আম্পান এর প্রভাবে কর্ণফুলীর পানি বৃদ্ধি

আম্পান এর প্রভাবে কর্ণফুলীর পানি বৃদ্ধি.ছবি-সিরাজুল ইসলাম হৃদয়

মির্জা ইমতিয়াজ শাওন:: চলতি শতাব্দীতে বঙ্গোপসাগরে তৈরি হওয়া প্রথম ঘূর্ণিঝড় ‘আম্পান’এর প্রভাবে কর্ণফুলীর পানি বৃদ্ধি পেয়েছে অনেকাংশে।

সরেজমিন দেখা গেছে, কর্ণফুলীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে বিমানবন্দর সড়কের কাছাকাছি চলে এসছে। উত্তাল হয়েছে বঙ্গোপসাগর দৈত্যকায় ঢেউ আছড়ে পড়ছে পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতে প্রবল ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের প্রভাবে। নগরের উপকূলীয় পতেঙ্গা, হালিশহর, কাট্টলীতে বেড়িবাঁধ, আউটার রিং রোডের পাশে আছড়ে পড়ছে সাগরের পানি। জনমনে দেখা দিয়েছে উদ্বেগ। এস্ এলাকার মানুষকে নিরাপদ আশ্রয়ে অবস্থান নিতে মাইকিং করছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন, রেড ক্রিসেন্ট ও জেলা প্রশাসন। চসিকের দামপাড়া নিয়ন্ত্রণ কক্ষে বসে উপকূলীয় ওয়ার্ডগুলোর কার্যক্রম মনিটরিং করছেন মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন।

আম্পান সিডরের চেয়েও শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। এর কেন্দ্রে বাতাসের একটানা গতিবেগ ঘণ্টায় ২২০ কিলোমিটার ছাড়িয়ে যাওয়ায় এটি সোমবার পরিণত হয়েছে সুপার সাইক্লোনে।

বঙ্গোপসাগর এখন উত্তাল, তাই সমুদ্রগামী মাছ ধরার ট্রলারগুলো চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীতে নিরাপদ আশ্রয়ে নোঙ্গর করে রাখা হয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দরের মূল জেটিগুলো জাহাজশূন্য করা হয়েছে। ‘বুম আপ’ করা হয়েছে ১৪টি গ্যান্ট্রি ক্রেনও। এর আগেই বহির্নোঙরে বড় জাহাজ থেকে ছোট জাহাজে পণ্য খালাস বন্ধ হয়ে গেছে। বহির্নোঙরে থাকা ৫১টি বড় জাহাজ গভীর সাগরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। ১৮, ১৫ নম্বর খাল এবং গুপ্তখালের লাইটার-কোস্টার ভ্যাসেলগুলো বাংলাবাজার থেকে শাহ আমানত সেতুর উজানে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। বন্দরের নিজস্ব টাগ ও নৌযানগুলো নিরাপদ আশ্রয়ে রাখা হয়েছে। আবহাওয়া অধিদফতরের সতর্ক সংকেত অনুযায়ী ঘূর্ণিঝড় আম্পান উপলক্ষে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ অ্যালার্ট-৩ জারি করেছে।

চট্টগ্রামের গুরুত্বপূর্ণ কিছু প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ কক্ষ স্থাপন করেছে। এগুলো হলো চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের নিয়ন্ত্রণ কক্ষের ফোন নম্বর: ০৩১-৬১১৫৪৫, ০১৭০০ ৭১৬৬৯১।চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ (সিএমপি) সিএমপির দামপাড়া সদরদপ্তরে নিয়ন্ত্রণ কক্ষ চালু করা হয়েছে। নিয়ন্ত্রণ কক্ষের মোবাইল নম্বর: ০১ ৪০০ ৪০০ ৪০০, ০১৮ ৮০ ৮০ ৮০ ৮০। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স: আগ্রাবাদে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের নিয়ন্ত্রণ কক্ষের নম্বর: ০৩১-৭১৬৩২৬, ০৩১-৭১৬৩২৭। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক): চসিকের নিয়ন্ত্রণ কক্ষের ফোন নম্বর: ০৩১-৬৩০৭৩৯, ০৩১-৬৩৩৬৪৯।চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ: চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের তিনটি নিয়ন্ত্রণ কক্ষ। নৌ বিভাগ (০৩১ ৭২৬৯১৬), পরিবহন বিভাগ (০৩১ ২৫১৭৭১১) ও সচিব বিভাগ (০১৭৫১ ৭১৩০৩৭) চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ড: মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড, চট্টগ্রামের নিয়ন্ত্রণ কক্ষের নম্বর: ০১৯১৩ ০২০৭৪৩, ০১৯৮১ ৫৬২৩৫৮, ০১৫৫৪ ৩৩৩৫৪০।

বঙ্গোপসাগরের জানা ইতিহাসে দ্বিতীয় সুপার সাইক্লোন হিসেবে ধরা হচ্ছে আম্পানকে। প্রথম সুপার সাইক্লোনটি ছিল ১৯৯৯ সালের উড়িষ্যা সাইক্লোন। কোভিড-১৯ মহামারীকালে এই ঘূর্ণিঝড়টি উপকূলের হাজারের কম দূরত্বে আসার পর বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে সতর্কতামূলক নানা ব্যবস্থা ইতোমধ্যে নেওয়া হয়েছে।

উত্তর বঙ্গোপসাগর ও গভীর সাগরে অবস্থানরত সকল মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলারকে দ্রুত নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে বলেছে আবহাওয়া অফিস। পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত নিরাপদ আশ্রয়ে থাকতে বলা হয়েছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমান সোমবার সচিবালয় থেকে এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে বলেন, দেশের উপকূলীয় জেলাগুলোতে ১২ হাজার ৭৮টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত করা হয়েছে। মঙ্গলবার সন্ধ্যার আগেই ঝুঁকিপূর্ণ ও নিচু এলাকার বাসিন্দাদের আশ্রয়কেন্দ্রে সরিয়ে নেওয়া হবে।

তিনি বলেন, ১২ হাজার ৭৮টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত করা হয়েছে, এসব আশ্রয়কেন্দ্রে ৫১ লাখ ৯০ হাজার ১৪৪ জন মানুষকে আশ্রয় দেওয়া যাবে।

কোভিড-১৯ মহামারির মধ্যে এই ঘূর্ণিঝড় সৃষ্ট হওয়ায় সব ধরনের স্বাস্থ্য বিধি মেনে লোকজনদের আশ্রয়কেন্দ্রে রাখার ব্যবস্থা করা হবে জানান ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী।

তিনি বলেন, সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করে আশ্রয়কেন্দ্রে সবাইকে নিরাপদে রাখতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। যারা আশ্রয়কেন্দ্রে আসবেন, তাদের সবাইকে মাস্ক পরে আসতে বলা হয়েছে। স্বেচ্ছাসেবকরা মাইকিং করে সবাইকে আশ্রয়কেন্দ্রে আনতে কাজ শুরু করেছেন।

বঙ্গোপসাগরে অবস্থানরত ঘূর্ণিঝড় আম্পান আজ বুধবার সন্ধ্যায় দেশের সমুদ্র উপকূল অতিক্রম করতে পারে। এ সময় স্বাভাবিকের চেয়ে ১০ থেকে ১৫ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস হতে পারে।আজ সন্ধ্যার দিকে ঘূর্ণিঝড় আম্পান দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সুন্দরবন নিকটবর্তী উপকূল দিয়ে অতিক্রম করা শুরু করবে। এলাকা পেরিয়ে যেতে প্রায় ২ থেকে ৩ ঘণ্টার মতো সময় লাগতে পারে।

আজ সকালে আবহাওয়া অধিদপ্তরের বিশেষ বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, ঘূর্ণিঝড় আম্পান আজ সন্ধ্যার মধ্যে সুন্দরবনের কাছ দিয়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশ উপকূল অতিক্রম করতে পারে। ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের ৮৫ কিলোমিটারের মধ্যে বাতাসের একটানা সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘণ্টায় ২০০ কিলোমিটার, যা দমকা অথবা ঝোড়ো হাওয়ার আকারে ২২০ কিলোমিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি পাচ্ছে।

আবহাওয়া দপ্তরের বিশেষ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ঘূর্ণিঝড় আম্পান বঙ্গোপসাগরে উত্তর-পূর্ব দিকে অগ্রসর হয়েছে। এটি আজ বুধবার দুপুর চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দর থেকে ৪৮০ কিলোমিটার, কক্সবাজার উপকূল থেকে ৪৭০ কিলোমিটার, মোংলা সমুদ্রবন্দর থেকে ২৯০ ও পায়রা সমুদ্রবন্দর থেকে ৩২০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থান করছিল। এ কারণে মোংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দরকে ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত এবং চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর ও কক্সবাজার উপকূলীয় এলাকাকে ৯ নম্বর বিপদ সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে।

আম্পানের প্রভাবে সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, বরগুনা, পটুয়াখালী, বরিশাল, ভোলা, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর এবং এসব জেলার অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরাঞ্চলে ১০ থেকে ১৫ ফুটেরও বেশি উচ্চতায় জলোচ্ছ্বাস হতে পারে। এসব জেলার অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরাঞ্চলে ১৪০ থেকে ১৬০ কিলোমিটার বেগে ঝোড়ো বাতাসসহ অতিভারী বৃষ্টি হতে পারে। তাই উত্তর বঙ্গোপসাগর ও গভীর সাগরে থাকা নৌযানগুলোকে দ্রুত নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে বলা হয়েছে।

আবহওয়াবিদ বজলুর রশিদ জানিয়েছেন, মূলত বাংলাদেশ ও ভারতের সীমান্তের সুন্দরবন অংশে ঘূর্ণিঝড়টির মূল অংশ আঘাত হানতে পারে।

“ঝড়ের মূল অংশ সুন্দরবন অংশে এলেও এর প্রভাব পড়বে চারদিকেই। তবে এখনো এটি এক হাজার কিলোমিটারেরও বেশি দূরে। তাই নানা পরিবর্তনের সুযোগ রয়েছে,” বলছিলেন মিস্টার রশিদ।

তার মতে, ঝড়টি ভারতের দীঘা থেকে বাংলাদেশের সন্দ্বীপ এলাকার মধ্য দিয়ে যাবে এবং এর মূল অংশ ভারত বাংলাদেশ সীমান্তের সুন্দরবন অংশে আসবে।

এদিকে আম্পান ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলায় বাংলাদেশ নৌবাহিনী গভীর সমুদ্র ও উপকূলীয় এলাকায় তিন স্তরের উদ্ধার ও ত্রাণ সহায়তায় প্রস্তুত রয়েছে। সেই সাথে নৌবাহিনীর ২৫টি জাহাজ প্রস্তুত রাখা হয়েছে।আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদফতর (আইএসপিআর) এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানিয়েছে।

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী বেসামরিক প্রশাসনের সঙ্গে দুর্যোগ পূর্ববর্তী ও দুর্যোগ পরবর্তী কার্যক্রমের অংশ হিসেবে নিজস্ব উৎস থেকে ১৮ হাজার ৪০০টি ত্রাণের প্যাকেট তৈরি করেছে। এছাড়াও ৭১টি ছোট মেডিকেল টিম প্রস্তুত রেখেছে। ১৪৫টি ছোট দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা টিম বিশেষ সরঞ্জামাদিসহ সংক্ষিপ্ত নোটিশে মোতায়েনের জন্য প্রস্তুত রয়েছে। ভূমিধ্বস বিষয়ে অভিজ্ঞতা সম্পন্ন বিশেষ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা টিম বলপূর্বক বাস্তুচ্যুত মিয়ানমার নাগরিকদের রক্ষায় কক্সবাজার রোহিঙ্গা ক্যাম্পে মোতায়েনের জন্যও প্রস্তুত রয়েছে।

বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়েছে, এছাড়াও ৩১৩টি স্পিডবোট, ১৫টি পানি বিশুদ্ধকরণ প্ল্যান্ট, ২৩৯ আউট বোর্ড মোটর, চারটি জাপানিজ উদ্ধার বোর্ড, ছয়টি ফাইবার গ্লাস বোর্ড, ১১৫টি শার্ক বোর্ড এবং দুইটি ল্যান্ডিং ক্রাফট ভেহিক্যাল প্রস্তুত রয়েছে। আর্মি এভিয়েশন উদ্ধার ও ত্রাণ বিতরণ এর জন্য প্রস্তুত রয়েছে।

ঘুর্ণিঝড় আম্পান’ পরবর্তী জরুরি উদ্ধার, ত্রাণ ও চিকিৎসা সহায়তাসহ যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবেলায় তিন স্তরের প্রয়োজনীয় বাংলাদেশ নৌবাহিনী নিয়েছে বলে উল্লেখ করা হয় বিজ্ঞপ্তিতে। বলা হয়, এরই মধ্যে চট্টগ্রাম, খুলনা ও মোংলা নৌঅঞ্চলে নৌবাহিনীর ২৫টি জাহাজ সমুদ্র ও উপকূলীয় এলাকায় দ্রুততম সময়ে জরুরি উদ্ধার, ত্রাণ এবং চিকিৎসা সহায়তা প্রদানের জন্য প্রস্তুত রাখা হয়েছে।

পাশাপাশি ঘূর্ণিঝড় পরবর্তী সমুদ্র ও উপকূলীয় এলাকায় অনুসন্ধান কাজের জন্য নৌবাহিনীর দুইটি মেরিটাইম পেট্রোল এয়ার ক্রাফট এবং দুইটি হেলিকপ্টার প্রস্তুত রাখা হয়েছে। সেইসঙ্গে খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, বরগুনা, পটুয়াখালী, বরিশাল, পিরোজপুরসহ উপকূলীয় দুর্গত এলাকাগুলোতে মোতায়েনের জন্য নৌ কন্টিনজেন্ট প্রস্তুত রাখা হয়েছে।

উদ্ধার কাজে প্রথমে নৌবাহিনীর দু’টি মেরিটাইম পেট্রোল এয়ারক্রাফট ও দু’টি হেলিকপ্টারের মাধ্যমে বঙ্গোপসাগরে অনুসন্ধান কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে। তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে নৌবাহিনী জাহাজগুলো পরে উদ্ধার তৎপরতা ও ত্রাণ সহায়তা পরিচালনা করবে।

এছাড়াও বিমান বাহিনীর সব এয়ারক্রাফট ঘূর্ণিঝড় পরবর্তী ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ, চিকিৎসা ও উদ্ধার অভিযানের জন্য প্রস্তুত রয়েছে। বিমান বাহিনীর এয়ারক্রাফট গুলোর মধ্যে রয়েছে ছয়টি পরিবহন বিমান ও ২২টি হেলিকপ্টার।