প্রথম স্টোকে হারানো বাকশক্তি ফিরে ফেলেন দ্বিতীয় স্টোকে

হিউম্যান ২৪ ডেস্ক:  চার বছর আগে ৭৩ বছর বয়সী পিটার একটি স্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়ার পর কথা বলার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন। কিন্তু এই বছরের শুরুতে তিনি এক সকালে জেগে উঠে হঠাৎ টের পান যে তিনি আবার কথা বলতে পারছেন। এরপরই তিনি আবিষ্কার করেন যে তার আরেকটি স্ট্রোক হয়েছিল। তাহলে এই দ্বিতীয় স্ট্রোকই কি তার কথা বলার ক্ষমতা ফিরিয়ে দিয়েছে?

যেদিন পিটার তার কথা ফিরে পেলেন, সেদিন তিনি ছুটি কাটাতে পরিবারের সঙ্গে ডেভন শহরে ছিলেন।
মিস্টার পিটার বিবিসিকে বলেন, “আমি অন্য দিনগুলোর মতো স্বাভাবিকভাবে জেগে উঠলাম। আমার স্ত্রী ক্যারোল বিছানার আরেক পাশে শুয়ে ছিল। আমি উঠে দাঁড়িয়ে তার সাথে কথা বলতে থাকলাম।”

“তখন আমার কাছে কোন খটকা লাগেনি। শুধু এটাই মনে হচ্ছিলো যে আমি আমার স্ত্রীর সাথে কথা বলছি। – যেটা খুব স্বাভাবিক।”

“আমি ওর সঙ্গে কথা বলেই যাচ্ছিলাম, কিছুক্ষণ পর ক্যারোল তার মুখ খুলল। সে বলল, যে পিট, তুমি কথা বলছ!”
ক্যারোল সে সময়কার কথা মনে করে বলেন, “আমি ওর কথা শুনতে পেয়ে বার বার বলছিলাম, পিটার কথা বলতে থাকো। থেমো না! থেমো না! থেমো না কারণ এটা আবার চলে যেতে পারে। কথা চালাতে থাকো, চালাতে থাকো!

তাদের ছেলে জোনাথন, পাশের ঘরেই ছিলেন। দুইজনের কথোপকথন শুনতে পেয়ে তিনি তাদের ঘরে দৌড়ে আসেন।
“কি হচ্ছে, মা?” তিনি বলেন, “আমি ভেবেছি তোমার কণ্ঠস্বরে কোন সমস্যা হল নাকি! তাহলে এই ভারী কণ্ঠটা কার?”
জবাবে ক্যারোল বলেন, “এটা তোমার বাবার কণ্ঠ! তোমার বাবা কথা বলছেন।”

“আমরা সবাই একইভাবে কাঁদতে ও হাসতে শুরু করেছিলাম। এটা খুবই আবেগের মুহূর্ত ছিল কারণ টানা চার বছর ধরে আমরা তার মুখের কোন কথা শুনতে পারিনি।” বিবিসি জানান ক্যারোল।

পিটারের প্রথম শব্দটা কি ছিল, সেটাও তার স্ত্রীর মনে নেই। কেননা তিনি এতোটাই চমকে গিয়েছিলেন যে কোন কিছুই তাৎক্ষণিক ঠাহর করতে পারেননি।

পিটার বলেন, “আমি কি বলছিলাম সেটা নিয়ে “ক্যারলের এতোটা আগ্রহ ছিল না। আমি যে কথা বলছি এটাই তার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল।”

দ্বিতীয় স্ট্রোক কখন হল?
তাদের সবাই এ ঘটনাটি আনন্দের সঙ্গে উদযাপন করতে বেরিয়ে পড়েন। কিন্তু সে সময় ক্যারল লক্ষ্য করেন যে পিটারের মুখের বাম পাশ ঝুলে পড়ছে। পরে পিটার জানান যে তার পা খুব দুর্বল লাগছে- হাঁটতে অসুবিধা হচ্ছে। এসময় জোনাথন তার বাবাকে সোজা করে ধরে রাখেন। পরে তারা একটি ট্যাক্সি করে পিটারকে কাছের হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে ডাক্তারি স্ক্যানে জানা যায় যে, তার আরেকটি স্ট্রোক হয়েছিল।

ভাগ্যক্রমে, যাইহোক, এই নেতিবাচক প্রভাব বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি। পিটারের মুখ এবং পা কিছুক্ষণ পর স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে। এবং পরবর্তীতে তার কথা বলাতেও আর কোন সমস্যা দেখা যায়নি। এই দম্পতি বিশ্বাস করে যে হয়তো দ্বিতীয় স্ট্রোক যেকোনো ভাবে পিটারের মস্তিষ্কের কোন একটা পথ পরিষ্কার করে দিয়েছে – যে কারণে প্রথম স্ট্রোকের পর তার কথা বলা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।

বিশেষজ্ঞদের মতামত
কগনিটিভ স্নায়ুবিজ্ঞানের অধ্যাপক এবং মস্তিষ্কে স্ট্রোক বা আঘাতের পরে ভাষা পুনরুদ্ধারের বিশেষজ্ঞ অ্যালেক্স লেফ এই ঘটনার একটা ব্যাখ্যা দেন।

নি বলেন, “যদি মস্তিষ্ককে নেটওয়ার্ক হিসাবে এবং স্ট্রোককে একটা ইভেন্ট হিসেবে চিন্তা করা হয়। তাহলে ধরে নিন যে এমন অনেক ইভেন্ট আছে যা আমাদের ভাষা কেড়ে নেয়। সেক্ষেত্রে, রোগীরা মস্তিষ্কের অবশিষ্টাংশ ব্যবহার করে ভাষার কিছু কিছু ফাংশন পুনর্বহাল করতে পারে।”

কিন্তু যদি পিটারের মতো কারও ভাষার সমস্যা গুরুতর হয়। তাহলে বুঝতে হবে যে, এই প্রক্রিয়াটি ধীরে ধীরে কাজ করছে।
তবে পিটারের ক্ষেত্রে যেটা হয়েছে সেটা সচরাচর দেখা যায়না বলেও জানান অধ্যাপক অ্যালেক্স লেফ।
অ্যাফাসিয়া কি?

অ্যাফাসিয়া বলতে স্ট্রোক বা মস্তিষ্কের কোন আঘাতের ফলে রোগীর বাকশক্তি হারানোকে বোঝায়। এমন দুই ধরণের অ্যাফাসিয়ার কথা জানিয়েছে যুক্তরাজ্যের জাতীয় অ্যাফাসিয়া সংস্থা।

১. ব্রোকাস অ্যাফাসিয়া                                                                                                          এতে বাকশক্তি পুরোপুরি না হারালেও অনর্গল কথা বলার ক্ষমতা লোপ পায়। এতে রোগীর কথা বলা এতোটাই সীমিত হয়ে পড়ে যে, অনেক প্রচেষ্টার পর চারটি শব্দের চেয়ে বেশি কিছু বলতে পারেনা।
তবে অন্যের কথা বোঝার ক্ষেত্রে বা কোন লেখা পড়ার ক্ষেত্রে রোগীর কোন সমস্যা থাকেনা। তবে নিজে লিখতে গেলে কিছু অসুবিধা হয়।

২. অ্যানোমিক অ্যাফাসিয়া
যাদের অ্যানোমিক বা অস্বাভাবিক অ্যাফাসিয়া আছে, তাদের কথা বলা বা লেখার সময় যে শব্দটি ব্যবহার করতে চান সেটা খুঁজে বের করতে প্রতিনিয়ত সমস্যা হয়।। বিশেষ করে কিছু উল্লেখযোগ্য বিশেষ্য এবং ক্রিয়াপদ।
তবে তারা অন্যের কথা ভালভাবে বুঝতে পারে এবং লেখাও পড়তে পারে। পিটারও যে চার বছর কথা বলতে পারেননি। সে সময় তার অন্যের কথা বোঝার ক্ষেত্রে বা পড়ার ক্ষেত্রে কোন সমস্যা হয়নি।

পিটারের প্রথম স্ট্রোকের দিন:
পিটারের যখন প্রথম স্ট্রোক হয়েছিল তখন তার স্ত্রী ক্যারল তার সঙ্গে বাইরে ছিলেন।
পিটারের সেসময় হঠাৎ শরীর খারাপ করতে শুরু করে। তাই ক্যারল তাকে নিয়ে বাড়ি ফিরে আসেন।
“আমি সেই সময়ের পিটারকে জিজ্ঞেস করেছিলাম যে কয়টা বাজে। সে আমাকে কোন উত্তর দেয়নি। তখনই বুঝলাম বড় কোন ঝামেলা হয়েছে। যখন আপনার বিয়ের বয়স ৫২ হয়ে যায় তখন সবকিছু বুঝতে পারাই স্বাভাবিক, তাই না?” বিবিসিকে জানান ক্যারোল।

‘হ্যাঁ এবং না দিয়ে সব আবেগ প্রকাশ করা যায়না’ তারপর, কয়েক সপ্তাহ ধরে পিটার ধীরে ধীরে বুঝতে পারেন যে তার কথা অস্পষ্ট হয়ে আসছে।

পিটার বলেন, “দিনকে দিন আমার কথাবার্তা চালিয়ে যাওয়া ভীষণ কঠিন হয়ে পড়ছিল। আমি শব্দ হারিয়ে ফেলছিলাম। একটা বাক্য ঠিকভাবে বলতে পারতাম। ছাড়া ছাড়া কিছু শব্দ বের হতো।”

“এক পর্যায়ে আমার কথা বলাই প্রায় অসম্ভব মনে হল। আমি শুধু ‘হ্যাঁ’ এবং ‘না’ বলতে পারতাম এবং মাঝে মাঝে খুব ছোট কোন একটা বাক্য বলতাম।”

“তবে আশেপাশে কি চলছে, কে কি বলছে, কি লেখা আছে, সবই বুঝতাম। এজন্য আমি হাতের ইশারায় না হলে লিখে লিখে নিজের কথা অন্যদের বোঝাতাম। গত চার বছর সব সময় হাতে পেন্সিল ও কাগজ নিয়ে চলেছি ”
“কথা বলতে না পারায় বুঝতাম না কিভাবে সময় কাটাবো। তখন গণিতের ওপর অনেক বই পড়েছি। সেগুলো আমাকে ব্যস্ত রাখতে সাহায্য করতো।” বিবিসি এভাবেই সেই সময়ের কথা জানান পিটার।

তিনি বলেন, “অন্যান্য মানুষের সাথে যোগাযোগ করতে পারাই একটা মানুষের আসল কাজ। যখন সেই ক্ষমতাটা চলে যায়। তখন নিজের বলতে তেমন কিছুই থাকে না। আমার পরিবারের কাছেও মনে হতো আমার জীবনের বড় একটা অংশ নেই। আসলে ‘হ্যাঁ’ এবং ‘না’ দিয়ে সব আবেগ প্রকাশ করা যায়না।”

এরমধ্যে সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং হল, অন্যদের এমন কোন কথা শুনে যাওয়া, যার সঙ্গে পিটার একমত হতে পারতেন না। তিনি বলেন, ” যখন মানুষ কোন বিষয়ে তর্ক করে, তখন সেখানে অনেক কথাই বলতে ইচ্ছা করে। কিন্তু আমি কোন প্রতিক্রিয়া জানাতে পারিনি – এটা ছিল সবচেয়ে হতাশাজনক। মনে হতো আমি প্রতিটি যুক্তিতে হেরে গিয়েছি।”

যেন নতুন জীবন ফিরে পাওয়া                                                                                                চটপটে,কর্মপটু অবসরপ্রাপ্ত প্রকৌশলী স্বামীর এমন পরিস্থিতি দেখে ভেঙে পড়েছিল পিটারের পুরো পরিবার।
তবে শেষ পর্যন্ত পিটারের বাকশক্তি ফিরে আসায় সবার চোখে যেন আনন্দের বন্যা বয়ে যায়।
কিন্তু পিটারের পরিবারের দুশ্চিন্তা যে তিনি হয়তো আবার এই কথা বলার ক্ষমতা হারাতে পারেন।
পিটার বলেন, “বিষয়টা অনেকটা পুরানো হ্যামার ঘড়ির মতো। একটা আঘাতে যেটা নষ্ট হয়ে যেতে পারে। আরেকটা আঘাতে সেটা ঠিকও হয়ে যেতে পারে।”