দেওয়ান মনোহর আলী খান, বড়উঠানের জমিদারবাড়ি ও বৈশাখি মেলা

জামাল উদ্দিন
চট্টগ্রামের প্রসিদ্ধ জমিদার বড়উঠান মিয়া বাড়ির প্রতিষ্ঠাতা দেওয়ান শ্যামরায়। ১৬৬৬ সালের ২৭ জানুয়ারি বাংলার নবাব শায়েস্তা খান কর্তৃক চট্টগ্রাম বিজয়কালে তাঁরই পুত্র প্রধান সেনাপতি বুজুর্গ উমেদ খান’র সহযোগী সেনাধ্যক্ষ ছিলেন উত্তর ভারতের রাজপুত বংশের সন্তান শ্যামরায়। চট্টগ্রাম বিজয়ের পর উমেদ খাঁ দেয়াঙে অবস্থিত হাজার বছরের প্রাচীন চট্টগ্রাম শহরকে পরিত্যাক্ত ঘোষণা করে কর্ণফুলীর উত্তর তীরে সদরঘাটকে কেন্দ্র করে নতুন শহরের প্রবর্তন করেন এবং প্রাচীন শহরকে পরিত্যাক্ত ঘোষণা করেন। চট্টগ্রাম বিজয়ের পর চট্টগ্রামের শাসক হন নবাব উমেদ খাঁ, তিনি নগরীর জয়নগরে নবাবী কার্যালয় প্রতিষ্ঠিত করেন এবং শ্যামরায় দেওয়ান উপাধি লাভ করেন স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন বিজিত অঞ্চল শহর দেয়াঙ বড়উঠান নামক স্থানে। স্থায়ীভাবে বসবাস শুরুর প্রাক্কালে তাঁরই নিকটজনদের একটি অংশ উত্তর ভারত থেকে চলে আসেন বড়উঠানে। তখন সাগর উপকুলীয় চট্টগ্রামকে শত্রুর হাত থেকে রক্ষা করার জন্যে শ্যাম রায়ের অধিনে দুটি দুর্গ স্থাপন করে ১০ হাজার সৈনিক মোতায়েন করা হয় দেয়াঙের সাগর উপকুলে। যেন আরাকানীদের হামলা থেকে চট্টগ্রামকে রক্ষা করা যায়। শ্যামরায় সম্পর্কে একটি গল্প এখনো প্রচলিত আছে, নবাব উমেদ খাঁ একদিন শ্যামরায়ের ক্ষমতা পরীক্ষা করার জন্য এক ফন্দি আটেন। তিনি শ্যমরায়কে বলেন, এক রাতের মধ্যে যদি নবাবের বাসস্থানের সামনে এক দিঘি খনন করে তাতে প্রস্ফুটিত পদ্ম দেখাতে পারেন-তবে তিনি আনন্দিত হবেন। আর দেরি কেন, তিনি প্রস্তুতি নিতে শুরু করলেন। একদিন রাত প্রভাত হলেই নবাব দেখলেন, তাঁর বাসস্থানের সম্মূখে এক বিস্তির্ণ দিঘিতে প্রস্ফুটিত পদ্মফুল ভাসছে। সেই দিঘি চট্টগ্রাম শহরের উত্তরাংশে কমলদহ দিঘি নামে খ্যাত রয়েছে। তার নিকটেই ছিল নবাবের বাসভবন। জনশ্রুতিতে জানা যায় শ্যামরায় তাঁর অধিনস্থ প্রায় ৮ হাজার সৈনিক নিয়োজিত করে রাতারাতি এই দিঘিটি খনন করিয়ে ছিলেন। এছাড়া শ্যামরায় ইসলামধর্ম গ্রহণ করার পেছনে রয়েছে আরেক জনশ্রুতি; রমজান মাসের কোন একদিন বুজুর্গ উমেদ খাঁ সকল দেওয়ান ও শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তাদেরকে আপ্যায়নে আমন্ত্রণ জানালেন তাঁরই জয়নগরস্থ নবাবী কার্যালয়ে। বুজুর্গ উমেদ খানের আমন্ত্রণে দেওয়ান শ্যামরায়ও যোগ দেন এ ভোজ সভায়। হেঁসেলে (পাকশালা) বিভিন্ন ধরনের খাবারের আয়োজনে রান্নাবান্না চলছে, বুজুর্গ উমেদ খাঁন দেওয়ান শ্যামরায় কে সাথে নিয়ে হেঁসেল ঘুরে ঘুরে তরিতরকারির ঘ্রাণ শুকে দেখছেন। দেওয়ান শ্যামরায় ঠাট্টাচ্ছলে বুজুর্গ উমেদ খানকে বললেন, ‘ঘ্রাণে অর্ধভোজন’। আপনি তো রোজা রেখেছেন, কিন্তু ঘ্রাণে তো আপনার রোজা ভেঙে গেছে। উমেদ খান বিযয়টি আঁচ করতে পেরে বললেন,ঠিকই-তো রোজা ভেঙে গেছে ! বুজুর্গ উমেদ খান দেওয়ান মনোহরের এ যুক্তি মেনে নিলেন। এর কিছুদিন পর দেওয়ান শ্যামরায় তাঁর বড়উঠান গ্রামের বাড়িতে বিশাল এক নিমন্ত্রণের আয়োজন করলেন। ঐ অনুষ্ঠানে চট্টগ্রামের নবাব বুজুর্গ উমেদ খান সহ সরকারি বেসরকারি প্রচুর খান্দানি লোকদেরকে নিমন্ত্রণ করা হলো। মুসলিমদের জন্যও পৃথক গোমাংসের আয়োজন চলছে। বাবুর্চিরা রান্নাবান্নায় ব্যস্ত। এ সময় নবাব বুজুর্গ উমেদ খান এসে হাজির। দেওয়ান শ্যামরায় নবাবকে তাঁর বাড়িটি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখাচ্ছেন এবং এক পর্যায়ে নিয়ে গেলেন হেঁসেলে (পাকশালা)। রান্না কেমন হলো তা ঘ্রাণ নিয়ে দেখছেন দেওয়ান শ্যামরায়। এক পর্যায়ে রান্না করা গোমাংসের ডেকচির ঢাকনা তুলে ঘ্রাণ নিলেন। সাথে সাথে নবাব বুজুর্গ উমেদ খান টাট্টাচ্ছলে বলে উঠলেন, গরু তো আপনাদের দেবতা , আপনারা গোমাংস খেলে তো ধর্ম বলতে কিছুই থাকেনা। এই যে আপনি গোমাংসের ঘ্রাণ নিয়েছেন ‘ঘ্রাণে তো আপনার অর্ধভোজন’ হয়ে গেছে ! অমনি দেওয়ান শ্যামরায় পড়লেন বিপদে। নবাব বললেন, ‘সেদিন রমজান মাসে রান্নার ঘ্রাণ নিতে গিয়ে আপনি আমাকে যুক্তি দিয়ে বলেছিলেন আমার রোজা ভেঙে গেছে। সেদিন আপনার যুক্তি আমি মেনে নিয়েছিলাম। আজ আপনি গোমাংসের ঘ্রাণ নিয়েছেন। সুতরাং আজ থেকে আপনি হিন্দু ধর্মে নেই, আপনি মুসলমান হয়ে গেছেন’। দেওয়ান শ্যামরায় নবাব বুজুর্গ উমেদ খানের যুক্তি মেনে নিলেন। নীতিবাদী দেওয়ান শ্যামরায় ঘোষণা দিলেন তিনি মুসলমান হবেন এবং নিজ পরিবারের অন্যান্যদেরকেও মুসলিম ধর্মে চলে আসার জন্য আহবান জানালেন, কিন্তু অন্যরা কেউ তাঁর আহবানে সাড়া দিলেন না। অবশেষে নিজেই ইসলাম ধর্ম গ্রহন করে মুসলিম নাম ধারণ করলেন ‘ দেওয়ান মনোহর আলী খান’। ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার পর তিনি পারিবারিকভাবে একা হয়ে গিয়েছিলেন। আপনজনরা সবাই তাঁকে ছেড়ে রাউজান চলে যায়। কবি নবীন চন্দ্র সেনের ‘আমার জীবন’ প্রথম ভাগের দ্বিতীয় পৃষ্ঠার বিবরণে জানা যায়, নবীন চন্দ্র সেনের আদিপুরুষ ছিলেন রাজা শ্যামরায়। যাই হোক, এরইমধ্যে দেওয়ান মনোহর আলী খান মুসলিম নারী বিয়ে করে সংসার করার প্রস্তাব রাখেন নবাব বুজুর্গ উমেদ খানের কাছে। চট্টগ্রাম বিজয়ের অন্যতম যোদ্ধা দেওয়ান মনোহর আলী খানের জন্য পাত্রী খোঁজা শুরু হলো। কিন্তু সেকালে তাঁর উপযুক্ত পাত্রী পাওয়া ছিল বড়ই সংকট। বুজুর্গ উমেদ খান এ প্রস্তাব জানালেন তাঁর পিতা বাংলার নবাব শায়েস্তা খানের কাছে। তিনি ভেবে চিন্তে ঠিক করলেন নওমুসলিম দেওয়ান মনোহর আলী খানের কাছে সমর্পণ করবেন নিজ কন্যা। দেওয়ান মনোহর আলী খান নবাব শায়েস্তা খানের প্রস্তাব সাদরে গ্রহণ করলেন। বিয়ে হয়ে গেল। ঢাকা থেকে নবাব কন্যা বধূ সেজে চলে আসলেন বড়উঠানের দেওয়ান পরিবারে। শায়েস্তা খানের কন্যার নাম কি ছিল তা নিয়ে নানা মতবাদ থাকলেও জনশ্রæতি মতে শাহা বিবি নামেই পরিচিত ছিলেন। নবাব কন্যা বিয়ে করায় কন্যার ভরণপোষণের জন্য নবাব পরিবারভুক্ত চট্টগ্রামের জমিদারীর চারভাগের এক অংশ লাভ করেন দেওয়ান মনোহর আলী খান ও নবাব কন্যা শাহা বিবি। নবাব পরিবারের মেয়ে বিয়ে করার বদৌলতে দেওয়ান মনোহর আলী খানের ভাগে চলে আসে চট্টগ্রামের বিশাল ভূসম্পদের জমিদারি। চট্টগ্রামের দ্বিতীয় বৃহত্তর এ জমিদার পরিবারটি ১৬৬৬ সালে মোগল কর্তৃক চট্টগ্রাম বিজয়ের পর থেকে বড়উঠান গ্রামে প্রজন্মের পর প্রজন্ম বসবাস করে আসছেন। দেওয়ান মনোহর আলী খানের অধঃস্থন পুরুষদের একটি বংশ লতিকা সংরক্ষিত আছে তাঁরই বংশধরদের কাছে। তাতে দেখা যায় চট্টগ্রামের প্রসিদ্ধ জমিদার বড়উঠান গ্রামের দেওয়ান মনোহর আলী খান পরিবারের পরবর্তী প্রজন্মের প্রত্যেকেই প্রায় সাড়ে চারশ বছর জমিদারি পরিচালনা করে এসেছেন সেই মোগল আমল থেকে ব্রিটিশ শাসনামলের শেষ সময়কাল পর্যন্ত, প্রায় পৌনে চারশ বছর। বিশাল এ জমিদারি পরিচালনার পাশাপাশি নানা সময়ে তাঁদের জমিদারির পরিধি চট্টগ্রাম ছেড়ে হাতিয়া, স›দ্বীপ ও নোয়াখালী পর্যন্ত বিস্তৃতি লাভ করে। চট্টগ্রামের অধিকাংশ ছোট জমিদার গুলো ছিল এই জমিদার পরিবারের তালুকি জমিদার। চৌধুরী ও তালুকদার নামে খ্যাত ছোট ছোট জমিদারগুলো নিজ নিজ এলাকার জমিদারভ‚ক্ত ভূমির খাজনা আদায় করে তুলে দিতেন দেওয়ান মনোহর আলী খান বংশদ্ভূত জমিদারদের হাতে। প্রতি বছর বৈশাখ মাসে পুণ্যার সময় এলাকাভ‚ক্ত ছোট জমিদার, তালুকদার, চৌধুরী ও প্রজাদের মেলা বসত বড়উঠানের মিয়া বাড়ি নামে খ্যাত এই জমিদার বাড়ির সামনে বিশাল ময়দানে। জমিদার পরিবারের বাহন বাজকীয় পালকি ঘোড়ার আস্তাবল, হাতিশালা. বাড়ির আঙ্গিনায় নাচখানা জলসে উঠতো, ভারতবর্ষের সেরা শিল্পী গায়ক ও বাদকদল এ পুণ্যা অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতেন। তাছাড়াও মাসের পর মাস সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে মেতে থাকতো জমিদার বাড়ির নাচখানা ও থিয়েটার হল। আটমাইল এলাকা জুড়ে সেই বিশাল অট্টালিকা জমিদার বাড়ির চতুর্সীমানার পাহাড়ায় থাকতো পাইক পেয়াদা। জমিদার পরিবারের বিভিন্ন কাজের সহযোগিতায় কাজি, মহুরি, সিকদার, নাপিত, ধোপা, কামার-কুমারসহ অনেক পেশাজীবী কর্মচারী বাস করতেন জমিদার বাড়ির চতুর্বেষ্টনীতে। এই জমিদার পরিবারের ঐতিহ্যের মধ্যে রয়েছে চট্টগ্রাম জুড়ে প্রায় অর্ধশত ঐতিহাসিক মসজিদ ও পানিয় জলের দিঘি, সড়ক, হাটবাজারসহ বহু জনহিতকর প্রতিষ্ঠান। যা আজও কালের স্বাক্ষী হয়ে স্মৃতিবাহী জমিদার পরিবারের ইতিহাসকে জানান দিয়ে যাচ্ছে। জমিদারদের বিশাল অট্টালিকা ভবনগুলো এখন জীর্ণশীর্ণ, বলতে গেলে বসবাসের অযোগ্য এসব ভবন ধীরে ধীরে ক্ষয়ে যাচ্ছে। বটতলী গ্রামে হযরত শাহ মোহছেন আউলিয়ার (রা.) মাজারকে কেন্দ্র করে প্রতিষ্ঠিত রুস্তম হাটের প্রতিষ্ঠাতা জমিদার রুস্তম আলী খাঁ ছিলেন দেওয়ান মনোহর আলী খানের দ্বিতীয় পুরুষ। তিনি বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হয়েছিলেন কিংবদন্তির নায়ক মনুমিয়ার বড়বোন কালাবিবি চৌধুরানির সাথে। কালাবিবিও পৈত্রিক সূত্রে প্রাপ্ত বিশাল জমিদারির অধিকারী ছিলেন। তিনি বড়উঠানের জমিদার নন্দন রুস্তম আলী খানকে স্বামী হিসাবে গ্রহণ করার প্রস্তাব পাঠালে রুস্তম আলী খানও তাতে রাজি হন এবং দ্বিতীয় স্ত্রী হিসাবে কালাবিবি চৌধুরানিকে বিয়ে করেন। বেলচুড়া গ্রামস্ত কালা বিবি চৌধুরানী বিশাল জমিদার বাড়ি আজও কালের স্বাক্ষী হিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পৈত্রিক জমিদারি ও স্ত্রী কালাবিবি চৌধুরানি জমিদারি দেখাশুনা করতেন জমিদার রুস্তম আলী খাঁন। কালাবিবি চৌধুরানি ছিলেন নিঃসন্তান। ধর্মভীরু রুস্তম আলী খান হযরত শাহ মোহছেন আউলিয়ার (রাঃ)মাজারকে ভক্তিভরে শ্রদ্ধা করতেন এবং মাজারের পরিচর্যা করতেন। ঐ মাজারকে কেন্দ্র করে রুস্তম আলী খান প্রতিষ্ঠা করেন রুস্তমহাট। মোহছেন আউলিয়া (রা.) এর মাজারকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা রুস্তমহাট বহুল আলোচিত প্রসিদ্ধ এক বাজার। কথিত আছে যে, শেষ বয়সে রুস্তম আলী খাঁ হযরত শাহ মোহছেন আউলিয়ার (রা.) এর মাজারেই প্রায় সময় কাটাতেন। মৃত্যুর পরে তাঁর কবর যেন মাজারের পাশেই হয় তার জন্য তিনি সকলকে নসিহত করে যান। তাঁর নসিহত অনুযায়ী মাজারের পূর্ব পার্শ্বের লাগোয়া ভূমিতে রুস্তম আলী খাঁকে দাফন করা হয়। শত শত বছর ধরে অযতেœ অবহেলা ও মাজারের পরিধি বিস্তার ও সংস্কারের কারনে রুস্তম হাটের প্রতিষ্ঠাতা সেই ঐতিহাসিক রুস্তম আলী খানের কবরটির স্মৃতিচিহ্ন ধরে রাখা প্রয়োজনবোধ করেননি কেউ। মাজারের পূর্বপার্শ্বের বাউন্ডারী ওয়ালের বাহিরে লাগনো ভূমিতেই তিনি চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন। কিন্তু মাজার পরিচালনা কমিটি রুস্তম আলী খানের দানি ভ‚মিতে অবস্থান করলেও কবরটি সংরক্ষণের প্রয়োজনবোধ করেন নি। দেওয়ান মনোহর আলী খানের সপ্তম পুরুষ জমিদার ফাজিল খান। বড়উঠানের জমিদার বাড়ির সামনেই মোগল স্থাপত্যে বিরাটকায় এক মসজিদ, নিকটবর্তী দৌলতপুর গ্রামের ফাজিল খার হাট নামক বাজার ও মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেন জমিদার ফাজিলখান। জমিদার বাড়ির সামান্য পূর্বে গেলেই পি.এ.বি সড়কধারে তিনশত বছরের পুরনো ইলিয়াছ খান মসজিদ। দেওয়ান মনোহর আলী খানের নবম পুরুষ ইলিয়াছ খান। জমিদার ফাজিল খানের পুত্র জমিদার ইলিয়াছ খানই এ মসজিদের প্রতিষ্ঠাতা। মসজিদের সামান্য পূর্বে মসজিস পুকুর। ইলিয়াছ খানের ছেলে আমীর খাঁ। পিতার খুদিত পুকুরের গা ঘেঁষে তিনি খনন করান প্রকাÐ আরেক দিঘি। দিঘিটি ‘আমীর খানের দিঘি’(বাইশ খানি) নামে পরিচিত। দিঘি ছাড়া ও তিনি বড়ঊঠান মিয়ার হাট ও বড়উঠান মিয়ার খেলার প্রতিষ্ঠাতা। সম্ভবত শতের শতকের মাঝামাঝি সময়ে। তিনি ১ বৈশাখ জমিদারির খাজনা আদায়ের পুণ্যাকে কেন্দ্র করে এই খেলা ও মেলার আয়োজন করেন। তৎকালে ১ বৈশাখ থেকে ৫ বৈশাখ পুণ্যা চলাকালীন লোকে লোকারণ্য থাকতো পুরো এলাকা। পুণ্যার শেষে বৈশাখ মাসের ৮ তারিখ এই মেলার ধার্য দিন থাকলেও মেলা শুরু হয়ে যেত বৈশাখ মাসের ১ তারিখ থেকে। বড়উঠান মিয়ার খেলা নামে খ্যাত এই খেলাটির তৎকালে পুরো চট্টগ্রাম জুড়েই খ্যাতি ছিল। এটিই ছিল তৎকালে সর্ববৃহৎ বলিখেলা বা মেলা। দেওয়ান মনোহর আলী খান পরিবারের ১৫ তম পুরুষ জমিদার আনোয়ার আলী খান। তখন ব্রিটিশ শাসনামল। তিনি ভারতবর্ষ জড়ে বহুল-আলোচিত একটি নাম। তিনি বিশাল জমিদারিভুক্ত এলাকায় প্রজাদের ইবাদত বন্দেগীর সুবিধার্থে মোগল স্থাপত্যে নির্মাণ করেন একাধিক মসজিদ ও খনন করান পানীয় জলের দিঘি। আনোয়ারা থানার বরুমচড়া গ্রামে তাঁরই প্রতিষ্ঠিত আনোয়ার আলী খান মসজিদ আজও কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বন্দর গ্রামে কান্তির হাট জামে মসজিদ নির্মাণ, হাটহাজারি মাদ্রাসা নির্মাণে ভূমি দান, এমনকি ইসলামী শিক্ষা কেদ্র প্রতিষ্ঠার জন্য মওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদীকে দেয়াঙ পাহাড়ে এক’শ বিঘা ভূমি দান করেছিলেন জমিদার আনোয়ার আলী খান। এই ভূমিতে ইসলামীক ইউনিভার্সিটি করার স্বপ্ন ছিল বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম নায়ক ইসলামী চিন্তাবিদ মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদীর। উল্লেখ্য যে জমিদার আনোয়ার আলী খান ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে শরীক হতে গিয়ে ব্রিটিশ সরকারের রোষানলের শিকার হন। ব্রিটিশ সরকার এক আদেশে তাঁর জমিদারির বিশাল অংশ এক পরোয়ানা মূলে বাজেয়াপ্ত করলে জমিদার আনোয়ার আলী খান আইনি লড়ায়ে জিতে পুনরায় জমিদারি ফিরে পান। আনোয়ার আলী খানের পুত্র শের আলী খান তিনিই জমিদারির পরিধি চট্টগ্রাম ছেড়ে হাতিয়া, স›দ্বীপ পর্যন্ত প্রসার করেন। তিনি বিয়ে করেন হাতিয়ার প্রসিদ্ধ জমিদার রাজা মিয়া চৌধুরীর একমাত্র কন্যা ফিরোজা খাতুন চৌধুরানীকে। রাজা মিয়া চৌধুরীর শ্বশুর নোয়াখালী নিবাসী আমানুল্লা চৌধুরী ছিলেন হাতিয়ার প্রসিদ্ধ এক জমিদার। তার একমাত্র কন্যা আছমুন নেছা চৌধুরানী প্রকাশ সাহেবানী। কন্যা সাহেবানীকে জমিদার রাজা মিয়া চৌধুরীকে বিয়ে দেন এক শর্তে, তাকে হাতিয়ার জমিদার কন্যার পিত্রালয়ের অবস্থান করতে হবে। শ্বশুরের ওয়াদা মতে তিনি নোয়াখালী থেকে চলে আসেন হাতিয়াস্থ কনের পৈত্রিক জমিদার বাড়িতে। সেই জমিদার পরিবারের একমাত্র কন্যা ফিরোজা খাতুন চৌধুরানীকে বিয়ে করেন বড়উঠানের জমিদার শের আলী খান। স্ত্রী মালিকানা সূত্রে শের আলী খান হাতিয়াস্থ শ্বশুর পরিবারের বিশাল জমিদারের মালিক হয়ে যান। জমিদার রাজা মিয়া চৌধুরী নিজের বিয়ের মতোই একমাত্র কন্যার বিয়েতেও শর্ত জুড়ে দেন বড়উঠানের জমিদার জামাতা শের আলী খনাকে হাতিয়ায় কনের পিত্রালয়েই থাকতে হবে এবং কনের পৈত্রিক জমিদারী দেখাশুনা করতে হবে। কিন্তু শের আলী খান কম কিসে! তিনি নিজেই তো চট্টগ্রামের প্রসিদ্ধ জমিদার। চট্টগ্রামে তার পৈত্রিক জমিদারি দেখভাল করার দায়িত্ব তো তারই। বিয়ের অল্পকিছুদিন পরেই স্ত্রী নিজেই প্রস্তাব দেন তিনি স্বামীর সাথে শ্বশুর বাড়িতে চলে যাবেন। কিন্তু জমিদার পিতা রাজা মিয়া চৌধুরী তাতে বাঁধ সাধেন। কন্যা তার অবাধ্য হয়ে স্বামীর সাথে চলে আসতে দেখে ক্ষুব্দ জমিদার পিতা কন্যা মারা গেছে প্রতীকী অর্থে কবর খুড়ে একটি কলা গাছ দাফন করেন। অথাৎ মেয়ে মারা গেছে মেয়ের লাশ দাফন করা হল। তার মুখ আর দেখবেন না। মেয়ে শ্বশুর বাড়ি বড়উঠানে চলে আসার ক্ষোভে দুঃখে রাজামিয়া চৌধুরী একাবারে বেসামাল হয়ে যান। রাজা মিয়া চৌধুরী এতই প্রবাভশালী জমিদার ছিলেন যে, একবার জাহাজে চড়ে কলকাতা যাওয়ার পথে পথিমধ্যে জাহাজের টিকেট চেকার তার কেবিন খুলে টিকেটের কথা জিজ্ঞেস করলে তিনি অগ্নিমূর্তি হয়ে টিকেট চেকারকে বলেছিলেন, জানো আমি কে? বিষয়টি অপমান মনে করে তিনি জাহাজ কতৃপক্ষকে বললেন, কলকাতা থেকে নিজের জাহাজে চড়েই হাতিয়া যাবো। এবং তিনি তাই করলেন, কলকাতা থেকে জাহাজ কিনে সেই জাহাজে চড়ে হাতিয়া আসলেন জমিদার রাজা মিয়া চৌধুরী। তার বিশাল জমিদারির খজনা আদায়ের জন্যে অনেক ক্ষূদ্র জমিদার নিয়োজিত ছিলেন। জমিদার রাজা মিয়ার মৃত্যুর পর বড়উঠানের জমিদার শের আলী খান হাতিয়া, সন্দ্বীপ ও নোয়াখালির বিশাল জমিদারির মালিক হয়ে যান। তিনি হলেন জমিদার দেওয়ান মনোহর আলী খান পরিবারের শেষ জমিদার। তার আমলেই জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হয়ে যায়। আজও বড়উঠানের জমিদার পরিবারের জিন্নত আলী ওয়াকফা স্টেট নামে একটি ওয়াকফা স্টেটে বড়উঠান গ্রামে দিঘি পুকুর কবরস্থান সহ প্রায় সতের একর ভূমি এবং হাতিয়ার চরে তাজমুন নেছা চৌধুরানী স্টেট নামে একশ একর ভূসম্পত্তি রয়েছে। হাতিয়া স্টেটে প্রায় একশ পরিবারের ভূমিহীন প্রজা বংশানুক্রমে বসবাস করে আসছে। অপরদিকে বড়উঠান গ্রামে এ পরিবারে উনিশ একর পৈত্রিক ভূমিতে দেড়শত ভূমিহীন পরিবার বংশানুক্রামে বসবাস করে আসছে। পূর্বপুরুষদের ঐতিহ্য রক্ষায় কোনো প্রকারের কর ছাড়াই এসব পরিবারকে বংশানুক্রামে অনুমতি দিয়ে আসছেন বর্তমান বংশধরেরা। এছাড়াও চার একর বিশিষ্ট একাধিক ধ্বংসস্তূপ পাকা দালান বিশিষ্ট এ বাড়িতে বলতে গেলে জমিদার পরিবারের আজ কেউ থাকেন না। তারা রয়েছেন দেশ বিদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হওয়ার পর বড়উঠানের সেই ঐতিহাসিক জমিদার বাড়িতে আজ কোনো উল্লাস ঐতিহ্য ও জৌলুস নেই। শুধু দাঁড়িয়ে আছে জমিদারদের বসবাসের জীর্ণশীর্ণ বিশাল এক অট্টালিকা। বাড়ির সামনের দিঘি, মসজিদ ও চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অনেক ঐতিহাসিক স্মৃতি। হারিয়ে যাওয়া এসব ইতিহাস লিখিত আছে ‘দেয়াঙ পরগনার ইতিহাস’ গ্রন্থের পড়তে পড়তে। তেমনই হারিয়ে যায় এই জমিদার পরিবারের ঐতিহ্যবাহী মেলার ঐতিহ্যও। এক সময় বিস্তিন্ন এলাকাজুড়ে ১০ দিন জুড়ে মেলার আয়োজন থাকলেও জমিদারী প্রথা বিলুপ্তের পর থেকে ধীরে ধীরে এই মেলার গুরুত্ব কমে দুই দিনে চলে আসে এবং ৭ ও ৮ বৈশাখ নির্ধারিত হয়ে যায় মেলার সময়কাল। এই মেলাকে কেন্দ্র করে বহু দূর দূরান্ত থেকে ব্যবসায়ীরা নানা ধরণের পণ্যের মজুত ঘটাতো। বিশেষ করে জমিদারি অঞ্চলের কৃষক, শ্রমিকরা সারা বছরের প্রয়োজনীয় দ্রব্য এই মেলা থেকে ক্রয় করে নিত। কৃষি পণ্যের পাশাপাশি এ মেলায় বিকিকিনি হয় কাঠের পুতুল, শুকানো লাউ-এর খোসার ভেলা, বাঁশের বাশি, কাজু বাদাম, পাহাড়িয়াদের তৈরী বাঁশের ঝুড়ি, নানা ধরনের খেলনা, পোড়া মাটির তৈরী পুতুল, কাঠের পুতুল, নারিকেলের মালা ও খোসার নানা প্রকার পুতুল, বেত, কাঠ ও বাঁশের আসবাব পত্র, চিকা চটের ব্যাগ, পাটের বাটি, পেয়ালা, বাঁশের পাখা, বাঁশের চালনী, ডালা, বেতের মোড়া ইত্যাদি। উল্লেখ্য যে, ২০১৭ সালে করোনা মহামারি থেকে মেলাটি প্রায় বন্ধ হয়ে গেলেও পিএবি সড়কের উপর অনায়েসে ব্যবসায়ীরা বসে যেত নানান পণ্য নিয়ে। বলিখেলা কিংবা অন্যকোন আনষ্টানিকতা ছিল না। ্এলাকাবাসীর দাবীর প্রেক্ষিতে দেওয়ান মনোহর আলী পরিবারের বর্তমান প্রজন্ম বিশিষ্ট সমাজসেবক সাজ্জাদ খান মিঠু এবং সাঈদ খান আরজুর নেতৃত্বে পুনরায় এ বছরের ৭ ও ৮ বৈশাখ (২০ ও ২১ এপ্রিল) দুইদিন ব্যাপি মেলার আয়োজন হতে চলছে শুনে আনোয়ারা ও কর্ণফুলী উপজেলার জনসাধানণের মাজে আনন্দের হাওয়া বইতে শুরু করেছে। তাঁদের সহযোগিতায় আছেন একই পরিবারের সদস্য সানোয়ার আলী খান, শের আফজাল খান, ইশরাত হোসেন খান, আলী আক্কাস খান, শাহাদত হোসেন খান, মোয়াজ্জেম হোসেন খান, আমানুল্লাহ খান, সাজ্জাদ আলী খান, আজাদ আলী খান, শওকত আলী খান, কাইয়ুম খান, আলী আমজাদ খান, রেজাউল করিম খান, আলী আজম খান, মোতাহের হোসেন খান, জামশেদ আলী খান, আমজাদ আলী খান, বরকত আলী খান, পারভেজ আলী খান প্রমুখ। তাঁদের সাথে আছেন এলাকার জনপ্রতিনিধিরা। তারা আশা প্রকাশ করেছেন যে, তাঁদের পূর্ব পুরুষের ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হবেন।
লেখক: গবেষক ও সাংবাদিক