করোনায় ব্যাতিক্রমী ঈদ

 

কামরান চৌধুরী

বিশ্বব্যাপী ১৮০ কোটি মুসলিমের বাস। মহামারী করোনায় গৃহবন্দি বিশ্বের মুসলমানেরা কঠোর বিধিনিষেধের মধ্যে যে রোজা পালন করলো তা ইতিহাসে বিরল। আত্মীয় স্বজন প্রতিবেশিদের নিয়ে ইফতারি করতে পারেনি, দল বেঁধে মসজিদে তারাবিহ নামাজ পড়তে পারেনি। পারবে না ঈদ উৎসব মনের মত পালন করতে। প্রথাগত ঈদগাঁহে নামাজ পড়াও যাবে না এবার। অতীতে যত বড় দূর্যোগই হোক না কেন, প্রথম বা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ কালীন সময়েও ঈদ উৎসব পালন করেছে তারা। কিন্তু মহামারী করোনা পথ রোধ করে দাঁড়িয়েছে ঈদের আনন্দ ম্লান করে দিতে। সামাজিক দূরত্বের বেড়াজালে মুসলিম ইতিহাসে যেন ভিন্ন ব্যাতিক্রমী ঈদ পালিত হবে এবার। সামাজিক বিচ্ছিন্নতা ইসলামের ঐতিহ্যের পরিপন্থী হলেও করোনার কারণে আপস করছে কোটি কোটি মুসলিম।

মুসলিমদের বার্ষিক শ্রেষ্ঠ দুটি উৎসবের একটি ঈদুল ফিতর। ঈদ মানে খুশি বা আনন্দ। ফিতর বলতে রোজার সমাপ্তি বা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যাওয়া। দীর্ঘ এক মাসের রোজার সমাপ্তি ঘটানো ও দিনের বেলা পানাহারের স্বাভাবিক নিয়মে ফিরে যাওয়া।

ঈদের কথা শুনলেই মুসলিম মন আনন্দে নেচে উঠে। চোখে ভাসে নতুন পোষাকে ব্যস্তময় দিন পার করা। রমজানের শেষে সন্ধ্যা আকাশে ওঠে যখন চাঁদ মনের অজান্তে কণ্ঠে ভাসে অতি পরিচিত সুর ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ’ সেই সাথে ছুটে পালায় প্রিয় নীদ। সকালে ঘুম থেকে উঠে নামাজ পড়ে, নতুন সাবান শ্যাম্পু দিয়ে গোসল শেষে পাঞ্জাবি পাজামা পড়ে, আতর সুগন্ধী মেখে, জায়নামাজ নিয়ে মসজিদে ঈদগাঁহে ছোটা। ছোট বড়, ধনী গরীব একসাথে নামাজ পড়া। নামাজ শেষে হাসিমুখে কোলাকুলি কুশল বিনিময় চলে পরিচিত অপরিচিতের সাথে। ঘরের শিশুদের জন্য বেলুন, বাঁশি, খেলনা কিনে আনা। আর এগুলো দেখে আনন্দে, দৌড়ে শিশুদের সেকি চিৎকার। প্রাণবন্ত সেই হাসি সব দুঃখ মুছে দেয়। বাড়িতে বাড়িতে সাজগোজ, সুস্বাদু খাবার তৈরি চলে। বাসায় ফিরে সেমাই-পায়েস, গোস্ত পোলাও খাওয়া। আত্মীয় বন্ধু স্বজনদের বাড়িতে বেড়াতে যাওয়া। গুরুজনদের সালাম করা, ছোটদের সেলামী দেওয়া। টিভিতে ঈদের জন্য নতুন নতুন সুন্দর আনন্দদায়ক অনুষ্ঠান দেখা। কিভাবে দিনটি মুহূর্তেই যে কেটে যায়, বুঝতে পারে না মানুষ ক্লান্তিহীন আনন্দ।

ঈদের এই আনন্দ নিজের মনকে পবিত্র করার আনন্দ। হিংসা বিদ্বেষ, লোভ মোহ, অহংকার ভুলে নতুন রূপে নিজেকে চেনার আনন্দ। সাম্য, ভ্রাতৃত্ব, ঐক্য, সৌহার্দ্য, সম্প্রীতির আনন্দ। অন্যকে আপন করে নেয়ার আনন্দ। অন্যের দুঃখ দূর করার আনন্দ। রোযা আমাদের যে সংযম ত্যাগের শিক্ষা দেয় তার আলোয় আমরা মানুষে মানুষে বিভেদ মুছে দেয়ার আনন্দ খুঁজে পাই। বিশ্ব মানবতার কানন খুঁজে পাই। ঈদুল ফেতর অনন্য এক উৎসব। মানুষে মানুষে প্রেম-প্রীতি ভালোবাসার ফুল ফোটানোর উৎসব। ঈদ আসে পরম সুখ, অনাবিল শান্তি ও সম্প্রীতির পয়গাম নিয়ে। রহমত, বরকত ও মাগফিরাতের মাস মাহে রমজান। যারা মাহে রমজানকে যথাযথভাবে কাজে লাগাতে পেরেছেন, তাদের জন্য ঈদ খুশির বার্তা নিয়ে আসে। যারা এই মাসটিকে কাজে লাগাতে সক্ষম হন স্বয়ং আল্লাহ রব্বুল আলামিন তাদের নিয়ে গর্ব করেন।

মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, রমজানের শেষে মুমিন বান্দারা যখন তাকবির পাঠ করতে করতে ঈদগাহের উদ্দেশে রওয়ানা হন, আল্লাহতায়ালা তখন ফেরেশতাদের বলেন, যে বান্দা তার কর্তব্য সম্পন্ন করে, তার প্রতিদান কী হওয়া উচিত? ফেরেশতারা বলেন, তার প্রতিদান পূর্ণ মাত্রায় দেয়া উচিত। আল্লাহতায়ালা বলেন, আমার বান্দারা তাদের ওপর আরোপিত কর্তব্য (রোজা) পালন করে এখন আমার মহিমা ঘোষণা করতে করতে (আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার ওয়া লিল্লাহিল হামদ) ঈদগাঁহের দিকে যাচ্ছে। আমি আমার মর্যাদা ও প্রতিপত্তির শপথ করে বলছি, তাদের দুয়া অবশ্যই কবুল করব। তারপর আল্লাহ ঘোষণা করেন, তোমরা ফিরে যাও। আমি তোমাদের পাপগুলো ক্ষমা করে দিলাম এবং তোমাদের পাপরাশিকে ছওয়াবে পরিণত করলাম। অতঃপর তারা ঈদগাহ হতে নিষ্পাপ হয়ে ফিরে আসে’ বায়হাকি।

মহামারী করোনায় আটকে গেছে ঈদ আনন্দ। কোভিড-১৯ সংক্রমণের আশঙ্কায় লকডাউনে থেমে গেছে চলাচল। গৃহে গৃহে বন্দি সবাই। সন্দেহ, আতঙ্ক ভর করেছে সবার মনে। নিষিদ্ধ করা হয়েছে ঈদগাঁহে নামাজ পড়া, মসজিদে মসজিদে পড়তে হবে, তাও আবার সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে। সংক্রমণের ভয়ে আগের মতো গায়ে গায়ে দাঁড়িয়ে নামাজ, গলায় গলা মিলিয়ে, বুকে বুক মিলিয়ে কোলাকুলি করা হবে না। মুরব্বিদের সালাম করা হবে না, শিশুরা সেলামীর আনন্দ বঞ্চিত হবে। রিকসা বা যানবাহনে নতুন পোশাকে শহর/গ্রামে ঘোরা হবে না। আত্মীয় স্বজন বন্ধুর বাড়ি ঘুরে ঘুরে আনন্দ করা হবে না। বাসায় বাসায় ঈদের নামাজ পড়ার আহ্বান। ঈদগাঁহে সমবেত মোনাজাত হবে না। নামাজ শেষে শিশুদের জন্য বেলুন-বাঁশি-খেলনা কেনা হবে না। শহর বর্ণিল আলোক শয্যায় সজ্জিত হয়ে উঠবে না। টিভিতে নতুন নতুন আকর্ষনীয় অনুষ্ঠান উপভোগ করা যাবে না। শুধুই ভয়, শঙ্কার খবর, করোনায় কতজন মারা গেলো, সংক্রমিত হলো, লকডাউন, কোয়ারেনটাইন, আইসোলেশন, ইত্যাদি ইত্যাদি। দেশে ক্রমেই বাড়ছে করোনার সংক্রমণ ও মৃত্যু। জীবন আগে বাঁচাতে হবে। অগণিত মানুষের ঘরে নেই খাবার। কর্মহীনতার কারণে দু’বেলা অন্ন যোগাতে হিমসিম খাচ্ছে মানুষ, বিষন্ন তাদের মুখ। সঞ্চিত পুঁজিও শেষ। ত্রাণ, অর্থ, অনুদান পৌঁছায়নি সবার দ্বারে। সংক্রমণের ভয়ে অনেকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিচ্ছেন না। তার উপর সুপার ঘুর্ণিঝড় আম্পান এর প্রভাবে ভেঙ্গে গেছে অনেকের স্বপ্নসাধ। সেখানে নতুন কাপড় পড়া সেতো দূরের কথা, ভালো খাবারের ব্যবস্থা করাও কষ্টকর।এমন বিষন্ন ঈদ বিশ্ববাসী দেখেনি আগে।

আল্লাহর কাছে প্রার্থনা দ্রুত মহামারী করোনার বিলোপ হোক, মানুষ যে যার কর্মে লিপ্ত হোক। শীঘ্রই ঘুরবে অর্থনীতির চাকা, ফুটবে মানুষের মুখে হাসি। আসবে খুশির ঈদ। ইনশাআল্লাহ উৎসব মূখর হবে আগামীর ঈদ।

কামরান চৌধুরী: পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক, অতীশ দীপঙ্কর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

Email: kamran2070@yahoo.com

 

 

 

মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নয়’