলাকার প্রায় দুই থেকে তিন কিলোমিটার পর্যন্ত জোয়ারের পানি ঢুকেছে। এতে আমন বীজতলা, আউশের কয়েক হাজার একর ফসলি জমি জোয়ারের পানিতে তলিয়ে গেছে। অস্বাভাবিক জোয়ারের কারণে নদী সংযুক্ত খাল, পুকুর, বসতঘর, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও রাস্তাঘাট হাঁটু পরিমাণ পানিতে ডুবে আছে। কোথাও কোথাও কোমর পরিমাণ পানিও হয়েছে। এতে মেঘনা উপকূলীয় নিম্ন আয়ের মানুষ চরম ভোগান্তিতে পড়েছে।>>হাসান নাসির এর প্রতিবেদনটি জনকণ্ঠ থেকে নেয়া