পৃথিবীটা কি শুধু মানুষের?

 

লায়েকুজ্জামান:: দু’দেশের দু’টি ছোট্ট খবর এসেছে গণমাধ্যমে। একটি বাংলাদেশের অপরটি ভারতের। করোনাভাইরাস ঘোষণার পর পর্যটক নিষিদ্ধ কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত এখন জনমানব শূন্য। নেই মানুষের দাপাদাপি-হুড়ো-হুড়ি। সমুদ্র সৈকতের তীর ঘেঁষে এখন নাকি খেলা করছে হাজার হাজার ডলফিন। এতদিন মানুষের কারণে সৈকতের কাছে আসেনি তারা। এখন সৈকত যেন তাদের, যা এতদিন ছিল মানুষের। ভারতের খবরটি হলো রূপ বদলেছে যমুনার জল। শিল্প-কলকারখানার দূষিত বর্জ্যে যা এতদিন ছিল কালো ও দূষিত।

মাত্র এক মাসের লকডাউনে চিত্র বদলে গেছে গোটা দুনিয়ার। আমাদের এই ঢাকা এখন মনে হয় একটি বাসযোগ্য নগরী, গণপরিবহনের কালো ধুয়া নেই। কান ফাঠানো আওয়াজ নেই। নেই কোলাহল। সে দিন এক ছোট ভাই বলছিল, সিঙ্গাপুরের একটি সড়কের কথা। সবুজে শোভিত নিরিবিলি ওই সড়কটি ছিল ছোট ছোট গ্রুপে বিভক্ত হয়ে বন্ধু বা প্রেমিক-প্রেমিকাদের আড্ডা দেওয়ার জায়গা। সকাল থেকে গভীর রাত অবধি লেগে থাকতো ভিড়। করোনাভাইরাস দেখা দেওয়ার পর ওই সড়কটির একটি ছবি পাঠিয়েছে ওই ছোট ভাইয়ের এক সিঙ্গাপুরবাসী বন্ধু। সড়কে কোনো মানুষ নেই, নেই কোনো প্রেমিক জুটি। সেখানে ঘুরে বেড়াচ্ছে কিছু হরিণ, একটি হরিণ আরেকটি হরিণের কাঁধে মাথা রেখে শুয়ে আছে। মনে হচ্ছে ওরা গভীর প্রেমে মত্ত।

পৃথিবী নামের এই গ্রহটাতে সৃষ্টিকর্তা শুধু মানুষই সৃষ্টি করেনি। সব ধর্মমতই বলে সকল জীবের সৃষ্টিকর্তা একজনই। কারো কাছে তিনি আল্লাহ, কারো কাছে ঈশ্বর,কারো কাছে বা গড। যে নামেই ঢাকা হোক তিনি একজনই। আমরা মুসলিমরা বিশ্বাস করি আল্লাহ থাকেন সপ্তম আসমানে। ইতালির প্রধানমন্ত্রী ইসলাম ধর্মের বিশ্বাসী নন, করোনায় যখন একেবারে কাবু ইতালি; সে সময়ে দেশটির প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, আমরা অসহায়-এখন উপরওয়ালাই ভরসা।

পৃথিবীর সকল ধর্ম একটি জায়গায় একমত হয়েছে তা হলো মানুষ। সব ধর্মই মানুষকে শ্রেষ্ঠ ও বিবেক-বুদ্ধিসম্পন্ন হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। পবিত্র কোরআনে মানুষকে বলা হয়েছে ‘আশরাফুল মুকলুকাত’ মানে মানুষ সৃষ্টজীবের সেরা। সনতন ধর্মে বিশ্বাসীদের পবিত্র গ্রন্থ বেদে বলা হয়েছে ‘ন-মনুষ্যত্বং তরপরং বাচ্যং’ মানে মানবজীবন হচ্ছে শ্রেষ্ঠ। বাইবেলে বলা হয়েছে ‘গড হ্যাজ মেইড ম্যান আফটার হিজ ওউন ইমেজ’ মানে সৃষ্টিকর্তা তারপরই মানুষের স্থান দিয়েছেন। একমাত্র মানুষকেই বুদ্ধি-ও বিবেক সম্পন্ন করে পাঠানো হয়েছে। আল্লাহতালা যখন মানুষ সৃষ্টির কথা বলেছিলেন, তখন ফেরেশতারা বলেছিলেন, তারা দুনিয়াতে গিয়ে নানা ফ্যাতনা-ফ্যাসাদ করবে। সে কারণেই মানুষকে বিবেক দিয়ে পাঠানো হয়। যাতে মানুষ বিবেক দিয়ে নিজেকে পরিচালিত করতে পারে এবং অপরের ক্ষতির কারণ না হয়ে ওঠে।

কিন্ত সেই বিবেকবান মানুষ পৃথিবীতে এসে কি বিবেক দ্বারা পরিচালিত হয়েছে? না, বেশির ভাগই হয়নি। মানুষ নিজেকে শ্রেষ্ঠ মনে করে ধরেই নিয়েছে পৃথিবীটা তার একার। আজ যেমন আমরা করোনা থেকে বাঁচতে সৃষ্টিকর্তার অনুগ্রহ কামনা করছি। পৃথিবীর অন্য জীবেরা হয়তো শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে মানুষের অত্যাচার থেকে বাঁচার জন্য প্রার্থনা করেছে। ওই সব জীবের ভাষা তার সৃষ্টিকর্তা ঠিকই বুঝেছেন। আমরা মানুষেরা তা বুঝিনি।

মানুষের কারণে পৃথিবী থেকে বহু জীবের অস্থিত্ব বিলুপ্ত হয়েছে। আমরা বোমা বানিয়ে যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে। কারখানা বানিয়ে বায়ু দূষণ করেছি। পানি দূষণ করেছি। বহু জীবকে হত্যা করেছি। ধর্মের নামে বর্ণের নামে নিজেরা হানাহানি করছি। একে অপরকে খুন করে উল্লাস করছি। আমরা মানুষেরা একবারও কি ভেবেছি আমাদের কারণে যে সকল জীবের অস্থিত্ব বিপন্ন হচ্ছে তাদের ও আমাদের সৃষ্টিকর্তা একই। না, তা ভাবনি।

নগর গড়ার নামে আমরা গাছপালা কেটেছি। পাখীর আবাস ভেঙে গুড়িয়ে দিয়েছে। নদী ভরাট করেছি। সমুদ্রে হানা দিয়েছি। আমরা মানুষেরা কি করিনি। মনে পড়ে আয়লান কুর্দির দুনিয়া কাঁপানো সে ছবির কথা। যে নিস্পাপ শিশুটির নিথর মরদেহ পড়েছিল সমুদ্র সৈকতে। মনে পড়ে বোমার আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত সিরীয় ও সেই শিশুটির কথা আহত হয়ে যে বলেছিল ‘আমি ঈশ্বরকে সব বলে দেবো’। হয়তো অন্যর জীবেরা সে রকম কথাই ঈশ্বরকে বলেছে-তার সৃষ্টিকর্তাকে বলেছে-আমরা মানুষেরা তাদের ভাষা জানি না বলে বুঝিনি।

পৃথিবীতে আমাদের আগে বহু মানব জাতির ধ্বংস হয়েছে। নূহ (আ.) এর সময়ে যারা অরজকতা সৃষ্টি করেছিল আল্লাহতালা তাদের ধ্বংস করেছিলেন। মহা প্লাবন দিয়ে। যারা নূহ (আ.) এর নৌকায় ওঠেনি, তাদের মৃত্যু হয়েছিল। পৃথিবীতে এ রকম সভ্যতা অনেকবার এসেছে, আবার ধ্বংস হয়েছে। আজকের করোনা নিয়ে আমরা যা ভাবছি সেটা আমাদের বেঁচে থাকা নিয়ে।

পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেছেন, ‘আমি যা জানি তোমরা তা জানো না।’ হয়তো এমনও হতে পারে করোনার আঘাতে বর্তমান মানব ও সভ্যতা শেষ হয়ে গেল, কেউ কেউ বেঁচে থাকলেন, তাদের জন্য আল্লাহতালা একটি বাসযোগ্য পৃথিবী গড়ে দেবেন। প্রয়াত বিজ্ঞানী স্টেফেন হকিং একবার ওবামাকে বলেছিলেন, পৃথিবী মানুষের বাসযোগ্য নয়। মানুষের জন্য অন্য একটি গ্রহ খোঁজতে হবে।

পবিত্র কোরআনের সুরা বনি ইসরাইলে আল্লাহ বলেছেন, ‘যখন আমি কোনো জনপদকে ধ্বংস করার ইচ্ছা করি তখন তার অবস্থাপন্ন লোকদেরকে উদ্ধুদ্ধ করি। অতঃপর তারা পাপাচারে মেতে ওঠে। তখন সে জনগোষ্ঠীর ওপর আদেশ অবধারিত হয়ে যায়। অতঃপর আমি তাকে উঠিয়ে আছাড় দেই।’

তাই আমাদের ভাবা উচিত হয়তো একটি বাসযোগ্য পৃথিবীর জন্যই অবধারিত এই করোনাভাইরাস। আবার হয় তো তা নাও হতে পারে। সৃষ্টিকর্তাই জানেন। তবে সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ যে কতো অসহায়-একটি অদৃশ্য ভাইরাস তার প্রমাণ দিয়ে গেল। আমরা মানুষেরা শুধু অসহায়ই নয় -অতি নগণ্যও। এগুনো হয়নি কিছুই; যা করা হয়েছে তা শুধু অপরের ক্ষতি। নিজেকে বড় মনে করা।