প্রত্যাবাসনের দাবীতে ক্যাম্পে ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের বিক্ষোভ-সমাবেশ

ফারুক আহমদ, কক্সবাজার: মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যে মায়ানমার আর্মি ও আরাকান আর্মি কর্তৃক রোহিঙ্গাদের উপর সংঘটিত গণহত্যার স্মরণে এবং রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের দাবীতে কক্সবাজারের উখিয়া- টেকনাফের বিভিন্ন রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সমাবেশ অনুষ্টিত হয়েছে।

গতকাল রবিবার (২৫ আগষ্ট) উখিয়ার কুতুপালং এফডিএমএন ক্যাম্প ৪ এর ব্লক-বি, সাব ব্লক-বি/৬ সংলগ্ন ফুটবল খেলার মাঠে সমাবেশে বক্তব্য রাখেন রোহিঙ্গা মো: ফোরকান, ব্লক-এ/৬৩, ক্যাম্প-০৮/ওয়েস্ট এর পরিচালনায় সমাবেশে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন মৌলভি আব্দুর রহিম। বক্তব্য রাখেন মাস্টার কামাল, রোহিঙ্গা নেতা মোঃ মুসা, মৌলভী মোহাম্মদ সলিমুল্লাহ ও রোহিঙ্গা নেতা মাস্টার রোহিত। এ সময় কাসিম, ব্লক-ই/৭, ক্যাম্প-১ ইষ্ট, মুহাদ্দিস মাদ্রাসা-এ বেলাল (র:) এবং সদস্য, এফডিএমএন এডভাইজার কমিটির সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।
সমাবেশে অংশগ্রহনকারীরা গণহত্যা, নির্যাতন বিরোধী এবং নিজ দেশে ফেরার দাবি সম্বলিত ইংরেজি ও বার্মিজ ভাষায় লিখিত বিভিন্ন ব্যানার, প্ল্যাকার্ড, পোস্টার বহন করে। এছাড়া তারা বাংলাদেশ সরকারের প্রতি ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন এবং পাশাপাশি নিজ দেশে ফেরত যাওয়ার ব্যাপারে মায়ানমার সরকারের প্রতি চাপ প্রয়োগ করতে বাংলাদেশ সহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আবেদন জানান।
বক্তারা সেনাবাহিনীর হত্যা-ধর্ষণ ও নিপীড়নের মুখে রাখাইনের জন্মভূমি থেকে বাস্তুচ্যুত হওয়া রোহিঙ্গা শরণার্থীরা স্বদেশে ফেরার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। রোহিঙ্গা ঢল নামার সাত বছরের মাথায় (২৫ আগষ্ট) সকাল থেকে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের বিভিন্ন ক্যাম্পে লাখো শরণার্থী দ্রুত প্রত্যাবাসনের দাবিতে সমাবেশে দাবি উত্থাপন করেন। নিজ দেশে ফেরত যাওয়া আকুতি জানিয়ে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সমাবেশ করেছে লাখো রোহিঙ্গা।

এদিকে রোববার ভোর থেকে ব্যানার, ফেস্টুন নিয়ে উখিয়া ১৩ ও ১৮ নং রোহিঙ্গা ক্যাম্পের খেলার মাঠে জড়ো হতে থাকে রোহিঙ্গা নারী ও পুরুষ।

২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর হত্যাযজ্ঞ এবং ভয়াবহ নির্যাতনের মুখে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের বনভূমিতে আশ্রয় নেয়। আগে থেকে আশ্রয় নেওয়া সাড়ে তিন লাখসহ বর্তমানে ১২ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা বর্তমানে কক্সবাজারের ৩৩টি আশ্রয় ক্যাম্পে বসবাস করছে। কবে তারা স্বদেশে ফিরবে তা এখনও অনিশ্চিত।
তবে সরকারের শরণার্থী বিষয়ক কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন নিয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে আলোচনা চলছে। কিন্তু ৭ বছর হয়ে গেলেও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের নেই কোন অগ্রগতি। মিয়ানমার সরকার প্রত্যাবাসন নামে নাটক চালাচ্ছে। বিশ্ব নেতারাও সব অভিযোগ শুনার পর নিরবতা পালন করছে।
এদিকে, দিনের পর দিন রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বাড়ছে জন্মহার। সরকারি বা এনজিওর জরিপ মতে ১২ লাখ রোহিঙ্গা ধরা হলেও সাত বছরে বেড়েছে আরও অনেক। তাই দ্রুত রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন করা জরুরী বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
অপরদিকে রোহিঙ্গাদের একটি অংশ মাদক পাচার, অপহরণ, মানবপাচারসহ নানা ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। ফলে শরণার্থী আশ্রয় শিবিরগুলোতে প্রতিনিয়তই খুন-সংঘর্ষের মতো ঘটনা ঘটছে। এটা স্থানীয় মানুষদের নিরাপত্তাকেও হুমকির মুখে ফেলেছে।
নিজেদের দেশে ফেরত যাওয়ার দাবি জানিয়ে রোহিঙ্গারা প্রতিবছরই এদিনে তাদের ক্যাম্পে সমাবেশের আয়োজন করে থাকে। ২০১৯ সালের ২৫ অগাস্ট ক্যাম্পে প্রথম বড় সমাবেশ করা হয়, যার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মাস্টার মুহিবুল্লাহ। পরে তিনি মিয়ানমারের সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপ আরসার সন্ত্রাসীদের হাতে নিহত হন।

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সন্ত্রাস দমনের নামে ২০১৭ সালে সে দেশের সেনাবাহিনী রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর জাতিগত নিধন চালালে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে আসতে থাকে রোহিঙ্গারা। ওই বছরের ২৫ আগস্টের পর দু-তিন মাসের মধ্যেই উখিয়া ও টেকনাফে আশ্রয় নেয় সাড়ে সাত লাখের মতো রোহিঙ্গা। পরবর্তী সময়ে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে তাদের খাদ্য সহায়তা এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা হয়।
২০১৭ সালেই বাংলাদেশ মিয়ানমারের সঙ্গে রোহিঙ্গাদের স্বদেশে ফেরত পাঠানো নিয়ে দ্বিপক্ষীয় আলোচনা শুরু করে। পরবর্তী সময়ে কয়েক দফা রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ নেওয়া হলেও একজন রোহিঙ্গাও মিয়ানমারে ফেরত যায়নি।
রোহিঙ্গারা মনে করে, তাদের নাগরিকত্ব, জাতিগত পরিচয়, জায়গা-জমি ও গণহত্যার বিচারের নিশ্চয়তা না পেলে তারা মিয়ানমারে গিয়ে আবারও সেনাবাহিনীর নির্যাতনের মুখে পড়বে।
রোহিঙ্গা নেতা সৈয়দ উল্লাহ বলেন- আমরা কবে দেশে ফিরতে পারবো জানা নেই। ২৫ আগষ্ট আমরা সাত বছর পূর্তি উপলক্ষে ক্যাম্পের বিভিন্ন স্থানে সভা-সমাবেশ করছি। এই সমাবেশের মাধ্যমে আমরা বিশ্ববাসীকে জানিয়ে দিতে চাই, মিয়ানমারকে চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী যাতে স্বদেশে ফিরতে পারে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যেন সে উদ্যোগ নেয়।
আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস (এআরএসপিএইচ) এর সভাপতি মোহাম্মদ জুবাইর বলেন- ছোট এই বাংলাদেশে রোহিঙ্গারা দিন দিন বোঝা হয়ে যাচ্ছে। তাই, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি অনুরোধ, যেকোন উপায়ে মিয়ানমারকে চাপ সৃষ্টির মাধ্যমে বিপুলসংখ্যক এই রোহিঙ্গাদের স্বদেশে ফেরত পাঠানো হোক।

কক্সবাজার শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কার্যালয়ের অতিরিক্ত কমিশনার সামসুদ্দৌজা নয়ন বলেন – ২৫ আগষ্ট রোহিঙ্গা আগমনের সাত বছর পেরিয়ে আট বছরে পদার্পণ করেছে। ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের তাদের মতো করে সভা-সমাবেশের অনুমতি দেয়া হয়েছে । এর অংশ হিসেবে রোহিঙ্গা শিশুদের চিত্রাঙ্কন থেকে শুরু করে বিভিন্ন অনুষ্ঠানমালা করছে।
তিনি বলেন, রাখাইনে এখন যুদ্ধ চলছে। সেখানকার পরিস্থিতি খুব খারাপ। ওখানকার যুদ্ধের গোলাবারুদের শব্দে এপারের মানুষ পর্যন্ত ভয়ে তটস্থ। কবে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন হবে সে তথ্য আমার কাছে নেই। অবশ্য, নতুন করে যাতে আর কোনও রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করতে না পারে সে ব্যাপারে সীমান্তে বিজিবি শক্ত অবস্থানে আছে।