ঈশ্বরের কাছে জানতে ইচ্ছা করে, কেন এই অবস্থা হয়?”

 

হিউম্যান ২৪ ডেস্ক:  ভারতের হিমাচল প্রদেশে কুলু এলাকার জানা গ্রামের এক সন্তানের মা বিমলা দেবী বলছিলেন, “প্রচণ্ড শীতের মধ্যেও আমাকে গোয়ালঘরে ঘুমাতে হয়, নয়তো বাইরে, খোলা জায়গায়। ওই সময়ে ঘরের ভেতরে যাওয়া যায় না। রান্নাঘরে পা রাখতে পারি না, মন্দিরে যেতে পারি না। কখনও কখনও ঈশ্বরের কাছে জানতে ইচ্ছা করে, কেন এই অবস্থা হয়?”

প্রতিমাসেই ঋতুস্রাবের সময়ে বিমলা দেবী এবং কুলুর পাহাড়ি এলাকার গ্রামগুলিতে বহু নারীর ঘরের ভেতরে যাওয়া নিষেধ। স্বামী, সন্তানদের থেকে থাকতে হয় আলাদা, গোয়ালঘরে দিন-রাত কাটাতে হয় ।এখনও গোয়ালঘরেই শুতে হয়। গোবরের গন্ধভরা পরিবেশে থাকতে চান না তারা, কিন্তু তাদের এই প্রথা না মেনে চলারও উপায় নেই।

কুলু এরকম একটা জায়গা, যেখানে দেশ বিদেশের পর্যটকদের ভিড় লেগেই থাকে। সবুজ গাছ আর রঙিন ফুলে ভরা মনোরম উপত্যকার সৌন্দর্য উপভোগ করতে দলে দলে মানুষ যেখানে যান, সেই অঞ্চলেই এরকম একটা নিদারুণ প্রথা চালু রয়েছে এই ২০১৮ সালেও!

বিমলা দেবী বলছিলেন, ওই সময়টায় তারা কাউকে ছুঁতে পর্যন্ত পারেন না, “নারীদের নোংরা, অপবিত্র মনে করা হয় ওই সময়টায়। একা একা থাকতে হয়।

ওই অঞ্চলের মানুষ বিশ্বাস করেন যে ঋতুস্রাবের সময়ে যদি নারীরা বাড়ির ভেতরে ঢোকেন, তাহলে ঘর অপবিত্র হয়ে যাবে অথবা দেবতা রাগ করবেন। এই বিশ্বাস যে শুধু অশিক্ষিত বা অর্ধ-শিক্ষিত মানুষের মধ্যে রয়েছে, তা নয়। অনেক শিক্ষিত পরিবারের মধ্যেও এই কুসংস্কার বিদ্যমান।

কয়েকমাস আগে ওই অঞ্চলে বিয়ে হয়েছে প্রীতা দেবীর। তিনি বি এ পাস করেছেন।প্রথমে এই প্রথার সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে খুব অসুবিধা হলেও প্রাচীন রীতি না মেনে তার উপায় ছিল না।

প্রীতা দেবী বলছিলেন, “প্রথমে তো রাতে ঠিকমতো ঘুমাতেই পারতাম না। ভয় করতো। কিন্তু প্রথা তো মেনে চলতেই হবে। নাহলে ভগবান রাগ করবেন।”

কিন্তু হিমাচল প্রদেশ মহিলা কল্যাণ মণ্ডলের প্রধান মধুর বীণা মনে করেন, এই প্রাচীন প্রথা বদলানোর প্রয়োজন আছে।
তার কথায়, “পরিবর্তন করতে চাইলেও একবারেই সেটা করা কঠিন। এটা পুরুষ প্রধান সমাজ। সময় লাগবে পরিবর্তন আনতে। সচেতনতা তৈরি হলে মেয়েরা নিজেরাই এ নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু করবে।”

ই কাজ শুরুও করেছে সরকার। ঋতুস্রাবের সময়ে গোয়ালঘরে যাতে নারীদের না শুতে হয়, তার জন্য ওই এলাকায় ‘নারী গরিমা’ নামের একটি কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এর মাধ্যমেই সচেতনতা তৈরির চেষ্টা করছে সরকার।

বোঝানোর চেষ্টা হচ্ছে যে গোয়ালঘরে রাত কাটালে নারীদের অনেক ধরনের রোগ হতে পারে। পথ-নাটিকা, লোকগীতি আর নাচের মাধ্যমে এই বার্তা দেওয়ার চেষ্টা করছে সরকার।

কুলুর ডেপুটি কমিশনার মি. ইউনুসও বলছিলেন যে এই প্রাচীন চিন্তাভাবনা পরিবর্তন করা দরকার।

তার কথায়, “সম্মান নিয়ে বেঁচে থাকার অধিকার প্রত্যেকের আছে। যেসব জায়গায় আমরা সচেতনতা বৃদ্ধির চেষ্টা করছি, সেখানে চিকিৎসকদেরও সঙ্গে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ‘অঙ্গনওয়াড়ী’ (বাচ্চাদের দেখাশোনা করার ব্যাপারে সরকারি কার্যক্রম) কর্মীরাও থাকছেন। কারণ ডাক্তার বা ‘অঙ্গনওয়াড়ী’ দিদিদের ওপরে স্থানীয় মানুষের ভরসা, বিশ্বাস রয়েছে। আবার এর সঙ্গে যেহেতু ধর্মবিশ্বাসেরও যোগ রয়েছে, তাই কিছু পূজারী আর পুরোহিতের সঙ্গেও আমরা যোগাযোগ করেছি। তাদের বোঝানোর চেষ্টা করেছি। কয়েকজনকে আমাদের প্রচারে সঙ্গেও পেয়েছি।”

এবছরের জানুয়ারিতে ওই ‘সচেতনতা শিবির’ হয়েছে, এরকম একটা গ্রাম পরিদর্শন করেছে আর্ন্জাতিক গনমাধ্যম বিবিসির একটি টিম।
তারা দেখেছেন, অনেক কিছুই পুরনো প্রথা মেনে চলছে, তবে এটাও ঘটনা যে ঋতুস্রাবের ব্যাপারে কথাবার্তা হচ্ছে – পুরুষমানুষরাও এ নিয়ে প্রকাশ্যেই কথা বলছেন।

জানা গ্রামের এক পূজারী জগত রাম বলছিলেন, “এই ব্যাপারে সচেতনতা তৈরি হয়েছে। আর নারীদের ওই সময়টায় মন্দিরে প্রবেশের কথা যদি বলেন, তাহলে আমরা আর কতজনকে আটকাতে পারব! ঈশ্বরের কাছে সবাই সমান, তার দরজা সকলের কাছেই অবারিত।”

তবে ওই গ্রামেরই একটা অংশ চাইছেন না পুরনো এই প্রথাকে বদলে দিতে।

দ্ধি দেবী নামের এক নারী বলছিলেন, “এটা তো পুরনো রীতি। কেন বদলাতে হবে? ঈশ্বর রাগ করুন, এমন কোনও কাজ করা আমাদের ঠিক হবে না। ঋতুস্রাবের সময়ে বাইরে থাকাটাই শ্রেয়।”

অন্যদিকে, যারা চাইছেন প্রাচীন এই অবৈজ্ঞানিক, অস্বাস্থ্যকর রীতি বদলে ফেলতে, তাদেরই একজন পার্বতী দেবী।
তার এক পুত্র সন্তান রয়েছে। তিনি বলছিলেন, “আমার যদি মেয়ে হয় বা যখন ছেলের বিয়ে দিয়ে ঘরে পুত্রবধূ আনব, তখন ঋতুস্রাবের সময়ে আমি গোয়ালঘরে কিছুতেই তাদের থাকতে দেব না।”

(বিবিস অবলম্বনে)