জলাবদ্ধতা দূর করতে ‘গার্বেজ বায়িং মডেল

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্রবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ অহিদুল আলম বলেন, ‘আমরা শিল্প বিপ্লবের কথা বলছি, স্মার্ট সিটির কথা বলছি। কিন্তু যে শহরে ময়লার স্তুপ থাকে, যে শহরে ড্রেনেজ সিস্টেম ভালো না সেই শহর স্মার্ট সিটি নয়। আমাদের সঠিক পথে যেতে হলে পৃথিবীর উন্নত দেশের মতো সেন্ট্রাল ওয়েস্ট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট তৈরি করতে হবে। শহরের সব বর্জ্য সেই প্ল্যান্টে যাবে। সেখান থেকে রিপ্রোডাক্ট ও বাইপ্রোডাক্ট বের হবে। সেগুলো বিক্রির পাশাপাশি পুনরায় ব্যবহার করা যাবে।’

চট্টগ্রাম নগরীর অন্যতম প্রধান সমস্যা জলাবদ্ধতা তৈরি হয় বর্জ্য অব্যবস্থাপনায়। দিনের পর দিন নালা, নর্দমা, খালে প্লাস্টিক ও পলিথিন জাতীয় বর্জ্য জলবদ্ধতার এই সমস্যা বাড়িয়ে তুলছে।

তবে সংকট সমাধানে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্রবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ অহিদুল আলম একটি উপায় বের করেছেন।

এসব বর্জ্য কেনা-বেচার মাধ্যমে নিরসন হতে পারে জলাবদ্ধতা। একটি নির্দিষ্ট শ্রেণির মানুষের আয়ের পথ সৃষ্টির মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচনেও ভূমিকা রাখতে পারে এ প্রক্রিয়া।

এ ধরনের আইডিয়া নিয়ে একটি মডেল তৈরি করে মোহাম্মদ অহিদুল আলম তার নাম দিয়েছেন ‘গার্বেজ বায়িং মডেল’। মুজিব আইডিয়া কন্টেস্ট-২০২১ এর প্রথম ১০০ কন্টেস্টের মধ্যেও স্থান পেয়েছে এ মডেল।

অহিদুল আলম বলেন, ‘উন্নত দেশগুলো খুব সুন্দরভাবে তাদের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা করে। আমি কয়েকটি দেশে এমন দেখেছি। সেখানে শহরগুলোতে সেন্ট্রাল ওয়েস্ট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট আছে। সেখনে তারা গার্বেজ বায়িং মডেলের মতো বিভিন্ন মডেল অনুসরণ করে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা করে। ফলে সে দেশেগুলোতে আমাদের দেশের মতো জলাবদ্ধতা নেই।’

গার্বেজ বায়িং মডেল কী?

গার্বেজ বায়িং মডেল হচ্ছে বর্জ্য কেনাবেচার একটি প্রক্রিয়া। পৃথিবীর উন্নত অনেক দেশেই এই ধরনের মডেল ব্যবহার করা হয়। গার্বেজ বলতে এখানে বোঝানো হচ্ছে প্লাস্টিক ও পলিথিন জাতীয় আবর্জনাকে যেগুলো পরিবেশ দূষণের পাশাপাশি জলাবদ্ধতা তৈরি করে।

এই মডেলের আওতায় একটি সেন্ট্রাল ওয়েস্ট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট তৈরি করতে হবে। দরিদ্র শ্রেণির মানুষ এখানে যুক্ত হতে পারবে। তারা বাসা-বাড়িসহ বিভিন্ন জায়গা থেকে এই বর্জ্যগুলো সংগ্রহ করবে এবং সিটি করপোরেশন (স্থানীয় সরকার) নগদ টাকায় সেগুলো কিনে নেবে।

সিটি করপোরেশন যখন সেন্ট্রাল ওয়েস্ট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট তৈরি করবে সব জায়গা থেকে বর্জ্য এখানে এসে জমা হবে এবং এখান থেকে ‘থ্রি আর’ অর্থ্যাৎ রিডিউস, রিইউজ ও রিসাইকেল স্ট্যাটেজি প্রয়োগ করে নতুন প্রোডাক্ট তৈরি করা যাবে।

জলাবদ্ধতা নিরসন ও দারিদ্র বিমোচন কীভাবে?

অহিদুল আলম বলেন, ‘আমরা দেখতে পাই সামান্য বৃষ্টি হলেও আমাদের নগরে জলাবদ্ধতা তৈরি হয়। এর কারণ আবর্জনায় নালা নর্দমাগুলো ভরাট হয়ে আছে। এ মডেল অনুসরণ করে নগরীর দরিদ্র লোকরা এখানে সম্পৃক্ত হতে পারে।

‘আমরা আমাদের এই বর্জ্যগুলো জমা করে রাখব এবং সপ্তাহে একদিন আমাদের বাসার সামনে রাখব। দরিদ্র লোকজন এই বর্জ্যগুলো সংগ্রহ করে নিয়ে সেগুলো সিটি করপোরেশন কাছে বিক্রি করবে। সিটি করপোরেশন জলাবদ্ধতা নিরসনে একটা বড় অঙ্কের বাজেট পায়। তারা চাইলে এখানে সেই ইনভেস্টটা করতে পারে।’

তিনি বলেন, ‘সিটি করপোরেশনের সীমিত সংখ্যক পরিচ্ছন্নতা কর্মী দিয়ে এই কাজ সম্ভব না। সাধারণ মানুষকে এখানে সম্পৃক্ত করতে হবে। এই সাধারণ মানুষ কারা? আমরা দেখি একটা শ্রেণির মানুষ রাস্তা-ঘাটে শুধু ভিক্ষাবৃত্তি করে। কেউবা আবার নিম্ন আয়ের কাজ করে।

‘এখন কেউ যদি এই গার্বেজগুলো সংগ্রহ করে কেজিপ্রতি ২০-৩০ টাকা বিক্রি করতে পারে এবং তাকে যদি সেই টাকা নগদ দিয়ে দেয়া হয় তাহলে সে একটা ভালো উপার্জন করতে পারবে এবং উৎসাহিত হবে। এ ক্ষেত্রে সে শহর পরিষ্কারেরও কাজ করলো, একই সঙ্গে দারিদ্র্য বিমোচনও হলো।’

অহিদুল বলেন, ‘এভাবে বর্জ্য কেনাবেচা করলে কেউ আর যত্রতত্র বর্জ্য ফেলবে না বরং সচেতন হয়ে সেগুলো জমিয়ে রাখবে। ফলে একটা সময়ে আমাদের অভ্যাসগত পরিবর্তনও চলে আসবে।

‘বাইরের দেশে আমরা এমনটাই দেখি। ভালো উপার্জনের সুযোগ পেলে মানুষজন নালা-নর্দমা-খাল থেকে প্লাস্টিকও বর্জ্য সংগ্রহ করবে। ফলে জলাবদ্ধতাও দূর হবে।’

সিটি করপোরেশন বর্জ্যগুলো কী করবে?

অহিদুল আলম বলেন, ‘আমরা শিল্প বিপ্লবের কথা বলছি, স্মার্ট সিটির কথা বলছি। কিন্তু যে শহরে ময়লার স্তুপ থাকে, যে শহরে ড্রেনেজ সিস্টেম ভালো না সেই শহর স্মার্ট সিটি নয়। আমাদের সঠিক পথে যেতে হলে পৃথিবীর উন্নত দেশের মতো সেন্ট্রাল ওয়েস্ট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট তৈরি করতে হবে। শহরের সব বর্জ্য সেই প্ল্যান্টে যাবে। সেখান থেকে রিপ্রোডাক্ট ও বাইপ্রোডাক্ট বের হবে। সেগুলো বিক্রির পাশাপাশি পুনরায় ব্যবহার করা যাবে।’

তিনি বলেন, ‘শহর পরিষ্কার থাকলে, ড্রেনেজগুলো পরিষ্কার থাকলে শহরে আর কোনো জলাবদ্ধতা থাকবে না। আমি সরকারকে এই বর্জ্যগুলোকে কিনতে বলছি, কারণ যখন কোনো মানুষ অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবে তখন এই কাজে মানুষ আগ্রহ পাবে।’

বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ প্রয়োজন

ড. অহিদুল আলম বলেন, এই প্রকল্প বাস্তবায়ন বিশেষজ্ঞদেরও এখানে সম্পৃক্ত করতে হবে। তারা যাচাই-বাছাই করে জানাবে কোথায় প্ল্যান্ট নির্মাণকরা যাবে, খরচের পরিমাণ কেমন হতে পারে।

তিনি বলেন, ‘আমরা চসিক মেয়রের সঙ্গে কথা বলেছি। তিনি ইতিবাচক সাড়া দিয়েছেন। আমাদের বলেছেন, একটি প্রেজেন্টেশন তৈরি করে উপস্থাপন করতে। আমরা শিগগিরই মেয়রের কাছে আমাদের এই প্রস্তাবনা প্রেজেন্টেশন আকারে উপস্থাপন করব। শুধু চট্টগ্রাম নগরে নয়, এটি সারাদেশ বাস্তবায়ন করা যাবে বলে আমি মনে করি।’

নূর নওশাদের প্রতিবেদনটি newsbangla24 থেকে নেয়া