আমরা মরি, কেবল আমাদের বাঁচার আকাঙ্ক্ষাটা মরে না

APRIL is the cruelest month, breeding
Lilacs out of the dead land, mixing
Memory and desire, stirring
Dull roots with spring rain.
T S Eliot, The waste land.
সত্যিই, এপ্রিল নিষ্ঠুরতম মাস। বাংলাদেশের দক্ষিণ জনপদে এপ্রিল কত নিষ্ঠুরভাবে আসে এবং কত গভীরে তার দাগ রেখে যায় তা বুঝার জন্য টি এস এলিয়টের কবিতা পড়ার দরকার নেই। উপকূলের মাটিলগ্ন মানুষের কাছে এপ্রিল কার্যত মৃত্যুর মাস। কুলি, মজুর, জেলে, চাষা, মেহনতি গ্রামবাসি, ধনী-গরিব নির্বিশেষে সবার বুকে আছে এপ্রিলের করুণ দগ্ধ ক্ষত। উপকূলের নরম মাটিতে লেপ্টে থাকা অসংখ্য লাশের দৃশ্য আমাদের মস্তিষ্কের কোটরে থাকা স্নায়ুকোষের আর্কাইভ থেকে ক্ষণে ক্ষণে উঁকি মারে। স্মৃতির পর্দায় ২৯ এপ্রিলের আবির্ভাব বরাবরই আমাদের শোকাতুর করে। দুঃসহ অভিজ্ঞতার সম্ভাব্য পুনরাবৃত্তি ভয়ানকভাবে উদ্বিগ্ন করে।
সাগরের কিনারে থাকা মানুষের আছে বিশেষ অশ্রুত আখ্যান, যা কখনো মূলধারার ফ্রেমে বাঁধা পড়ে না, জাতীয় গ্যালারির প্রদর্শনীতে যার জায়গা জুটে না। মূলতঃ ধূসর ধ্বংসস্তূপই উপকূলীয় জীবনের করুণ ক্যানভাস। আমাদের বোধের গভীরে অভিঘাত ফেলে মাতাল সমুদ্রের রুদ্র রোষ, তীব্র বাতাসের অহর্নিশ ঝংকার, লবণ পানির ধ্বংসাত্মক হানা, আর প্রলয়ঙ্করী প্লাবন। উপকূলে বসত করা মানে সমুদ্রের সাথে যুদ্ধ করে সমুদ্রের মিত্রতা মানা। প্রকৃতির সাথে, বিশেষ করে সমুদ্রের সাথে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা চলে। যেই যুদ্ধে আমরা কখনো জিতি না। সব সময় হারি। তারপরও সমুদ্রের সম্পদের প্রাচুর্যে আমাদের বাঁচার তীব্র আকাঙ্ক্ষা যেন মরেও মরে না। আমরা ঘুরে দাঁড়াই বারবার। ক্ষয়ক্ষতি পুষিয়ে নিয়ে নতুন করে জীবন সাজাই। বাঁচার তাগিদে, জীবন যাপনের শেষ অবলম্বনটুকু নিয়ে পুনরায় নেমে পড়ি জীবনের আয়োজনে। আমাদের এই কোমর বেঁধে ওঠে দাঁড়ানোকে ভদ্রলোকেরা বলে “রেজিলিয়েন্স”।
বঙ্গোপসাগরের উপকুলবর্তী অঞ্চল তীব্রভাবে ঘূর্ণিঝড়প্রবণ। অতীত পরিসংখ্যান বিবেচনায় নিলে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, বাংলাদেশে আঘাত হানা ঘুর্নিঝড়গুলোর বেশিরভাগেরই উৎপত্তি আন্দামানের কাছাকাছি। কারণ, বঙ্গোপসাগর থেকে আন্দামান অঞ্চল পর্যন্ত সমুদ্রে ঘুর্ণিঝড়ের প্রাথমিক অবস্থা তৈরি হওয়ার জন্য ২৭ ডিগ্রি তাপ মাত্রাই যথেষ্ট। এই তাপমাত্রায় সমুদ্রের ওপরের বায়ুমণ্ডলে আড়াআড়ি শূন্যতা তৈরি হয়। পৃথিবীর ঘুর্ণন এবং আহ্নিক গতির কারণে এই শূন্য স্থানে পার্শ্ববর্তী ঠাণ্ডা বায়ুর আগমন ঘটে। পৃথিবীর ঘূর্ণন থেকেই ঘুর্ণিঝড় গতিবেগ প্রাপ্ত হয়ে ঘূর্ণাবর্ত তৈরি করে। এই ঘূর্ণাবর্তের কেন্দ্রে থাকে চক্রাকার চোখ, যা ক্রমাগত ঘুরতে ঘুরতে ফানেলের মতো উপসাগরের দিকে মূল গতিমুখ প্রাপ্ত হয়, যার অনিবার্য গন্তব্য বাংলাদেশ। স্বাভাবিকভাবেই এই অঞ্চলে তৈরি হওয়া সমস্ত ঘূর্নিঝড় বাংলাদেশের দিকেই ধাবিত হয়। অতীতে এবং বর্তমানে অসংখ্য ঘূর্ণিঝড় বাংলাদেশের উপকূলে আঘাত হেনেছে। এরকম কিছু ঘূর্ণিঝড়ের উল্লেখ পাওয়া যায়, “আইন-ই- আকবরি” ও “রিয়াজ- উস- সালাতিন” গ্রন্থে। ১৫৮২ সাল থেকে হিসেব করলে বড় বড় প্রায় ৭৫ টির মতো ঘূর্ণিঝড় বাংলাদেশে আঘাত হেনেছে বলে তথ্য পাওয়া যায়। তার মধ্যে কিছু আছে যা মানুষ ও প্রাণসম্পদকে তছনছ করে দিয়েছে। পরিবেশকে লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছে। সাম্প্রতিক অতীতের সিডর, আইলার স্মৃতি আমাদের এখনো অম্লান। কিন্তু ২৯ এপ্রিল, ১৯৯১ এর স্মৃতি ক্রমশ অপসৃয়মান। অথচ ২০ ফুটের অধিক উচ্চতায় জলোচ্ছ্বাস, ২০০ মাইল বেগে বয়ে চলা বায়ু সম্পন্ন “মারিয়ান” নামক এই ঘূর্ণিঝড়ে প্রায় ১ লক্ষ ৩৮ হাজার লোক মারা গিয়েছিলো। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মারা গিয়েছিলো নারী ও শিশু। সেই সাথে মারা গিয়েছিল ২ লক্ষ ২৪ হাজার গরু-মহিষ, ২,১৮,০০০ ছাগল, ২৪ লক্ষ হাঁস-মুরগী। এপ্রিলের ২২ তারিখে জন্ম নিয়ে মাত্র এক সপ্তাহের মাথায় ঘূর্ণিঝড়টি এতটা তীব্রতা অর্জন করেছিলো যে, মানুষের স্বাভাবিক কাণ্ডজ্ঞানে এর প্রলয়ঙ্করী পরিসমাপ্তি সম্পর্কে কোন পূর্বাভাষই বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়নি। তাই ১০ নম্বর মহা বিপদসংকেত মানে কতটা বিপদের পুর্বাভাষ তা কেউ বুঝে ওঠতে পারেনি। বুঝলেও হয়তো কাজ হতো না। কারণ এই উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস থেকে বাঁচার জন্য পর্যাপ্ত আশ্রয়কেন্দ্র ছিলো না। উপকূলীয় বেড়িবাঁধ ছিল না, কোথাও হয়তো ভাঙ্গা বাঁধের চিহ্ন অবশিষ্ট ছিল। বাতাস যে কত তীব্রভাবে বইতে পারে তা যারা ঘুর্ণিঝড় মোকাবেলা করেনি তারা বুঝতে পারবে না। বাতাসের ঝাপটায় পানির ফোঁটাগুলো বুলেটের মতো গায়ে লাগছিলো। বৃষ্টির তীব্র থেকে তীব্রতর আঘাতে মানুষের গায়ের ত্বক পর্যন্ত ঝাঁজরা হয়ে গিয়েছিলো। সাধারণ কাণ্ডজ্ঞানে আমরা জানি, বৃষ্টি আকাশ থেকে মাটিতে পড়ে, ওপর থেকে নিচে নামে। কিন্তু সেদিন বৃষ্টির জলীয় গতিবিদ্যা ওলটপালট হয়ে গিয়েছিল। সেদিন বৃষ্টি নেমেছে আকাশ থেকে। বৃষ্টি ছুটেছে সমান্তরালে। কখনো মাটিতে জমা পানি অকস্মাৎ বৃষ্টি হয়ে উড়াল দিয়েছে আকাশে। সমস্ত প্রাণী ও জীবকূলের সে কি আর্তনাদ! বাদ যায় নি বৃক্ষরাও। ভয়াল রাতের লবণপানির প্রলয় কেড়ে নিয়েছে অসংখ্য প্রাণ, উপড়ে ফেলেছে গাছ, ধ্বংস করেছে মানুষের সকল অবলম্বন। পরদিন সকালে সমস্ত উপকূলীয় জনপদই যেন পরিণত হয়েছিলো পতিত বধ্যভূমিতে। লাশের পর লাশ, পানিতে লাশ, গাছে লাশ, স্তুপে লাশ। কত মানুষ স্বজন হারানোর বেদনায় মুহ্যমান হয়েছে, এমন কি লাশ না পাওয়ার আক্ষেপে বুক চাপড়িয়েছে তার হিসেব নেই। আমার এক দাদা (দাদার ভাই ) , সপরিবার মারা গেলেন। তার নাম মৌলভী রহমত উল্লাহ, পেশায় মসজিদের ইমাম। থাকতেন কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলার কুতুবজোম গ্রামের নয়াপাড়ার দক্ষিণে। স্থানীয়ভাবে তখন এর নামও ছিলো দখিনাবিল। সেই বিলের বালির ঢিবিতে বাঁশঝাড়, পুকুর আর মাটির দেয়ালে টিনের চালা ঘরে উনি থাকতেন। সেদিন তার ছেলেপুলে, নাতি নাতনি সবাইকে নিয়েই বাসায় ছিলেন। পানি আসার সম্ভাবনা দেখে অনেকের মতই তিনি ঘরের চালে আশ্রয় নিয়েছিলেন। কিন্তু পানি এমনভাবে আসলো যে মূহুর্তেই দুটি বড় বাঁশঝাড় সমূলে উৎপাটিত হয়ে উল্টে ঘরের চালের ওপরে পড়লো। পানির তোড়ে মানুষ ও পশু এক সাথে ভেসে গেল। কোথায় সমাহিত হল তার হদিস মিলেনি। শুধু যে মহেশখালী, কুতুবদিয়া বা বাঁশখালিতেই প্রাণহানি ঘটেছে তা নয়, বরং সমগ্র উপকূল জুড়েই হানা দিয়েছে প্রলয়। লাশ জমেছে বেশুমার। তছনছ হয়েছে পরিবেশ, লণ্ডভণ্ড হয়েছে বাড়িঘর। পাল্টে গেছে উপকূলের ভূগোল। মহেশখালীর দক্ষিণে ‘হামিদার দিয়া’ ও ‘কৈতরের দিয়া’তো সাগরেই বিলীন হয়েছে। এরপর কখনোই উপকূলীয় পরিবেশ পূর্বের রূপ ফিরে পায়নি। কিছু কিছু প্রাকৃতিক সম্পদ ও প্রাণ-প্রজাতির নবায়ন ঘটেনি আর। বিশেষ করে মিঠা পানির মাছ। ১৯৯১ সালের পর উপকূলীয় অঞ্চলে পুকুর ভরা দেশীয় মাছের দেখা মেলেনি। বাঁশঝাড় ও কেয়াবনের আর দেখা মেলে না।
ঘূর্ণিঝড় পরবর্তী অবস্থা আরও বেদনাবিদূর। চারিদিকে কেবল আহাজারি আর হাহাকার। তার ওপর ক্ষুধা, অন্ন-বস্ত্র-পানির অভাব, মৃতদের খোঁজা, লাশ উদ্ধার ও দাফনের তজিয়া। ঘূর্ণিঝড়ের পরে ডায়রিয়া এবং কলেরায় মারা গেছে প্রায় দুই হাজার লোক। সবকিছু মিলে আমরা চাই না, এমন ভয়ানক ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটুক। কিন্তু উপকূলীয় রক্ষাবাঁধ বা বেড়িবাঁধের অবস্থা এখনো নাজুক। উপকূলীয় সবুজ বেষ্টনীও ভূমিদস্যুদের গ্রাসে বিলীন প্রায়। নতুন করে ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র নির্মিত হয়নি। অথচ জনবসতি বেড়েছে বহুগুণ। উপকূলের অনিবার্য অনুষঙ্গ ঘূর্ণিঝড়তো আছেই, এর সাথে যুক্ত হয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনজাত রোগ-বালাইয়ের প্রাদুর্ভাব। সার্বিকভাবে উপকূলীয় পরিবেশের ভৌত, অভৌত, জৈবিক-বস্তুগত পরিবর্তনের আর্থ-সামাজিক প্রভাব মারাত্মক রূপ নিতে শুরু করেছে। উপকূলীয় সামুদ্রিক সম্পদও অতি ব্যবহারের কারণে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। তাই উপকূলবাসীর সামগ্রিক সক্ষমতাও কমতে বসেছে। আমাদের এখন দরকার প্রাকৃতিক পরিবেশের নবায়নযোগ্য চক্রগুলো অক্ষুণ্ণ রাখা। কারণ প্রাকৃতিক পরিবেশের অনবায়নযোগ্য রূপান্তর ঘটলে আগেরমতো ঘুরে দাঁড়ানোর ক্ষমতা থাকবে না। এটাই সবচেয়ে শঙ্কার বিষয়। অতীত অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে ঘুর্নিঝড় মোকাবেলার জন্য পর্যাপ্ত পূর্বপ্রস্তুতি নেয়ার সাথে সাথে ঘূর্ণিঝড় মোকাবেলার অবকাঠামোগত উপকূলীয় উন্নয়ন হওয়া চাই। বিশেষ করে ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র, চিকিৎসাকেন্দ্র, যোগাযোগের রাস্তা, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা, পরিকল্পিত আবাসনের ব্যবস্থা, রেডক্রিসেন্ট, এনজিও, স্থানীয় স্কুল-কলেজ ও প্রশাসনের সমন্বিত তৎপরতার প্রাতিষ্ঠানিক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন বাঞ্ছনীয়।
কিন্তু স্থানীয় পর্যায়ে এসব নীতি ও পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সাথে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক জোটের সাথে দ্বিপাক্ষিক, বহুপাক্ষিক ও আন্তর্জাতিক প্রটোকল বাস্তবায়নের সম্পর্ক রয়েছে। বর্তমান বিশ্বগ্রামের যুগে কোন দেশ এককভাবে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি ও প্রভাব মোকাবেলা করতে পারে না। কার্বন নিঃসরণ, হিমালয়ের পানির উৎস , অভিন্ন নদীর পানির হিস্যা, জীব-বৈচিত্র্য সংরক্ষণ ইত্যাদি বিষয়ে বাংলাদেশের সাথে প্রতিবেশী ও দুরবর্তী দেশের সম্পর্ক খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের ঘুর্ণিঝড় মোকাবেলার কৌশলের সাথে এসব বিষয়ের যৌক্তিক ও পর্যাপ্ত সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলার জন্য সারা পৃথিবীতেই দ্বিপাক্ষিক, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বলয়ের মিশ্র সম্পর্ক দেখা দিয়েছে, যাকে অর্থনীতিবিদ জগদীশ ভগবতী “নুডলস বাওয়েল প্রপঞ্চ” বলেছেন। একবাটি নুডলসে যেমন নুডলসগুলো এলোমেলো সম্পর্কজঠে আবদ্ধ থাকে, তেমনি আন্তর্জাতিক চুক্তি, আঞ্চলিক চুক্তি ও দ্বিপাক্ষিক চুক্তির মধ্যে পরস্পরবিদারী আন্তঃসম্পর্ক রয়েছে। তাই এসব জোটের ভিন্ন ভিন্ন স্বার্থতাড়িত অগ্রাধিকার ও চুক্তির মধ্যে সমন্বয় করতে না পারলে এবং নিজেদের স্বার্থে সিদ্ধান্তগুলোতে ইনপুট দিতে না পারলে, কার্যকর অর্থে আমরা উদ্ধারহীন ভোগান্তিতে পড়ব। আন্তর্জাতিক জোটের সিদ্ধান্তগুলোতে শক্তিমানের স্বার্থ রক্ষিত হয়। এখানে একটা ভারসাম্য আনার জন্য দরিদ্র দেশসমুহ আলাদা জোট করে থাকে, তবুও তা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেনা। তাই আমাদের দরকার, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সচেতনতা ও জনমত তৈরির জন্য ঘূর্ণিঝড়ের মতো প্রাকৃতিক দূর্যোগ ও মানবিক বিপর্যয়ের ইস্যুগুলো তুলে ধরা। এভাবেই হয়তো আমরা ভবিষ্যৎ ঝুঁকি মোকাবেলার জন্য কাম্য সক্ষমতা অর্জন করতে পারবো।
সরওয়ার কামাল, গবেষক ও লেখক