গুম হওয়া ব্যক্তিদের ফেরত চাই

    “বলা হচ্ছে দেশ দ্বিতীয়বার স্বাধীন হয়েছে, স্বাধীন দেশে আমার বাবাকে ফেরত চাই।”

    কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে দাঁড়িয়ে কান্নাভেজা কণ্ঠে কথাগুলো বলছিল কিশোরী আনিশা ইসলাম। তার বাবা ইসমাইল হোসেন বাতেন ২০১৯ সালের ১৯ জুন শাহ আলী মাজার সংলগ্ন তার কাঠের দোকান থেকে নিখোঁজ হন। এরপর আর তার খোঁজ মেলেনি।

    গত পাঁচ বছর ধরে বাবার ছবি হাতে নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় প্রতিবাদে অংশ নিয়েছেন আনিশা। তার ছোট ভাই প্রতি রাত অপেক্ষা করত, বাবা কখন ফিরবে।

    আওয়ামী লীগের স্বৈরশাসনের অবসানের পর চারদিকে যখন গুম-খুনের অবসান আর ন্যায়বিচারের প্রতিশ্রুতি আসছে, আনিশাও চান তার পরিবার ন্যায়বিচার পাক।

    “আমি আমার ভাইয়ের প্রশ্নের উত্তর দিতে চাই। সবাইকে জানিয়ে দিতে চাই, আমার বাবার সঙ্গে কী হয়েছে।”

    গত ১৫ বছর শেখ হাসিনার শাসনামলে গুম হওয়া ব্যক্তিদের ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি নিয়ে শুক্রবার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে মানববন্ধনে জড়ো হয়েছিল আনিশাদের মত বহু পরবার। তাদের দাবি, অবিলম্বে গুম ব্যক্তিদের পরিবারের কাছে ফেরত দিতে হবে।

    একইসঙ্গে ‘আয়নাঘর’ তৈরি করার পেছনের কারিগর সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার নিরাপত্তা উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিক, জাতীয় টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের (এনটিএমসি) সাবেক মহাপরিচালক জিয়াউল আহসানসহ এতে জড়িতদের বিচার দাবি করেন তারা।

    আন্তর্জাতিক গুম প্রতিরোধ দিবস উপলক্ষে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে এই মানববন্ধনের আয়োজন করে গুম হয়ে যাওয়া ব্যক্তিদের স্বজনদের সংগঠন ‘মায়ের ডাক’। গুম হওয়া ব্যক্তিদের ছবি নিয়ে তাতে অংশ নেন স্বজনরা। কথা বলতে গিয়ে অনেকে কান্নায় ভেঙে পড়েন। তাদের আহাজারিতে ভারি হয়ে উঠে পুরো এলাকা।

    আনিশা বলে, “আমার বাবা জীবিত নাকি মৃত সেটা অন্তত আমি জানতে চাই। যারা মারা যায়, তাদের কবর জিয়ারত করা যায়, কিন্তু আমরা এমনই হতভাগা, আমরা জানি না আমাদের বাবা জীবিত নাকি মৃত।

    “আমি আমার স্কুলের কোনো কাজে বাবার সিগরেচার দিতে পারি না। নামের শুরুতে জীবিত না মৃত কিছুই লিখতে পারি না।”

    ২০১৭ সালের ২৫ অগাস্ট ধানমন্ডির স্টার কাবাবের সামনে থেকে নিখোঁজ হন ২০ বছর বয়সী ইশরাক আহমেদ। কানাডার ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়তেন তিনি। ২০১৭ সালে ছুটি কাটাতে ঢাকায় এসে নিখোঁজ হন।

    শহীদ মিনারে ইশরাকের বাবা জামাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, “আমার ছেলে যখন নিখোঁজ হয়, আমি রাত ১০টায় ধানমন্ডি থানায় গিয়েছিলাম জিডি করার জন্য । রাত সাড়ে ১০ টায় আমার বাসায় র‌্যাব আসে। পরে আমি র‌্যাব-২ এর মেজর আতাউরের কাছে যাই। পরদিন তারা আমার ছেলের ল্যাপটপ নিয়ে যায়। এক মাস পর ল্যাপটপ ফিরিয়ে দিলেও আমার ছেলেকে তারা ফিরিয়ে দেয়নি।

    “গত সাত বছর ধরে আমরা অপেক্ষা করছি। অনেক জায়গায় দৌড়াদৌড়ি করেছি। কিন্তু আমার ছেলেকে ফিরে পাইনি। নতুন সরকারের কাছে আমার দাবি, আমার ছেলেকে ফিরিয়ে দিন।আমরা এখনও অপেক্ষা করছি।”

    ২০১২ সাল থেকে নিখোঁজ পল্লবী থানার ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক তরিকুল ইসলাম তারা। শহীদ মিনারে তার বাবা নরুল ইসলাম বলেন, “রাজনৈতিক প্রতিহিংসা থেকে আমার ছেলেকে গুম করা হয়েছে। এতদিন আমরা রাস্তায় দাঁড়াতে পারি নাই। প্রেসক্লাবে একদিন বক্তব্য দেওয়ায় আমাকে দুদিন গুম করার চেষ্টা করেছে। এলাকাবাসী মাইক দিয়ে ডাকাত আসছে ঘোষণা করায় তারা আমাকে নিতে পারে নাই।

    “সন্তান হারিয়ে আমি আজ অসহায়। নতুন সরকারের কাছে আমার দাবি, আমার ছেলেকে অক্ষত অবস্থায় ফিরিয়ে দিন।”

    ২০১০ সালের ২৪ জুন রাজধানীর ফার্মগেট এলাকা থেকে সিটি করপোরেশনের ২০ নম্বর ওয়ার্ডের কমিশনার চৌধুরী আলমকে মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে যায় গোয়েন্দা সংস্থার পরিচয় দেওয়া লোকজন।

    চৌধুরী আলমের মেয়ে মাহফুজা আখতার মুক্তা বলেন, “বাবা হারিয়ে আমরা পাগলপ্রায়। তারপরও আমার রাস্তায় এসে দাঁড়াই, যদি আমার বাবার সন্ধান পাই। স্বাধীন দেশে গুম বলে কিছু থাকতে পারে আমি বিশ্বাস করি না।

    “গত সাড়ে ১৪ বছরের সাড়ে ছয়শর মত গুম করা হয়েছে। আমার এখন নতুনভাবে পথ দেখতে পাচ্ছি। নতুন সরকারের কাছে আমাদের দাবি, আমাদের মানুষগুলো ফেরত দিন।”

    ২০১৯ সালের ৯ এপ্রিল থেকে নিখোঁজ ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রাম কেন্দ্রিক সংগঠন ইউপিডিএফ-এর সংগঠক মাইকেল চাকমা। ঢাকার শ্যামলী থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল তাকে। পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে তাকে আটকে রাখা হয়েছিল গোপন বন্দিশালায়, যা ‘আয়নাঘর’ নামে পরিচিতি পেয়েছে।

    শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর গত ৬ অগাস্ট তাকে চট্টগ্রামের একটি সড়কের ধারে চোখ বেঁধে ছেড়ে দেওয়া হয়।

    শহীদ মিনারে মাইকেল চাকমা বলেন, “আমাকে ৫ বছর তিন মাস গুম করে রাখা হয়েছিল। আলো-বাতাসহীন দুনিয়া থেকো বিচ্ছিন্ন ছিলাম। এই কষ্টটা আমি জানি। দিনের পর দিন সেখানে শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়েই বেঁচে থাকতে হয়েছে। এটা শুধু বেঁচে থাকা নয়, অনেকটা মৃত্যুর মত। এটা বুঝি, গুম হওয়া ব্যক্তিদের পরিবার কত কষ্টে দিন কাটায়।

    “গত ১৫ বছরে শেখ হাসিনার আমলে কোনো ডেমোক্রেসি ছিল না। মানবাধিকার ছিল না, মানুষের নিরাপত্তা ছিল না। এই হাসিনার গত ১৫ বছরে যে গুম-খুন করেছে, তার একটা সুষ্ঠু ও ন্যায়বিচার হতে হবে।”

    মানববন্ধনে সংহতি জানিয়ে নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, “আমাদের এখন অতীতকে স্মরণ করে ভবিষ্যৎ গড়তে হবে। কল্পনাও করা যাবে না, গত সরকারের অধীনে পুলিশ কতটা অমানবিক ছিল। আমি ২৩ ঘণ্টা গুম ছিলাম, দুই মাস জেলে ছিলাম। সেময় এমন অনেক ঘটনা দেখেছি, সেগুলো লিখলে বিরাট এক বই হয়ে যাবে।

    “গুম নিয়ে মায়ের ডাকসহ অনেকেই তালিকা তৈরি করেছে, তার ৯৫ শতাংশের মত সঠিক, শতভাগ সঠিক করতে পারবেন কিনা জানি না “

    তিনি বলেন, “এই জুলাইয়ে কতগুলো মানুষ মারা গেছে। হয়ত হাজারের বেশি, আমরা বলতে চাই তাদের হত্যারও বিচার করতে হবে। যারা গুম-খুনের শিকার হয়েছেন, তাদের কাছে আমাদের যেতে হবে, সরকারকে যেতে হবে। আমরা যে মানবিক বাংলাদেশ গড়তে চাচ্ছি, সে বাংলাদেশে সকল মানুষকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।”

    বিপ্লবী ওয়াকার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল ইসলাম, এবি পার্টির যুগ্ম আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম, গুমের শিকার হয়ে মুক্ত হওয়া সাবেক রাষ্ট্রদূত মারুফ জামান, ‘মায়ের ডাক’ এর অন্যতম সমন্বয়ক সানজিদা ইসলাম তুলি উপস্থিত ছিলেন মানববন্ধনে।