জিয়াউল কুদ্দুস:
কিছু কিছু লোক আছেন যাদের চেহারা, শরীরী ভাষা, চলাফেরায় স্বতঃস্ফূর্ত ভাবেই বোঝা যায়, লোকটি গুরুত্বপূর্ণ।
দশজনের একজন নয়। একাদশতম লোক।
তাদের উপস্থিতিই একটা সম্ভ্রম, একটা সমীহ জাগিয়ে তোলে, আমাদের শামসুদ্দীন শিশির সেই গোত্রের লোক।
তাঁর সাথে আমার পরিচয় অতি সম্প্রতি। দুই তিন বছর হবে। কিছু লোকের সাথে দেখা হওয়া মাত্র মনে হয়, একে জনম জনম থেকে চিনি। কিছু লোকের সাথে সারা জীবন বসবাস করেও মনে হয় অচেনা।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যথার্থই বলেছিলেন, “পরিচয়ের গভীরতা জানাশোনার পরিধির উপর নির্ভর করে না।”
শামসুদ্দীন শিশিরের পিতা ছিলেন শিক্ষক, মাতা ছিলেন আদর্শ মা। ছয় ভাইবোন। শামসুদ্দীন শিশির বয়োজ্যেষ্ঠ। শিশির স্যারদের যুগে বড় ভাইদের কাঁধে অনেক দায়িত্ব থাকতো। প্রকৃত বড় ভাই হওয়া সহজ কাজ ছিলো না। বড় ভাইয়ের সম্মানটুকু সারা জীবনের সাধনা দিয়ে অর্জন করে নিতে হতো। শিশির সেটা অর্জন করেছেন, সহজ ভাবে, সহজাত ভাবে। ভাই-বোন, স্ত্রী এবং দু’কন্যাকে নিয়ে তাঁর ছোট্ট সুন্দর জীবন ।
শিক্ষকতাকে পেশা হিসাবে নেওয়া, প্রচলিত মানদণ্ডে খুবই ঝুঁকিপূর্ণ ব্যাপার। এখন সকলে সেই ধরনের পেশা খুঁজতে থাকে যেটাতে দ্রুত টাকাওয়ালা হওয়ার সম্ভাবনা আছে। অথবা সরকারি আমলা হয়ে, কিছুটা ক্ষমতার কাছাকাছি গিয়ে ক্ষমতার ছড়ি ঘোরানোর স্বাদ ও টাকার স্বাদ দুটোই পাওয়া যায়।
শিক্ষকদের সামাজিক সম্মানের বিষয়ে বক্তৃতা বিবৃতিতে অনেক আলোচনা হয় বটে । কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, শিক্ষকদের সম্মানের বিষয়টা এবং তাঁদের সামাজিক গুরুত্ব অনেকদিন আগে থেকেই ক্রম- হ্রাসমান।
এই রকম একটি সামাজিক পরিপ্রেক্ষিতে Honesty of purpose, Dedication এবং Commitment এর সাথে নিরলস অবিরাম Hard Work করে শিক্ষাখাতেও যে সম্মান অর্জন করা যায়, সামাজিক প্রতিপত্তি অর্জন করা যায়। গুণমুগ্ধ ছাত্র ও শিষ্যদের একটা অনুসারী দল গড়ে তোলা যায় ; শামসুদ্দীনন শিশির তাঁর জীবন সাধনায় সেটা করে দেখালেন এবং করে দেখাচ্ছেন। Bravo…!!!
শামসুদ্দীন শিশিরের জন্ম কুমিল্লা’র নাঙ্গলকোটে, প্রাথমিক প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া শুরু কুমিল্লাতেই। ছোটবেলাতেই চট্টগ্রাম শহরে চলে আসেন এবং ধরতে গেলে চট্টগ্রাম শহরের আজীবন বাসিন্দা। চট্টগ্রাম শহরেই তার কৈশোর, যৌবনকাল কেটেছে।
চট্টগ্রাম শহরের পরিবেশ, বিশেষ করে চট্টগ্রাম শহরের একাডেমিক পরিবেশের প্রভাবেই তার মন-মানসিকতা গড়ে উঠেছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তর ( রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ) ডিগ্রি অর্জন করেছেন। যেহেতু শিক্ষকতাকেই পেশা হিসাবে নিয়েছেন, তাই প্রয়োজনীয় পেশাগত ডিগ্রি অর্জন করেছেন। তিনি বি. এড ( জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়) এবং এম.এড( বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়) উভয় পরীক্ষায় প্রথম শ্রেনীতে দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেছিলেন। এটা তাঁর একাডেমিক এক্সেলেন্স এর একটা মাপকাঠিও বটে।
আরো একটি চমৎকার ব্যাপার হলো শামসুদ্দীন শিশির জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে সরকার ও রাজনীতি বিভাগ থেকে প্রফেসর মোঃ শামছুল আলম এর তত্ত্বাবধানে তার বহু প্রতীক্ষিত PhD গবেষণা’র কাজে নিরলস ভাবে লেগে থেকে ২০২২ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষ ভাগে PhD ডিগ্রি যথানিয়মে অর্জন করেছেন। তিনি যে পেশায় নিয়োজিত সেখানে এই জমানায় স্বাভাবিক ভাবেই PhD ডিগ্রি প্রয়োজন হয়। মহান আল্লাহ তায়ালা সেই প্রয়োজনটুকুও পূরণ করে দিয়েছেন। তাঁর গবেষণার শিরোনাম ছিল – ” বাংলাদেশের নৃগোষ্ঠী খুমী সম্প্রদায়ের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থা: একটি নৃতাত্ত্বিক অধ্যয়ন।
এরকম একাডেমিক ভালো রেজাল্ট অনেকেই করে থাকেন, তাদের কয়জনকে সাধারণ শিক্ষকেরা চেনেন? কেন শিক্ষক মহলে শামসুদ্দীন শিশির স্যারের নাম শ্রদ্ধার সাথে, ভালবাসার সাথে উচ্চারিত হয় ?
এর প্রকৃত কারণ শিশির স্যার সত্যিকার ভাবেই ছোট বড় সকল শিক্ষকদের মান উন্নয়নের ব্যাপারে শতভাগ আন্তরিকতার সাথে চেষ্টা করেন। প্রয়োজনীয় ধৈর্যশীল সময় দেন। ফলোআপ করেন। শিক্ষকদের সুখেদুঃখে তাঁদের পাশে থাকেন।
শিক্ষকদের প্রতি ভালবাসার সম্পর্কে শামসুদ্দীন শিশিরের আন্তরিকতায় কোন খাদ নেই।
তিনি নিজেকেও তাঁদেরই একজন বলে মনে করেন। শিক্ষকদের সুখেদুঃখে, আন্দোলনে, উত্থানে পতনে সর্বদা তাঁদের সাথে তিনি থাকেন।
এসকল কার্যকলাপ তাঁর নিরলস প্রচেষ্টার দ্বারা সদা দৃশ্যমান ও পরিস্ফুটিত। ধারাবাহিক ভাবে, দীর্ঘকাল ধরে, বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলে তিনি “শিক্ষকদের শিক্ষক” হিসাবে পরিচিত।
বর্তমান জমানায় এই রকম একটি ইমেজ, নিজের জন্য গড়ে তোলা কোন মানদণ্ডেই সহজ কাজ নয়।
শামসুদ্দীন শিশির তাঁর দীর্ঘ অভিজ্ঞতার আলোকে শিক্ষা বিষয়ক বেশ কিছু বই রচনা করেছেন এবং পুস্তকাকারে প্রকাশ করেছেন। চট্টগ্রাম শহরে আপন আলো নামের মানসম্মত একটি প্রকাশনা সংস্থার উপদেষ্টা । এইসকল শিক্ষা বিষয়ক পুস্তক তিনি বিভিন্ন স্কুল কলেজে অলাভজনক ভাবে বিতরণ করে থাকেন। বেশীর ভাগ সময়ে ছাপার খরচও উসুল হয় না।
কিন্তু শামসুদ্দীন শিশির এতে দমে যাবার পাত্র নন। তিনি নিজের পকেটের পয়সা খরচ করে শিক্ষা বিষয়ক পুস্তক প্রকাশ করা ও বিতরণ করার কাজটি অব্যাহত রেখেছেন। এটাকে তিনি মিশন হিসাবে নিয়েছেন।
চট্টগ্রাম অঞ্চলের শিক্ষকগণ যদি তাঁর রচিত শিক্ষা বিষয়ক পুস্তকসমূহ মনোযোগ দিয়ে পাঠ করেন ও অনুশীলন করেন, তবে তাঁদের নিজেদেরই অনেক উপকার হবে, তাঁরা নিজেরাই সমৃদ্ধ হবেন।
পারিবারিক ভাবে ও ব্যক্তিগতভাবে শামসুদ্দীন শিশির অনাড়ম্বর ও সহজ সরল জীবন যাত্রায় বিশ্বাসী এবং সেই আদর্শেই জীবন যাপন করে থাকেন।
এই যুগে অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ব বিরল, শামসুদ্দীন শিশির এর কর্মসাধনায় ও ব্যাক্তিগত জীবনে একজন অনুসরণীয় ব্যক্তিকে আমরা পেয়েছি। এটা আমাদের পরম সৌভাগ্য।
আমাদের শিক্ষার উন্নয়ন ও আধুনিকায়নের জন্য আরো অনেক “শামসুদ্দীন শিশির” দরকার।