চাহিদার চেয়ে কোরবানির পশু বেশি

অর্থনৈতিক সংকট ও করোনা মহামারির প্রভাবে গত কয়েক বছর কোরবানির পশুর চাহিদা ছিল কম। গত বছরও দেশের গবাদি পশু দিয়েই কোরবানির চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হয়েছে। এ বছর চাহিদা বাড়তে পারে, এ ধারণা থেকে বেশিসংখ্যক কোরবানির পশু প্রস্তুত করেছেন খামারিরা। পশু পালনের খরচ বেড়ে যাওয়ায় এবার পশুর দাম কিছুটা বেশি হতে পারে।

কিন্তু অর্থনৈতিকভাবে মধ্যবিত্ত শ্রেণি চাপে থাকায় পশু বিক্রি কম হওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে। এ নিয়ে কিছুটা দুশ্চিন্তা রয়েছে খামারিদের মধ্যে।

চলতি বছরে চাহিদা রয়েছে এক কোটি সাত লাখ কোরবানির পশুর। কিন্তু সারা দেশে এক কোটি ২৯ লাখ ৮০ হাজার ৩৬৭টি পশু প্রস্তুত রয়েছে।

এর মধ্যে গরু-মহিষ ৫৩ লাখ ৬১ হাজার, ছাগল-ভেড়া ৭৬ লাখ ১৮ হাজার এবং অনান্য পশু রয়েছে এক হাজার ৮৫০টি। ফলে চাহিদার চেয়ে ২২ লাখ ৭৮ হাজার অতিরিক্ত গবাদি পশু প্রস্তুত রয়েছে। এসব পশু অবিক্রীত থাকার আশঙ্কা রয়েছে। এর সঙ্গে চাহিদা অনুসারে বিক্রি না হলে সংখ্যাটা আরো বাড়তে পারে।

দেশে পশু প্রস্তুতে সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছে রাজশাহী বিভাগ। বিভাগটিতে ১৭ লাখের মতো পশু উদ্বৃত্ত থাকতে পারে। অন্যদিকে ঢাকা বিভাগে পশু ঘাটতি হতে পারে সাড়ে ৯ লাখ। এ ছাড়া চট্টগ্রাম বিভাগেও পশুর ঘাটতি রয়েছে।

এ বিষয়ে কৃষি অর্থনীতিবিদ ও ঢাকা স্কুল অব ইকোনমিকসের পরিচালক ড. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, চলতি বছর খামারিরা নানা কারণে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠায় রয়েছেন।

একদিকে চাহিদার তুলনায় বেশি পশু থাকা, অন্যদিকে খামারিদের পশু পালনে উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পাওয়ায় উদ্বেগ বাড়ছে। কয়েক সপ্তাহ ধরে চলা তীব্র খরা, এরপর ঘূর্ণিঝড়ের কারণে তীব্র ক্ষতির কবলে পড়েছেন পশু উৎপাদনকারী খামারিরা। হিট স্ট্রোকে হাজার হাজার গরু-ছাগল, মহিষ ও ভেড়া অসুস্থ হয়েছে। এতে পশুগুলোর ওজন কমেছে। সার্বিকভাবে বিপর্যয়ের মুখে পড়েছেন খামারিরা।

তিনি বলেন, পশুখাদ্যের উৎপাদন খরচ বৃদ্ধির কারণে খামারিরা আরো নাজেহাল পরিস্থিতিতে রয়েছেন। সার্বিকভাবে খামারিদের উৎপাদন খরচ ২০ থেকে ২৫ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। পশুকে বারবার গোসল করানো, টিনের চালে পাটের ভিজা বস্তা রাখা, স্যালাইন ও গ্লুকোজ খাওয়ানো এবং পাখা চালিয়ে কোনো রকমে সামাল দেওয়া হচ্ছে পরিস্থিতির। ভালো দাম না পেলে খামারিরা ক্ষতির কবলে পড়তে পারেন। আবার দাম বেশি হলে ভোক্তাদের মধ্যে চাহিদা কমে যেতে পারে। তাই সামনের দিনে খামারিদের সহায়তা বৃদ্ধির মাধ্যমে খরচ কমাতে পারলে ভোক্তারা কম দামে পশু কিনতে পারবে। তখন চাহিদা আরো বাড়ানো সম্ভব হবে। এতে খামারি ও ভোক্তা উভয়ই লাভবান হতে পারবে।

দুশ্চিন্তা বাড়াচ্ছে সীমান্ত দিয়ে অবৈধ পশুর প্রবেশ

ঈদের আগমুহূর্তে পশুর বিশেষ পরিচর্চায় ব্যস্ত খামারিরা। পশুর স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে তাঁরা খাবারের পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়েছেন। পশুগুলোকে হূষ্টপুষ্ট রাখতে কাঁচা ঘাস, খৈল, ভুসি, চালের খুদ-কুড়াসহ প্রাকৃতিক খাবার বেশি খাওয়ানো হচ্ছে। তবে কুমিল্লার খামারিরা সীমান্ত দিয়ে অবৈধভাবে পশু প্রবেশ নিয়ে বেশ দুশ্চিন্তায় রয়েছে। জেলার পাঁচটি উপজেলার প্রায় ১০৬ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে রয়েছে সীমান্ত। প্রতিবছরই কোরবানির ঈদের সময় অবৈধভাবে কমবেশি গরু প্রবেশ করে। এবারও জেলার খামারিরা শঙ্কায় আছেন। গম, ভুসি, ভিটামিন, ভুট্টাসহ অন্যান্য খাবারের দাম যে হারে বৃদ্ধি পেয়েছে তাতে সঠিক মূল্য পাওয়া যাবে কি না তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন খামারিরা। এ ছাড়া এবার পশু পালনে চিকিৎসা ব্যয় হয়েছে অনেক বেশি।

এ বিষয়ে কুমিল্লা নগরীর কালিয়াজুড়ি এলাকার নুরজাহান অ্যাগ্রোর খামারি মনির হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘পশু পালনে খরচ বৃদ্ধি ও খাবারের দামের সঙ্গে তাল মিলিয়ে গ্রাহকের চাহিদা অনুযায়ী পশু তৈরি করা কঠিন হয়ে গেছে। পশু পালনের জন্য সবই এখন বেশি দামে কিনতে হয়। ফলে পশুর দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে। আবার পশুর দাম শুনলে ক্রেতারা তাঁদের বাজেটের বাইরে চলে যাচ্ছে বলে জানাচ্ছেন। বর্তমান বাজারে ভোক্তাদের দামের সঙ্গে সমন্বয় করা খুবই কঠিন হয়ে যাচ্ছে। এ জন্য বিক্রিও কিছুটা কম হচ্ছে। পাশাপাশি অবৈধভাবে পশু প্রবেশ করলে আমরা দিন শেষে বিক্রিই করতে পারব না।’

এ বিষয়ে জেলার খামারিদের সংগঠন ডেইরি অ্যাসোসিয়েশন, কুমিল্লার সভাপতি ফরহাদ হোসেন বলেন, ‘আমরা একটি বছর পশু পালন করে লাভের স্বপ্ন দেখি। আর চোরাইভাবে পশু এসে প্রতিবারই আমাদের সেই স্বপ্ন নষ্ট করে দেয়। এবার অবৈধভাবে পশু প্রবেশ বন্ধে প্রশাসনকে আরো কঠোর হতে হবে। তা না হলে আমরা শেষ হয়ে যাব। অনেক নতুন খামারি আছেন, তাঁরা ধারদেনা করে খামার গড়েছেন। প্রতিবছর সড়কে চাঁদাবাজি, পরিবহনে বেশি ব্যয় ও ছিনতাইয়ের কারণেও অনেক খামারি নিঃস্ব হয়ে যায়। এসব নিয়ে খামারিরা উদ্বেগ-উত্কণ্ঠার মধ্যে রয়েছেন। সব বিষয়ে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে খামারিরা নিরুৎসাহিত হতে পারেন।’

অনলাইনে ১০ হাজার কোটি টাকার পশু বিক্রির প্রত্যাশা

প্রতিবছরের মতো এবার অনলাইনে বেচাকেনায় জোর দেওয়া হয়েছে। গত বছর অনলাইনে পশু বেচাকেনা হয়েছিল চার হাজার ২৩১ কোটি ৫৯ লাখ টাকার। অনলাইনে বিক্রি হয়েছিল চার লাখ ৬৩ হাজার ৯৬টি পশু। চলতি বছরে অনলাইনে বেচাকেনা ১০ হাজার কোটি টাকা ছাড়াতে পারে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

সার্বিক বিষয়ে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী মো. আব্দুর রহমান বলেছেন, ‘চলতি বছরে সারা দেশের খামারিরা নিরলস পরিশ্রমের মাধ্যমে কোরবানির জন্য পশু প্রস্তুত করেছেন। আমাদের হিসাবে চাহিদার চেয়ে বেশি পশু প্রস্তুত রয়েছে। ফলে কোরবানির পশু নিয়ে কোনো রকম সংশয়, সংকট বা আশঙ্কার কারণ নেই। আবার খামারিদের স্বার্থ সর্বোচ্চ সুরক্ষা দেওয়া হচ্ছে। এ জন্য অবৈধ উপায়ে গবাদি পশুর অনুপ্রবেশ যেন না ঘটতে পারে, সে জন্য সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। কোনোভাবেই পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে পশু আমদানি করা হবে না, আমদানির অনুমতিও দেওয়া হবে না।’

মন্ত্রী বলেন, ‘দেশের বাজারগুলোতে ক্রেতা-বিক্রেতা কেউ যেন অযথা হয়রানির শিকার না হয়, সেদিকে বিশেষ লক্ষ রাখা হবে। হাটে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় পর্যাপ্ত সদস্য নিয়োজিত থাকবেন। এ ছাড়া কোরবানির পশুর স্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে বাজারগুলোতে পর্যাপ্ত সুরক্ষাব্যবস্থা রাখা হবে। প্রতিটি নির্ধারিত কোরবানির পশুর হাটে ভেটেরিনারি মেডিক্যাল টিম থাকবে। কোরবানির পশু নিরাপদ ও কোরবানি উপযোগী কি না বা তাদের শরীরে দূষিত পদার্থ প্রবেশ করানো হয়েছে কি না, তারা সে বিষয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে জানাবেন। দেশের মানুষ যাতে নির্বিঘ্নে ভালো পশু কিনতে পারে, তার জন্য সর্বোচ্চ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।’

(প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছেন কালের কণ্ঠ’র সংশ্লিষ্ট এলাকার প্রতিনিধিরা)