চট্টগ্রামে জলাবদ্ধতা নিরসন : সঠিক পরিকল্পনা, যথাযথ প্রকল্প বান্তবায়ন, সমন্বয় ও মানুষের সচেতনতা জরুরী

মির্জা ইমতিয়াজ শাওন::::
বহু চেষ্টা ও অর্থ খরচ করেও চট্টগ্রাম নগরের জলাবদ্ধতা নিরসন তো হয়নি বরং তা আরো প্রকট হয়েছে। এখন নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। আবার বেশি সময় ধরে পানি জমে থাকছে। বৃষ্টিপাত হলেই চট্টগ্রামে জলাবদ্ধতা কিম্বা জলজট দেখা দিচ্ছে।

চলুন বৃষ্টিপাত বিষয়ে ছোটখাট কয়েকটি তথ্য জেনে নেই, ভাসমান মেঘ ঘনীভূত হয়ে মাধ্যাকর্ষণ শক্তির টানে পানির ফোঁটা ফোঁটা আকারে ভূপৃষ্ঠে নেমে এলে তাকে বৃষ্টিপাত বলে। আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য মতে, ২৪ ঘণ্টায় ১-১০ মিলিমিটার বৃষ্টি হলে হালকা, ১১-২২ মিলিমিটার মাঝারি, ২৩-৪৩ মিলিমিটার মাঝারি ধরনের ভারী, ৪৪-৮৮ ভারী এবং ৮৮ মিলিমিটারের বেশি বৃষ্টি হলে তাকে অতিভারী বৃষ্টিপাত বলে। ভৌগোলিকভাবে বাংলাদেশ একটি বৃষ্টিপ্রবণ এলাকা। আমাদের গড় বৃষ্টিপাতের প্রায় ৭০ থেকে ৮০ ভাগ হয় জুন থেকে অক্টোবর মাসে। স্বাভাবিক ভাবে মনে করা হয় ভারী এবং অতিভারী বৃষ্টিপাত এর কারনে জলাবদ্ধতা হয়। কিন্ত বর্তমান সময়ে চট্টগ্রাম নগরীতে অল্প বৃষ্টিপাতেই জলাবদ্ধতা কিম্বা জলজট দেখা দিচ্ছে এটা অতন্ত্য উদ্বেগের কারণ হয়ে দাড়িয়েছে।

গণমাধ্যমের খবর বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় অল্প বৃষ্টি আর জোয়ারে ডুবছে চট্টগ্রাম। বৃষ্টি হলেই নগরীর মুরাদপুর, বহদ্দারহাট, কাপাসগোলা, বাদুরতলা, চকবাজার, ডিসি রোড, ফুলতলা, বাকলিয়া, কাতালগঞ্জ, আরাকান রোড, বহদ্দারহাট বাস টার্মিনাল সড়ক, তিন পোলের মাথা ও হালিশহরের বিভিন্ন এলাকায় পানি জমে থাকছে।

বোদ্ধাজনেরা মনে করেন বৃষ্টির পানি যদি সঠিকভাবে ড্রেনের মাধ্যমে নদীতে চলে যেতে পারে তাহলেই এ জলাবদ্ধতা দূর হয়ে যাবে। চট্টগ্রাম তথা আমাদের দেশের অন্য শহরগুলোয় প্রয়োজনের তুলনায় ড্রেনেজ ব্যবস্থা খারাপ; কিন্তু যেগুলো আছে, আমাদের অসচেতনতার ফলে নানা ভাবে সেগুলোতে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়ে সেগুলো দিয়েও সঠিকভাবে পানি যেতে পারে না। জলাবদ্ধতার খুব দ্রুত সমাধান করা না হলে ভবিষ্যতে মাত্র ২০০ মিমি বৃষ্টিপাতেও চট্টগ্রাম শহরের বেশিরভাগ নিচু এলাকা ১ দশমিক ৩ ফুট পানির নিচে তলিয়ে যেতে পারে বলে মনে করেন তারা।

১৯৬৯ সালে যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক কোম্পানি জন আর স্নেল যখন শহরের ড্রেনেজ মাস্টার প্ল্যান প্রণয়ন করেন, তখন নগরীতে ৭০টি খাল পাওয়া যায়। চট্টগ্রাম ওয়াসা পরিচালিত সমীক্ষা অনুসারে, ৫৩ বছরে খালের সংখ্যা ৭০ শতাংশ হ্রাস পেয়ে বর্তমানে ২২টিতে দাঁড়িয়েছে।

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের জন্য মাল্টি হ্যাজার্ড কন্টিনজেন্সি প্ল্যান শীর্ষক সমীক্ষায় আরও জানা গেছে, চসিকের মোট ২২টি ওয়ার্ড সরাসরি জলাবদ্ধতার ঝুঁকিতে রয়েছে, এর মধ্যে ৬টি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ, ৩টি চরম ঝুঁকিতে এবং ১৩ টি ওয়ার্ড মাঝারি ঝুঁকিতে রয়েছে।

২০২২ সালের নভেম্বরে, বেসরকারি সংস্থা ইপসা পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে চট্টগ্রামের সাড়ে ১৩ বর্গকিলোমিটার এলাকা সরাসরি জলাবদ্ধতার ঝুঁকিতে আছে। আর পরোক্ষ ঝুঁকিতে আছে ৫২ বর্গকিলোমিটার এলাকা। সমীক্ষায় আরও বলা হয়, বিগত ৫৩ বছরে শহরের ৭০ শতাংশ খাল বিলীন হয়ে গেছে। একই গবেষনায় অপরিকল্পিত নগরায়নকেই জলাবদ্ধতার ঝুঁকির অন্যতম কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। অপরিকল্পিতভাবে অবকাঠামো গড়ে তোলায় আগ্রাবাদ, হালিশহর, বাকালিয়া, মোহরা, খাতুনগঞ্জ ও চাক্তাইসহ নগরীর নিম্নাঞ্চল শুষ্ক মৌসুমেও জোয়ারের পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে।

চট্টগ্রামে জলাবদ্ধতা নিরসনের সোচ্চার কন্ঠ, চট্টগ্রাম নাগরিক ফোরামের চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার মনোয়ার হোসেন মনে করেন চট্টগ্রামে জলাবদ্ধতা নিরসনের কাজ ১৯৯০ থেকে ১৯৯৭ পর্যন্ত চলেছিল । সমস্যার অনেকটা সমাধান হয়ে গেছে মনে হয়েছিলো অন্তত: ১০ বছর যাবত । কিন্তু দু:খের বিষয়, পরবর্তীতে নিয়মিত সংস্কার না করা ও ১৯৯৫ এর সংশোধিত মাষ্টার প্লান অনুযায়ী পরবর্তী কাজগুলো না করায় চট্টগ্রামের সমস্যা আবারো প্রকট হয়ে ফিরে আসে। দ্রুত ড্রেনেজ মাষ্টার প্লান অনুযায়ী কাজ করলে চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা কমবে। আর সব প্রকল্পের কাজ সঠিক-যোগ্য ব্যক্তির যথাস্থানে পদায়নের মাধ্যমে সমন্বিত ও পরিকল্পিত ভাবে করতে হবে, নয়তো সুফল পাবে না চট্টগ্রাম। একই সাথে নগরবাসীকেও জলাবদ্ধতা নিরসনের পকল্পের সাথে সংযুক্ত ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনার বিষয়ে সচেতন করতে হবে।

জলাবদ্ধতা নিয়ে কাজ করছেন এমন এমন এক জন গবেষক চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) নগর ও আঞ্চলিক পরিকল্পনা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. শাহ জালাল মিসুক মনে করেন, ‘যদি আমরা সিডিএ মেগা প্রকল্প বা জলাবদ্ধতা সংক্রান্ত অন্য যে কোনো প্রকল্পের সুবিধা পেতে চাই, তবে আমাদের পরিকল্পিত নগরায়ণে যেতে হবে। শহরের হারিয়ে যাওয়া খালগুলো পুনরুদ্ধার করতে হবে এবং বিদ্যমান খালগুলোকে অবৈধ দখল থেকে মুক্ত করতে হবে। এ বিষয়ে গণসচেতনতা তৈরি করা আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মানুষের উচিত খাল-নালায় আবর্জনা কিংবা পলিথিন ও প্লাস্টিক সামগ্রি না ফেলা।’

চট্টগ্রামে চাক্তাই খাল খনন আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক শিল্পী শাহরিয়র খালেদ চাকতাই খালের বেশিরভাগ অংশের তলদেশ পাকা করাকে এ খানের দূর্দশা ও চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতার অন্যতম কারন মনে করেন। ২০০৩-০৪ অর্থবছরে ৯ থেকে ১২ ফুট গভীরতা রেখে চাকতাই খালের বেশিরভাগ অংশের তলদেশ পাকা করা হয়। কয়েক বছর পর দেখা গেছে, পাহাড়ের বালু-মাটি ছাড়াও পলিথিন ও আবর্জনা জমে খাল আবার ভরাট হয়ে যায়। খালের গভীরতা কমে তিন থেকে চার ফুটে দাঁড়ায়। অথচ ১৫-২০ বছর আগেও এ খাল দিয়ে চলত পণ্যবাহী নৌকা। ছয় কিলোমিটার দীর্ঘ এ খালের সর্বনিম্ন ২০ ফুট থেকে সর্বোচ্চ ৭০ ফুট প্রশস্ততা রয়েছে। কোথাও কোথাও বেদখল হওয়ায় সব জায়গায় প্রশস্ততা একই রকম নেই। খালের বিভিন্ন স্থান দখল করে স্থাপনা গড়ে তোলা হয়েছে। এসব স্থাপনা উচ্ছেদ, খাল খনন বা পরিষ্কার করতে নানা সময় অর্থ খরচ করে যাচ্ছে চসিক যদিও এ ক্ষেত্রে সঠিক পরিকল্পনার যথেষ্ট অভাব রয়েছে। চট্টগ্রামের মুরাদপুর-জিইসি মোড়-বহদ্দারহাট-নাসিরাবাদ- চকবাজার নিম্নাঞ্চল নয় | বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা আছে বলেই পানি নিষ্কাশিত হতে পারেনা তাই জলাবদ্ধতা । এর আশু সমাধান দরকার ।

শহরের চলা ফেরার সময় প্রায়সই দেখা যাচ্ছে আমরা বিভিন্ন পানীয় বোতল, খাবারের প্যাকেট, পলিথিন ইত্যাদি যত্রতত্র ফেলে ড্রেনগুলো আবর্জনা দ্বারা পরিপূর্ণ করে রাখছি। এর ফলে বৃষ্টির পানি আটকে থাকে। ময়লা-আবর্জনাই জলাবদ্ধতা সৃষ্টির অন্যতম একটি কারণ। আমরা কথায় কথায় পৃথিবীর উন্নত শহরগুলোর কথা বলে বেড়াই এবং বলি- সেসব শহরে কোনো জলাবদ্ধতা নেই। আমাদের জানা দরকার, সেসব শহরের দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষ এবং মানুষজন যথেষ্ট সচেতন। সেসব শহরের দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষ যথা সময়ে সঠিক সিদান্ত নেয় এবং তা যথাযথ ভাবে বাস্তবায়ন করে।

নগরীর দায়িত্বে থাকা সংস্থাগুলো যে যার মতো করে কাজ করে যাচ্ছে। একটির সাথে অন্যটির কোন সমন্বয় নেই। এর খেসারত দিচ্ছেন নগরবাসীকে। সঠিক সমাধান ও কাজে সমন্বয় এর জন্য স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়কে তদারকির দায়িত্ব নিতে হবে। প্রকল্পগুলোর ত্রুটি ও অসম্পূর্ণতা চিহ্নিত করে তা দ্রুত সময়ের মধ্যে সমাধান করতে হবে।

সরকার হাজার চেষ্টা করেও জলাবদ্ধতা সমস্যা সমাধান করতে পারবে না, যদি নগর কর্তৃপক্ষ তাদের করনীয় সমূহ সঠিক ভাবে পালন না করে, জলাবদ্ধতা সংক্রান্ত প্রকল্পের কাজ যথাযথ ভাবে সঠিক পদ্ধতিতে করা না হয় ও সাধারণ নাগরিকরা নদী খাল নালা রক্ষায় উদাসিন হয়ে যত্রতত্র পলিথিন, প্লাস্টিক ময়লা ফেলে, তাদের সচেতনা খুবই জরুরী।

লেখক: সাংবাদিক, পরিবেশ উন্নয়ন কর্মী। [দৈনিক পূর্ব দেশে ৮/৮/২০২৩ প্রকাশিত]