পবিত্র লাইলাতুল বরাতের ফজিলত ও ইবাদত

বছর ঘুরে আবারো আমাদের সামনে উপস্থিত পবিত্র শবে বরাত বা লাইলাতুল বরাত। ইসলামি শরিয়তে শবে বরাত এর গুরুত্ব অপরিসীম। যে সমস্ত বরকতময় রজনীতে আল্লাহ্পাক তাঁর বান্দাদের প্রতি রহমতের দৃষ্টি দান করেন শবে বরাত তার মধ্যে অন্যতম। তাফসীর-হাদিস ও বিজ্ঞ আলিমদের পরিভাষায় যাকে শাবানের মধ্য রজনী নামে অভিহিত করা হয়। যে রাতটি হলো শাবান মাসের চৌদ্দ তারিখ দিবাগত রাত। শাবান মাসের এ রাতকে মুক্তির রাত বা নাজাতের রাত হিসেবে অবহিত করা হয়। যে রাতে আল্লাহর নির্দেশে তাঁর রহমতের দরজাগুলো খুলে দেওয়া হয়। তাই শবে বরাত অনেক মর্যাদা ও বরকতপূর্ণ রাত। এ রাতে আল্লাহর কাছে পাপ থেকে মুক্তি কামনা করে প্রার্থনা করা হয়। ফারসি ভাষায় শব অর্থ রাত এবং বরাত অর্থ মুক্তি। শবে বরাত অর্থ মুক্তির রাত। এই রাতে মহান আল্লাহ মুক্তি ও মাগফেরাতের দরজা খুলে দেন সৃষ্টিকুলের প্রতি রহমতের দৃষ্টি দেন এবং মুশরিক ও হিংসুক ব্যতীত সবাইকে ক্ষমা করে দেন। এটি নি:সন্দেহে বরকতময় রাত। শাবান মাসের মধ্যবর্তী হওয়ায় হাদিসে এই রাতকে লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান তথা অর্ধ শাবানের রাত বলা হয়েছে। শাবান এমনই ফজিলতপূর্ণ মাস যে মাসে আল্লাহতাআলা তার রহমত ও বরকতের মাধ্যমে বান্দার সব চাহিদা পূরণ করেন। আর যে ব্যক্তি এমাস পাবে সে আল্লাহর রহমতের অন্তর্ভুক্ত হবে। শাবান মাসের ইবাদাত-বন্দেগির মধ্যে রোজার গুরুত্ব বেশি হওয়ায় প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ মাসে বেশি বেশি রোজা রাখতেন। পবিত্র শাবান মাসের এই ফজিলতপূর্ণ রাত-লাইলাতুল বারাআত।
শবে বরাতের ফজিলত সম্পর্কে হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) থেকে বর্ণিত আছে তিনি বলেন আমি রসুলুল্লাহ (স.) এর সঙ্গে কোনো এক রাতে রাত্রিযাপন করছিলাম। এক সময় আমি তাকে বিছানায় না পেয়ে মনে করলাম তিনি হয়তো অন্য কোনো স্ত্রীর ঘরে গিয়েছেন। আমি তাকে খুঁজতে বের হলাম। গিয়ে দেখি তিনি জান্নাতুল বাকিতে কবরবাসীদের পাশে দাঁড়িয়ে অঝোর নয়নে কাঁদছেন। নবিজি আমাকে উদ্দেশ করে বললেন-হে আয়েশা! তুমি কি মনে করো আল্লাহর রসুল তোমার ওপর বেইনসাফি করেছেন ? আমি বললাম ইয়া রসুলাল্লাহ! আপনাকে বিছানায় না পেয়ে ধারণা করেছিলাম আপনি হয়তো অন্য কোনো স্ত্রীর ঘরে গিয়েছেন। এরপর রসুল (স.) বললেন হে আয়েশা! আজকের রাত সম্পর্কে তুমি জেনে রেখ মহান আল্লাহ এই রাতে দুনিয়ার প্রথম আকাশে অবতীর্ণ হয়ে দুনিয়াবাসীর ওপর তাঁর খাস রহমত নাজিল করেন। কাল্ব গোত্রের মেষের গায়ে যত পশম রয়েছে তার চেয়েও অধিকসংখ্যক বান্দাকে তিনি ক্ষমা করেন। রাসুলুল্লাহ (সা.)রজব ও শাবান মাসব্যাপী এ দোয়া বেশি বেশি পড়তেন : আল্লাহুম্মা বারিক লানা ফি রজব ওয়া শাবান, ওয়া বাল্লিগ না রমাদান। অর্থাৎ-হে আল্লাহ! রজব মাস ও শাবান মাস আমাদের জন্য বরকতময় করুন ; রমজান আমাদের নসিব করুন।
পবিত্র কুরআনে এ রাতকে লাইলাতুম মুবারাকাহ্-বরকতময় রজনি বলে উল্লেখ করা হয়েছে। হাদিস শরিফে রসুল (স.) এ মহিমান্বিত রাতকে লাইলাতুন নিছফি মিন শাবান, শাবান মাসের মধ্যরজনি বলে উল্লেখ করেছেন। হাদিসের ব্যাখ্যাগ্রন্থসমূহ ও তাফসিরের কিতাবে এ রাতের আরো কিছু নাম উল্লেখ হয়েছে। যেমন-লাইলাতুল কিসমাহ্-ভাগ্যের রাত, লাইলাতুত তাজবিয, রিজিক বণ্টনের রাত, লাইলাতুল ফায়সালাহ্-তকদির নির্ধারণের রাত, লাইলাতুল আফউ-ক্ষমার রাত, লাইলাতুল কারামি-দয়ার রাত, লাইলাতুত তাওবাহ্-তাওবার রাত ও লাইলাতুন নাদামাহ্-মিনতির রাত ইত্যাদি। হজরত আলী (রা.) সূত্রে বর্ণিত তিনি বলেন রসুলাল্লাহ (স.) বলেছেন-যখন শাবানের মধ্যরজনি আসবে তখন তোমরা সে রাতে কিয়াম তথা নামাজ পড়বে রাত জেগে ইবাদত করবে এবং পরদিন রোজা রাখবে। কেননা সে দিন সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহ দুনিয়ার আকাশে এসে বান্দাকে এই বলে ডাকতে থাকেন-আছ কি কেউ ক্ষমা প্রার্থনাকারী যাকে আমি ক্ষমা করব। আছ কি কেউ রিজিক প্রার্থনাকারী যাকে আমি রিজিক দিব। আছ কি কেউ বিপদগ্রস্ত যাকে আমি বিপদ থেকে উদ্ধার করব। এভাবে সুবহে সাদিক পর্যন্ত আল্লাহ ঘোষণা দিতে থাকেন। আল্লাহ এ পুণ্যময় রজনিতে অসংখ্য বান্দা-বান্দিকে ক্ষমা করেন তবে দুই শ্রেণির লোকের জন্য তাঁর ক্ষমার দ্বার বন্ধ থাকে। (এক) মুশরিক-যে তাঁর সঙ্গে অন্যকে উপাস্য বানিয়েছে (দুই) বিদ্বেষপোষণকারী যে তার অন্য মুসলমান ভাইয়ের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে। আল্লাহর কাছে পাঁচটি রাত খুবই মর্যাদার। এর মধ্যে শবেবরাতের রাতও রয়েছে। হাদিস শরিফে এসেছে-নিশ্চয়ই পাঁচ রাত্রির দোয়া আল্লাহ কবুল করেন। (১) রজব মাসের প্রথম রাতের দোয়া (২) শবেবরাতের দোয়া (৩) শবেকদরের দোয়া (৪) ঈদুল ফিতরের রাতের দোয়া ও (৫) ঈদুল আজহার রাতের দোয়া।
পবিত্র শবে বরাত মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে উম্মতে মুসলিমার জন্য এক বিশেষ উপহার। তাই এ রাত সম্পর্কে আমাদের বিশেষ যত্নবান হতে হবে। এ রাতের বিশেষ কিছু আমল হচ্ছে-(১) রাত জেগে ইবাদত করা। যেমন-নফল নামাজ কোরআন তেলাওয়াত, জিকির-আযকার, তাওবা-ইস্তিগফার ও দোয়া-দরুদ পাঠ করা ইত্যাদি। (২) ১৫ শাবান রাতে জেগে ইবাদত করা এবং পরদিন রোজা রাখা। (৩) সম্ভব হলে আপনজনদের কবর জিয়ারত করা ও দান-সাদকাহ করা। বন্ধুবান্ধব ও সকল মোমিন মুসলমানের জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করা এবং দেশ ও জাতির কল্যাণ ও সমৃদ্ধি কামনা করে দোয়া করা। যে কোনো মুসলমান সম্পর্কেই বিদ্বেষ পোষণ করা অত্যন্ত মন্দ কাজ। আমাদের কর্তব্য হলো সর্বদা অন্তরকে পরিষ্কার ও পবিত্র রাখা এবং হিংসা –বিদ্বেষ থেকে মুক্ত রাখা। মন্দ ধারণা কবিরা গুনাহ। দোষ অনুসন্ধান করা হারাম। রসুল (স.) নিজের জীবনে এ রাত বারবার পেয়েছেন আমল করেছেন। এ রাতে কী করতে হবে কীভাবে করতে হবে-তা তিনি উম্মতকে শিখিয়ে গেছেন। তাঁর রেখে যাওয়া আদর্শই আমাদের হুবহু অনুসরণ অনুকরণ করতে হবে। পবিত্র শবেবরাত রাতে যা যা করা উচিত নয় : ১. আতশবাজি, পটকা ফোটানো ২. ইবাদত-বন্দেগি বাদ দিয়ে বেহুদা ঘোরাফেরা করা ৩. অনাকাঙ্ক্ষিত আনন্দ-উল্লাস করা ৪. অযথা কথাবার্তা ও বেপরোয়া আচরণ করা ৫. অন্য কারও ইবাদতের বা ঘুমের বিঘ্ন ঘটানো ৭. হালুয়া-রুটি বা খাওয়াদাওয়ার পেছনে বেশি সময় নষ্ট করে ইবাদত থেকে গাফিল থাকা।
মাহে রমজানের আগমনী : বিশ্বজুড়ে অশান্তির দহনে জ্বলছে প্রতিটি আত্মা। শুষ্ক মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে মু’মিন হৃদয়। আত্মার শুষ্কতা কাটাতে সিয়াম আসছে প্রশান্তিময় বৃষ্টি হয়ে। মরুভূমির ধুলো মলিন বালুকণা পরিণত হয় সবুজে ঘেরা বৃক্ষরাজিতে। আর সেই বৃক্ষের ছায়ায় বসে ফল-ফলাদি উপভোগ করবে বিশ্বাসী প্রাণ। পবিত্র শবে বরাত মুসলিমদের কাছে এককথায রমজানের আগমনী বার্তা বয়ে আনে কারণ আরবি ক্যালেন্ডার অনুসারে শাবান মাসের পরেই আসে রমজান মাস। তাই শবে বরাতের রাত থেকে রমজানের প্রস্তুতিও শুরু হয়ে যায় পুরোদমে। রমজানের প্রস্তুতি মানে ইবাদতের প্রস্তুতি। তাই এই মাস থেকেই ইবাদতের পরিমাণ বাড়াতে হবে অন্যদেরও নেক আমলে উৎসাহিত করতে হবে। রমজানের শেষ দশকে রয়েছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আমল ইতিকাফ। পূর্ব থেকেই তার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে। হজরত উম্মে সালমা (রা.) বর্ণনা করেন, চাঁদের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখের রোজা নবীজি (সা.) কখনো তরক করেননি, অনুরূপ তাহাজ্জত নামাজও নবীজি (সা.) কখনো ছাড়েননি ; রমজানের শেষ দশকের ইতিকাফও নবীজি (সা.) কখনো বাদ দেননি। রমজানে যেন ইবাদতের পরিবেশ নিশ্চিত হয় সে প্রস্তুতিও নিতে হবে। দান–-সদকার পরিমাণ বাড়াতে হবে। রমজানে গরিব মানুষ যেন ভালোভাবে ইফতার ও সাহ্রি করতে পারেন তা–ও নিশ্চিত করতে হবে। এসব বিষয়ে পরিকল্পনা রজব ও শাবান মাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আমল। মহানবী (সা.) বলেন যে ব্যক্তি ইমানের সঙ্গে সওয়াবের আশায় রমজান মাসে সিয়াম পালন করবে তার অতীতের সব গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে। যে ব্যক্তি ইমানের সঙ্গে সওয়াবের নিয়তে রমজান মাসে রাত জেগে ইবাদত করবে (তারাবিহ নামাজ পড়বে) তার পূর্বের গুনাহ মার্জনা করে দেওয়া হবে। যে ব্যক্তি ইমানসহ সওয়াবের উদ্দেশ্যে কদরের রাতে ইবাদত করবে তার অতীতের সব গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে। রমজান মাস ইবাদতের বসন্তকাল। এটি রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের মাস। এর প্রধান ইবাদত ‘সিয়াম’। এ মাসের বিশেষ উপহার তারাবিহ নামাজ ও ‘শবে কদর’। এ মাসে প্রতিটি নেক আমলের ফজিলত ৭০ গুণ বৃদ্ধি করা হয়। একেকটি নফল ইবাদতের সওয়াব অন্য মাসের ফরজ ইবাদতের সমান দান করা হয়।
শবে বরাতে ও শাবান মাসের বাকি দিনগুলোতে দিবারাত্র নফল ইবাদতে মশগুল হওয়া রমজানের প্রস্তুতির অংশ। শেষ দুই দিন ব্যতীত পুরো শাবান মাসেই রোজা রাখা মুস্তাহাব। বিশেষত প্রতি চান্দ্রমাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখ আইয়ামে বিদের রোজা রাখা সুন্নত। সোম ও বৃহস্পতিবার রোজা রাখা খাস সুন্নত। হজরত উম্মে সালামা (রা.)-বর্ণনা করেন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তিনটি আমল জীবনে কখনো ছাড়েননি-তাহাজ্জুদের নামাজ, আইয়ামে বিদের রোজা ও রমজানের শেষ ১০ দিনের ইতিকাফ। আমরা যদি আন্তরিকতার সঙ্গে আল্লাহপাকের দরবারে ক্রন্দনরত হয়ে দোয়া করি তাহলে তিনি আমাদের রমজানের কল্যাণ থেকে বঞ্চিত করবেন না। আল্লাহপাক আমাদের এই শবেবরাত রাতে ইখলাসের সঙ্গে ইবাদত-বন্দেগি করে তার নৈকট্য হাসিলের তৌফিক দান করুন। আমিন। ইয়া রাব্বুল আলামিন।
লেখক : ফখরুল ইসলাম নোমানী, ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট