‘ইলিশের বাড়ি’ চাঁদপুর, চাঁদপুরেই এতো দাম!

বাঙালির পরিচয় ‘মাছে-ভাতে’। নদীমাতৃক এই দেশে সহজেই মেলে পছন্দের নানা জাত ও সাধের মাছ। জাতীয় মাছ ইলিশ পছন্দ করেন না এমন বাঙালি মেলা ভার। তবে দামের কারণে ভরা মৌসুমেও অনেকের পাতে ওঠেনি রুপালি ইলিশ।

দেশসেরা ইলিশ মেলে দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের জেলা চাঁদপুরে। পদ্মা-মেঘনা ও ডাকাতিয়ার ত্রিমোহনার ঢেউয়ে যেন ইলিশের স্বাদ আরও বেড়ে যায়। সবাই মুখিয়ে থাকে এই ইলিশের আশায়। তাই দেশের নানা প্রান্ত থেকে ‘ইলিশের বাড়ি’ চাঁদপুরে ছুটে আসেন ইলিশের সাধ নিতে। তবে আকাশ ছোঁয়া দামের কারণে হতাশও হতে হয়।

লঞ্চ ভ্রমণও হবে, আবার ইলিশের সাধও নেয়া হবে- সেই আশায় স্ত্রী-সন্তান নিয়ে ঢাকা থেকে চাঁদপুরে আসেন বেসরকারি চাকরিজীবী সানোয়ার হোসেন। কিন্তু চাঁদপুরে এসে দেখলেন ভিন্ন চিত্র। ঢাকার চেয়ে কোনো অংশে দাম কম নয়, বরং বেশি। হতাশ হয়ে চাঁদপুর বড়স্টেশন মাছঘাট ঘুরে স্ত্রী-সন্তানের হাত ধরে চলে যান হরিণা ফেরিঘাটে। সেখানে গিয়ে আরও হতাশ হন। ছোট-বড় সব মাছই আছে। তবে প্রথমে নিলামে উঠিয়ে এরপর বিক্রি করা হচ্ছে। ২৫০-৩০০ গ্রাম আকারের জাটকা বিক্রি হচ্ছে সাড়ে ৭০০ টাকা কেজি দরে। আর এক কেজি সাইজের প্রতি পিস ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ১৮০০-২২০০ টাকায়। আরও বড় ইলিশের দাম আরও বেশি।

আক্ষেপের সুরে তিনি বললেন,
মূল ঘাটেই যদি ইলিশের এতো দাম হয় তাহলে কিনব কি করে? যেহেতু ঢাকা থেকে কষ্ট করে এসেছি তাই কয়েকটি ছোট সাইজের মাছ কিনে নিলাম।

সানোয়ারের মতো অনেকেই চাঁদপুরে আসেন মাছ কিনতে। মাছ কেনার পর অনেকে আবার ঘাটে বসেই হোটেল থেকে টাটকা ইলিশের সাধ নিতে ভুল করেন না।

তেমনই একজন মিরাজ হাসান। তিনিও ঢাকা থেকে বন্ধুদের সঙ্গে এসেছেন চাঁদপুরের ইলিশ খেতে। বড়স্টেশন মাছঘাটে একটি হোটেলে কথা হয় তার সঙ্গে। পাঁচ বন্ধু মিলে অপেক্ষা করছেন গরম গরম ইলিশ ভাজার সঙ্গে বেগুন ভাজা দিয়ে ভাত খাবেন। তবে দাম নিয়ে আক্ষেপ তার কণ্ঠেও। ৫ টুকরো বড় সাইজের ইলিশ ভাজার দাম ২০০০ টাকা; প্রতি টুকরো ৪০০ টাকা করে।

দাম বেশি হলেও ঘাটে বসে টাটকা ইলিশ খাওয়ার মজাই আলাদা, বললেন তিনি।
ভরা মৌসুমেও চাঁদপুরে কেন ইলিশের এতো দাম, জানতে চাইলে বড়স্টেশন মাছঘাটের ব্যবসায়ী ফয়েজ ঢালি সময় সংবাদকে বলেন, এখন মৌসুম প্রায় শেষের দিকে, মাছও ধরা পড়ছে কম। আগে এখানে চট্টগ্রাম, নোয়াখালীর হাতিয়া, ভোলা ও বরিশালের ইলিশ আসতো। কিন্তু এখন খুব একটা আসে না। যার কারণে চাহিদার তুলনায় মাছের সরবরাহ কম। এ জন্য দামও অনেক বেশি। এ ছাড়া প্রজনন মৌসুমে ইলিশের নিরাপদ প্রজননের লক্ষ্যে আগামী ১২ অক্টোবর থেকে ২ নভেম্বর পর্যন্ত ২২ দিন সারা দেশে ইলিশ আহরণ, পরিবহন, ক্রয়-বিক্রয়, মজুত ও বিনিময় বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে সরকার। এ জন্যও মাছের দাম বেড়ে গেছে বলে জানান তিনি।

মাছ কেন কম ধরা পড়ছে জানতে চাইলে সদর উপজেলার রাজরাজেশ্বর ইউনিয়নের জেলে সালাম বলেন,
মার্চ-এপ্রিল জাটকা রক্ষা অভিযানের পর থেকে পদ্মা-মেঘনায় ইলিশ কম। ভরা মৌসুমে এসেও ইলিশের আকাল পড়েছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা জাল বেয়েও কাঙ্ক্ষিত ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে না। যা ইলিশ ওঠে তেলের খরচও হয় না। আগে প্রচুর ইলিশ পেতাম, দামও কম ছিল। কিন্তু এখন ইলিশ কম থাকায় দাম বেশি।

চাঁদপুর জেলা মৎস্য কর্মকর্তা গোলাম মেহেদী হাসান জানান, জেলায় নিবন্ধিত জেলে আছেন ৪৪ হাজার ৩৫ জন। এর বাইরে আরও ১০-১৫ হাজার জেলে রয়েছেন। পদ্মা-মেঘনা নৌ সীমানায় প্রতিদিন সহস্রাধিক নৌকা ইলিশ ধরে। পদ্মা মেঘনা ইলিশ একেবারে কম তা বলা যাবে না, কিছু কিছু ইলিশও পায়। এ বছর বৃষ্টি ও নদীর পানি কম থাকায় ইলিশ কম পাওয়া যাচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, চাঁদপুরে মূলত পদ্মা ও মেঘনা নদীতে অতিরিক্ত বালুখননে ইলিশের অবাদ বিচরণে প্রভাব পড়েছে। এ ছাড়া শীতলক্ষ্যার দূষিত পানি এ নদীতে প্রবাহ হওয়ায় ইলিশ বিচরণ করতে পারছে না। ফলে মাছ কম ধরা পড়ছে। আগে যেখানে বছরে ইলিশের সরবরাহ হতো ২-৩ হাজার মণ, এখন তা এসে দাঁড়িয়েছে ৫০০-১০০০ মণে। মূলত সরবরাহের ওপর দাম নির্ধারণ হয়ে থাকে। এ বছর ইলিশের প্রচুর চাহিদা থাকায় দাম লাগামে আসছে না।

মাছ কম ধরা পড়ার কারণ জানতে চাইলে ইলিশ গবেষক ড. আনিসুর রহমান জানান,
তিনি ৩৩ বছর চাঁদপুর নদী গবেষণা কেন্দ্রে চাকরি করেছেন। দীর্ঘ কর্মজীবনে তিনি দেখেছেন, দু’দশক আগেও বড় বড় ইলিশের দেখা মিলত না। তখন সরকারের উদ্যোগে মা ইলিশ সংরক্ষণের ফলে কয়েক বছরের মধ্যে চিত্র বদলে যায়। ঝাঁকে ঝাঁকে ধরা পড়ে বড় বড় ইলিশ। এখন আবার শোনা যায়, মাছ কম ধরা পড়ছে। আসলে মাছ কম ধরা পড়ছে এটা পুরোপুরি সঠিক নয়; বৃষ্টি কমার কারণে এবং নদীতে পানি কম থাকায় মাছ ধরা একটু কমেছে।

চাঁদপুরে ইলিশের দাম এত বেশি কেন- জানতে চাইলে এই মাছ গবেষক বলেন, দেশব্যাপী চাঁদপুরের ইলিশের কদর আছে। সবাই নদীর ইলিশ কেনার জন্য চাঁদপুরে ছুটে যায়। ফলে চাহিদা বেশি থাকায় ব্যবসায়ীরাও সুযোগ কাজে লাগিয়ে দামটা বাড়িয়ে দেয়। এ ছাড়া জেলেরা সারা বছর দাদন ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে টাকা নেয়। ফলে এ মধ্যস্বত্বভোগীদের কারণে দাম অনেক বেড়ে যায়। এ জন্য সবার পাতে জাতীয় এই মাছ আর ওঠে না। সবাইকে ইলিশ খাওয়ার সুযোগ করে দেয়ার জন্য এসব সিন্ডিকেট ভাঙতে হবে।