টেকনাফে বির্পযস্থ জনজীবন, পাহাড় ধ্বসে প্রাণহানির আশঙ্কা

কক্সবাজার টেকনাফে গত কয়েকদিন ধরে মুশলধারে বৃষ্টিপাত অব্যাহত রয়েছে। এতে বির্পযস্থ হয়ে পড়েছে জনজীবন ।

ভারী ও মুশলধারে টানা বৃষ্টিতে পাহাড় ধ্বসের আশংকা করছেন অনেকে। কিন্তু পাহাড়ের খাঁজে ভাঁজে ও পাদদেশে বসবাসরতরা চরম আতংকে থাকলেও এখনো সেখান হতে অন্য কোথাও নিরাপদ আশ্রয়ে যায়নি কেউ। ফলে চরম ঝুঁকিতে রয়েছে হাজার হাজার হত দরিদ্র ভূমিহীন ও রোহিঙ্গা পরিবার। সরকার টেকনাফের পাহাড় গুলোকে সংরক্ষিত বনাঞ্চল ঘোষনা করছে। এরপরও সরকারী সংরক্ষিত বন বিভাগের জমিতে হাজার হাজার বসতি গড়ে উঠেছে। স্থানীয় হত দরিদ্র লোকজন ও অনিবন্ধিত রোহিঙ্গারা মিলে এসব বসতি গুলোতে বসবাস করে আসছিল। এর বাইরে সরকারী সম্মতিতে হোয়াইক্যং এর উনছিপ্রাং পুটিবনিয়া, হ্নীলার লেদা, মৌচনী ও শালবাগানসহ বেশ কটি পাহাড়ে মিয়ানমার হতে পালিয়ে এসে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পও গড়ে উঠেছে। এদের মধ্যেও অনেকে পাহাড়ের ঝুকিঁর্পূণ এলাকায় বসবাস করছে। উপজেলার বিস্তীর্ণ পাহাড়ে ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছে স্থানীয় ও রোহিঙ্গাসহ প্রায় ৩০ হাজার পরিবার। বর্ষা মৌসুমে পাহাড় ধ্বসে ঝুঁকিপুর্ণ এসব বসবাসকারীদের প্রাণহানির আশংকা রয়েছে। বিগত সময়গুলোতে পাহাড় ধ্বসে শতাধিক মানুষ প্রানহানি হলেও পুনর্বাসন না করায় আবারও ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করে আসছে তারা। উপজেলা জুড়ে পাহাড়ে দিন দিন অবৈধ স্থাপনা বৃদ্ধির নেপথ্যে কাজ করছে বিদ্যুৎ সংযোগ ও স্থানীয় প্রভাবশালী ভূমিদস্যুদের মদদ। এদের অধিকাংশ বসতি স্থাপনকারী রোহিঙ্গা ও স্বল্প সংখ্যক ভুমিহিন পরিবার। এ ছাড়া পাহাড়ের পাদদেশে এবং গভীর অরন্যে গড়ে উঠেছে দালান কোটা। যেখানে বসবাসকারীদের সুবিধার্থে বিদ্যুতায়নের ব্যবস্থা করা হয়েছে । অনুসন্ধানে দেখা যায়, মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা কোন নিয়মনিতী না মেনে পাহাড়ী গাছপালা এবং পাহাড় কেটে বিলীন করে নিজের ইচ্ছামত বসতি স্থাপন করে আসছে। বর্তমানে টেকনাফ উপজেলার বিভিন্ন পাহাড়ে প্রায় এক লক্ষ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী চরম ঝুঁকির মধ্যে বসবাস করছে। এই রোহিঙ্গারা যে কোন সময় পাহাড়-ধ্বসের প্রানহানি হওয়ার আশংকা রয়েছে। অপরদিকে প্রায় এক হাজার স্থানীয় পরিবার ভূমিধ্বসের শিকার হওয়ার আশংকায় রয়েছে। এদের কোথাও মাথা গোঁজার মত ঠাই না থাকায় হতদরিদ্রও স্থানীয় জনগোষ্টিদের মধ্যে অনেকেই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পাহাড়ে বসতি স্থাপন করছে। এমনকি টেকনাফ পুরাতন পল্লান পাড়া ও নাইট্যং পাড়া বনবিভাগের অফিসের পাশে স্থানীয় প্রভাবশালীর নাম ভাঙ্গিয়ে সরকারি পাহাড়ে রোহিঙ্গা ও স্থানীয়দের প্লট বিক্রি করা হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। প্রতিবছর বর্ষায় প্রবল বর্ষণে পাহাড় ধ্বসে নিহতের ঘটনা ঘটলেও কিন্তু বর্ষা মৌসুমে শুরুতে ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড় থেকে বসবাসকারীদের এখনোও উচ্ছেদ করা যায়নি। বসবাসকারী ফরিদ আলম, জহির আহমদ ও মো. আলম বলেন, আমরা ভূমিহীন পরিবার এবং আমাদের অন্যত্র বসবাস করার মত কোন জায়গা নেই। সে জন্য পাহাড়ে ঝুঁকি উপক্ষো করে কুড়ে ঘর করে জীবন নিয়ে বসবাস করছি।
খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, টেকনাফের নাইট্যংপাড়া, পুরাতন পল্লান পাড়া, ফকিরা মুড়া, জাহালিয়া পাড়া, হাবির ছড়া, রাজারছড়া, বরইতলী, কেরুনতলী, হ্নীলা ইউনিয়নের দমদমিয়া, জাঁদিমুড়া, পানখালী, উলুচামরী, মৌলভী বাজারের রোজার ঘোনা, মরিচ্যাঘোনা, হোয়াইক্যং ইউনিয়নের কম্বনিয়া পাড়া, নয়াবাজার সাতঘরিয়া পাড়া, নয়াপাড়া, কাঞ্জর পাড়া, লম্বাবিল, লাঁতুড়ি খোলা, চাকমা পাড়া, ও বাহারছড়া ইউনিয়নসহ বিভিন্ন এলাকায় বনবিভাগের পাহাড়ে স্থাপনা তৈরী করে বসতবাড়ি করে ঝুকিপূর্ণ ভাবে বসবাস করে আসছে কয়েক হাজার পরিবার। উপজেলা প্রশাসন ও বন বিভাগ প্রতিবছর বর্ষার শুরুতে ঝুকিপূর্ণ বসবাসকারীদের নিরাপদ স্থানে সরে নেওয়ার জন্য প্রশাসন তৎপর থাকলেও, গত একযুগ ধরে এ সমস্যা ঝুলে রয়েছে। চলছে ফের ভারি বর্ষণের মৌসুম। এসব পাহাড়ি এলাকায় বসবাসকারী পরিবার গুলোর মাঝে দেখা দিয়েছে চরম আতংক ও হতাশা। কাটাচ্ছে নির্ঘুম রাত। বিপদ জেনেও ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করে আসছে এরা। পাহাড়ের অনেকাংশ বালি মাটি মিশ্রিত যেখানে বসতি তো দূরের কথা কোন ধরণের অবকাঠামো নির্মাণের জন্য উপযুক্ত নয়। কিন্তু এসব পাহাড়ের বনভূমিগুলো সরকারি বন বিভাগের কোন নিয়ম নীতি তোয়ক্কা না করে ভাসমান রোহিঙ্গা, স্থানীয় হতদরিদ্র পরিবার ও প্রভাবশালীদের নিয়ন্ত্রণে প্রায় লক্ষাধিক মানুষ পাহাড়ের ঢালুতে ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করে আসছে। জানা যায়, টেকনাফের সদর ইউনিয়ন, পৌর সভা, বাহার ছড়া, হ্নীলা ও হোয়াইক্যং এলাকায় বনাঞ্চল রয়েছে প্রায় ২৮ হাজার একর বা ১২ হাজার হেক্টর। ৩ টি রেঞ্জে ভাগ করে ১০ বিটের মাধ্যমে দেখভাল করছেন বন বিভাগ। হোয়াইক্যং, হ্নীলা ও বাহারছড়া শামলাপুর পাহাড়ী এলাকায় রোহিঙ্গা ক্যাম্প গড়ে উঠায় সেখানে পাহাড়ী পরিবেশ মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। ৭ জুলাই (রোববার) সকাল থেকে উপজেলা প্রশাসন ও বনবিভাগের পক্ষ থেকে টেকনাফ সদর, পৌরসভা, হ্নীলা, হোয়াইক্যং ও বাহারছড়া ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকায় তাদের নিরাপদে সরে যেতে মাইকিং করা হয়।
টেকনাফ বন বিভাগের রেঞ্জ কর্মকর্তা মো: সাজ্জাদ হোসেন জানান, ইতিমধ্যে ১০৫ টি পরিবারকে পাহাড়ের ঝুকিঁর্পূণ এলাকা হতে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। সাগরে নিম্ন চাপের সংকেত ও অতি বৃষ্টির কারণে পাহাড় ধ্বসের আশংকা থাকায় মাইকিং করা হয়েছে। যাতে পাহাড়ে ঝুকিঁপূর্ণ অবস্থায় বসতি গড়ে যে সব পরিবার রয়েছে তারা সরে আসে। তা না হলে ফের উচ্ছেদ অভিযান চালানো হবে। বনবিভাগ সূত্রে আরো জানা যায়, টেকনাফ উপজেলায় জেলা দক্ষিন বনবিভাগের আওতাধীন ৩৯ হাজার হেক্টর বনভূমিতে অবৈধভাবে প্রায় ৩০ হাজার মানুষ বসবাস করে আসলেও এর মধ্যে পাহাড়ের ঝুকিপূর্ণ পাদদেশে বসবাস করছে অনেক পরিবার। পাহাড়ের পাদদেশে স্থানীয় লোকজনের পাশাপাশি মিয়ানমার থেকে অবৈধভাবে অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গারা পলিথিন ও বাঁশের ঝুপঁড়ি ঘর, মাটিঘর, সেমিপাকা ঘর তৈরি করে পরিবার-পরিজন নিয়ে বসবাস করে আসছে। তিনি আরো জানান, গত দু বছর ধরে টেকনাফের বেশ কিছু পাহাড়ে মিয়ানমার হতে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা ক্যাম্প গড়ে তোলায় এ মুহূর্তে টেকনাফের পাহাড়ে ঠিক কত পরিবার অবৈধ ভাবে বসতি গড়ে তুলে অবস্থান করছে তার পরিসংখ্যান নেই। টেকনাফ উপজেলা নিবার্হী কর্মকর্তা রবিউল হাসান বলেন, ‘এখন বর্ষাকাল তার উপর টানা বৃষ্টিপাতের ফলে পাহাড় ধ্বসের আশঙ্কা রয়েছে। তাই আমরা পুরো উপজেলার বিভিন্ন পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারীদের নিরাপদে অন্যত্রে সরে যেতে মাইকিং করে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। নিরাপদে স্বইচ্ছায় সরে না গেলে প্রশাসনের উদ্যোগে তাদেরকে উচ্ছেদের ব্যবস্থা নেওয়া হবে।