মির্জা ইমতিয়াজ শাওন : ওমরাসহ সৌদি, মধ্যপ্রচ্যগামী যাত্রীরা অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছেন। কোনো প্রকার কারণ ছাড়াই হঠাৎ প্রত্যেক ওমরাহ টিকিটের দাম ব্যপক হারে বৃদ্ধি পাওয়ায় ওমরাসহ সৌদি-মধ্যপ্রাচ্যগামী যাত্রীরা চরম বিপাকে পড়েছেন। টিকেট সমূহ ভয়ংকর সিন্ডিকেটের পুরোপুরি নিয়ন্ত্রনে চলে যাওয়া ও দেশি বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলোর টিকিটের মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে সরকারের কোনো প্রকার নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা না থাকায় এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে। ফলে যখন তখন ওমরাহ টিকিটের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে।
দেশি সিন্ডিকেট ও বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলো ওমরাহ টিকিটের দাম অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি করে কোটি কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা হাতিয়ে নিচ্ছে। সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে নির্বিকার। ওমরাযাত্রীরা চড়া দামে টিকিট কিনতে গিয়ে অতিরিক্ত টাকা জোগাতে হিমসিম খাচ্ছেন। তারা দ্বারে দ্বারে ঘুরেও সহনীয় পর্যায়ের ওমরাহ টিকিট পাচ্ছে না। একাধিক ভুক্তভোগি ওমরাযাত্রী এ তথ্য জানিয়েছেন। ওমরা টিকিটের ওপর আবারো শকুনের থাবা পড়েছে। বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলোর নাম ছাড়া বুকিং দেখিয়ে ওমরা টিকিট বিক্রির (সেলস পলিসি) সুবাধে টিকিট সিন্ডিকেটগুলো মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে। বিমানসহ বিভিন্ন এয়ারলাইন্সে ওমরা টিকিট পাওয়া যাচ্ছে না। শতবার চেষ্টা করেও বিমানের সিষ্টেমে কোনো ওমরাযাত্রীর টিকিট মিলছে না।
যাত্রীরা বলছেন, দেশের বাইরে কমে টিকিট মিললেও দেশে তা অধরা। এজেন্সিগুলোর অভিযোগ, গ্রুপ টিকিট কালোবাজারিদের দৌরাত্ম্যে ব্যবসা করতে পারছেন না তারা।
অভিযোগ রয়েছে, একটি চক্রের কারণেই দেশ থেকে টিকিট কাটতে হয় প্রায় দ্বিগুণ দামে। বিমানের অসাধু কর্মকর্তাদের যোগসাজসে সিন্ডিকট চক্র ওমরা টিকিট ব্লক করে রাখার গুরুতর অভিযোগ উঠছে। ওমরা টিকিটের জন্য হাহাকার অবস্থা বিরাজ করছে। এক মাস ধরণা দিয়ে বিমানের মতিঝিল অফিস থেকে একটি ওমরা টিকিট কিনতে সক্ষম হননি একাধিক হজ এজেন্সির মালিক। আবার বেশি টাকা দিলে চিহ্নিত এজেন্সি থেকে বিমানের টিকিট মিলছে।
কতিপয় টিকিট কালোবাজারীর কাছে নাম পাসপোর্ট নাম্বার ছাড়া ব্লক করে রেখে ওমরাহ টিকিটের দাম বাড়াচ্ছে। আটাব সভাপতি বলেন, এয়ারলাইন্সগুলো ওমরাযাত্রীদের রক্ত চুসে খাওয়ার জন্য ওঁৎ পেতে বসে আছে। এসব দেখার কেউ নেই। বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় এবং সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষ এব্যাপারে নীরব ভূমিকা পালন করছে। তিনি বলেন, বিমান ন্যাশনাল ক্যারিয়ার। প্রতেক নাগরিকের অধিকার রযেছে বিমানের টিকিট ক্রয় করে হজ ও ওমরায় যাওয়ার। কিন্ত অবস্থার দৃষ্টিতে মনে হচ্ছে এই সংস্থাটি সিন্ডিকেটের দখলে চলে গেছে। তিনি বলেন, ওমরা টিকিটের দাম অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পাওয়ায় বর্তমানে ১৭ হাজার টাকা থেকে ২০ হাজার টাকা বেশি দিয়ে টিকিট কিনতে হচ্ছে। এতে ওমরাযাত্রী এবং ওমরা এজেন্সির মালিকদের মাঝে প্রতিনিয়ত বাকবিতা- হচ্ছে।
এজেন্সি সংশ্লিষ্টদের মতে, চলতি মৌসুমে ভোগান্তি চরমে ওমরাহ টিকিট নিয়ে। এয়ারলাইনসগুলোর সহায়তায় গ্রুপ টিকিট বুকিংয়ের কালোবাজারিতে বিনিয়োগ করে রাঘব-বোয়ালরা। এতে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে সৌদি আরবসহ পর্যটন সংশ্লিষ্ট অনেক দেশে যেতে প্রতি টিকিটে বাড়তি ভাড়া গুণতে হচ্ছে।
ট্রাভেল এজেন্ট ব্যবসার সথে জড়িত প্রবীণ এক ব্যবসায়ী জানান, চাহিদা বাড়লে দাম বাড়বে, এটা নতুন কিছু নয়। তবে যদি তিন-চার গুণ বেড়ে যায়, তখন স্বাভাবিকভাবেই তা সবার নজরে পড়ে। কিন্তু নজরে এলেও বিমানের টিকিটের বেলায় যেন অসহায় হয়ে পড়েন যাত্রীরা। বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন রুটের সিট যাত্রীর নাম ও পাসপোর্ট নম্বর ছাড়া পিএনআর তৈরির মাধ্যমে ফ্লাইটের কয়েক মাস পূর্বে ব্লক করে টিকিট মজুদতারী করা হয়। আর এই ব্লকড টিকিটগুলো বেশি দামে কালোবাজারী করে একটি সিন্ডিকেট। সিন্ডিকেট বিশেষভাবে কম মূল্যের সিটগুলো গ্রুপ বুকিং করে ব্লক করার ফলে অন্যান্য ট্রাভেল এজেন্ট বা যাত্রীরা সেগুলো পায় না। এতে সিটের সংকট হয় এবং উচ্চমূল্যে টিকিট বিক্রি করা হয়।
এভিয়েশন খাতসংশ্লিষ্ট মহল বলছে, বিদেশি এয়ারলাইনসগুলোর বিপুল ডলার আটকে থাকা এবং সিন্ডিকেটের কারণে চাহিদা বাড়লেই লাগামছাড়া হয়ে উঠছে বিমানের টিকিটের দাম। বর্তমানে দেশের এভিয়েশন বাজারের ৮০ ভাগের নিয়ন্ত্রণই বিদেশি এয়ারলাইনসগুলোর হাতে। ‘ডলার লেনদেনের এ পরিস্থিতির কারণে বাংলাদেশ সম্পর্কে বহির্বিশ্বে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হবে। ইমেজ সংকট তৈরি হবে। বিদেশি এয়ারলাইনস, যারা ভবিষ্যতে বাংলাদেশে অপারেট করতে চায়, ডলারের এই লেনদেন দেখে তারা নিরুৎসাহিত হবে।’ পরিস্থিতি দীর্ঘস্থায়ী হলে বিদেশি এয়ারলাইনসগুলো বাংলাদেশ থেকে নতুন ফ্লাইট শুরু করার বিষয়ে আগ্রহ হারাবে।
চড়া দামে অতিরিক্ত টাকা দিয়ে ওমরাহ টিকিট কিনতে যাত্রীরা হিমসিম খাচ্ছেন। রাষ্ট্রীয় বিমান সংস্থার ‘অসাধু কর্মকর্তাদের’ যোগসাজশে সউদী রুটের ওমরার টিকিট অগ্রিম বুকিংয়ের নামে ব্লক করে ফেলা হয়েছে। তবে চাহিদামাফিক অতিরিক্ত টাকা দিলে ঠিকই মিলছে বিমান টিকিট। ওমরাযাত্রীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। কিন্ত ফ্লাইট সংখ্যা কম। ওমরাযাত্রীদের সুবিধার্থে সকল এয়ারলাইন্সগুলোকে অতিরিক্ত ফ্লাইট চালুর জোর দাবি জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট মহল।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশি-বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলোর টিকিটের মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে সরকারের নিয়ন্ত্রণ না থাকায় দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলো ওমরাহ টিকিটের দাম অস্বাভাবিকভাবে বাড়িয়ে কোটি কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা হাতিয়ে নিচ্ছে।
নভেম্বর, ডিসেম্বর জানুয়ারী, ফেব্রুয়ারীতে ওমরা টিকেটের চাহিদা বেশি থাকে এ চাহিদা রমজান মাসে আরো বেড়ে যায়। রমজান মাসে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক ধর্মপ্রাণ মুসলমান সৌদি আরবে ওমরা পালন করতে যান। আগামী মার্চে রমজান মাস। এ সুযোগে বিভিন্ন এয়ারলাইন্সের কিছু অসাধু কর্মকর্তা সিন্ডিকেট করে টিকিটের দাম বাড়িয়েছে। প্রতি রিটার্ন টিকিটের মূল্য ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা বাড়ানো হয়েছে। বাংলাদেশ বিমান ও সাউদিয়া এয়ারলাইন্স ছাড়াও থার্ড ক্যারিয়ারগুলোর ওমরাহ টিকিটের দাম হঠাৎ বাড়ানো হয়।
নভেম্বরে সৌদিয়া এয়ারলাইন্সের টিকিটের দাম ছিল জনপ্রতি ৭৫ হাজার টাকা। ডিসেম্বরে পাঁচ হাজার টাকা বেড়ে দাঁড়ায় ৮০ হাজার টাকা। জানুয়ারি মাসে টিকিট বিক্রি হয় ৮৫-৯০ হাজার টাকায়। আগামী ফেব্রুয়ারি মাসের টিকিট বিক্রি হচ্ছে ৯৫ হাজার টাকা। মার্চ মাসের টিকিট পাওয়া যেন দুষ্কর। মার্চে ওমরাহ হজের অগ্রিম টিকিট কিনতে হচ্ছে আসা-যাওয়া এক লাখ ১০-২০ হাজার থেকে এক লাখ ৫০ হাজার টাকা মূল্যে। প্রায় একই পরিস্থিতি বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সেরও। মার্চ মাসের একটি রিটার্ন টিকিটের সর্বনিম্ন মূল্য দেখা গেছে ৯৮ হাজার টাকা পর্যন্ত।
বিভিন্ন সূত্র অভিযোগ করেছে, সৌদিয়া এয়ার লাইন্স, এয়ার অ্যারাবিয়া, গালফ এয়ার, জাজিরা এয়ারলাইন্সসহ বিভিন্ন এয়ারলাইন্সের হাজারো টিকিট কিছু কালোবাজারির কাছে কুক্ষিগত রয়েছে। টিকিট বিক্রির সিস্টেমে ঢুকলে দেখা যাচ্ছে কোনো টিকিট নেই। সব বিক্রি হয়ে গেছে। প্রকৃত ঘটনা হচ্ছে-বিভিন্ন এয়ারলাইন্সের অসাধু কর্মকর্তারা এসব টিকিট ব্লক করে রেখে দিয়েছেন। তারা কিছু নির্দিষ্ট এজেন্সির মাধ্যমে চড়া দামে বিক্রি করছেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চাহিদা বাড়ার সাথে সাথে বিশেষ ব্যবস্থায় ফ্লাইট সংখ্যা বাড়াতে হবে বিশেষ করে নভেম্বর, ডিসেম্বর, জানুয়ারী ও রমজান মাসে ওমরাহ যাত্রীদের জন্য অতিরিক্ত ফ্লাইট পরিচালনা করতে হবে। চট্টগ্রাম থেকে সৌদি আরব, মধ্যপ্রাচ্যের নানা গন্তব্যে আরো নিয়মিত ফ্লাইট, ঢাকা হয়ে কানেকটিং ফ্লাইট চালু করলে পরিস্থিতি সামাল দেয়া সম্ভব। পণ্য বাজারের মতোই এ খাতের সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণে কাজ করতে হবে সরকারকেই। সাপ্লাই চেইন বিশেষজ্ঞ মুজিবুল হক বলেন, এ খাতে কারা সিন্ডিকেট করছে সেটি সরকারকেই খুঁজে বার করতে হবে। সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণে বিমান মন্ত্রণালয়ের মনিটরিং টিম গঠন করা যেতে পারে। অভিযুক্তদের শাস্তির আওতায় এনে সিন্ডিকেট ভাঙতে হবে।