ন্যূনতম কর অযৌক্তিক, নৈতিকও নয়

আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের আর্থিক কাঠামোকে ‘অলীক’ বলে আখ্যায়িত করে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) বলেছে, এই বাজেট উচ্চাকাক্সক্ষী, যা বাস্তবায়নযোগ্য নয়। সংস্থাটি মনে করে, বাজেটের আয় ও ব্যয় কাঠামো নির্ধারণের ক্ষেত্রে চলতি অর্থবছরের বাস্তবায়ন অভিজ্ঞতাকে বিবেচনায় নেয়া হয়নি। কাঠামোগত এ দুর্বলতার কারণে বাজেটের বাস্তবায়ন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। সিপিডি বলছে, দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা ক্রমান্বয়ে দুর্বল হয়ে পড়ছে। সামনে রয়েছে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের চ্যালেঞ্জ, আইএমএফ-এর ঋণ, মূল্যস্ফীতিসহ বেশকিছু চ্যালেঞ্জ। প্রস্তাবিত বাজেটে এসব চ্যালেঞ্জ বিবেচনায় নিয়ে যে ধরনের পদক্ষেপ নেয়ার প্রয়োজন ছিল সেগুলো নেয়া হয়নি। বাজেটে অর্থনৈতিক সংস্কারের কোনো প্রতিফলন নেই। বিভিন্ন চলক উচ্চাকাক্সক্ষী। নেই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে জন আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন। এ ছাড়া ধনীদের সারচার্জ (সম্পদ কর) দেয়ার ব্যবস্থা, আবার কর দেয়ার অযোগ্য মানুষের কাছ থেকে ২ হাজার টাকা নেয়া গরিব শোষণ ও ধনী তোষণ নীতির বহিঃপ্রকাশ বলেও মনে করে সংস্থাটি।

গতকাল রাজধানীর লেকশোর হোটেলে আয়োজিত ‘জাতীয় বাজেট ২০২৩-২৪, সিপিডি’র পর্যালোচনা’ শীর্ষক মিডিয়া ব্রিফিংয়ে সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন প্রস্তাবিত বাজেট বিশ্লেষণে এসব তথ্য উপস্থাপন করেন।

এ সময় উপস্থিত ছিলেন, সংস্থার সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান, গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম, সিনিয়র গবেষণা পরিচালক তৌফিকুল ইসলাম খানসহ সিপিডি’র গবেষকরা।
ফাহমিদা খাতুন বাজেট বিশ্লেষণে বলেন, ২০২৩-২৪ অর্থবছর একটি চ্যালেঞ্জিং অর্থবছর। এই চ্যালেঞ্জের সময়ে বর্তমান সরকারের মেয়াদে শেষ বাজেটটি উপস্থাপন করা হয়েছে। ২০২২-২৩ অর্থবছর থেকেই আমরা দেখছি যে বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা ক্রমান্বয়ে এবং ব্যাপকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ছে। এই দুর্বলতার কারণ- একদিকে যেমন বৈশি^ক অন্যদিকে অভ্যন্তরীণ কারণ রয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনীতি এমন একটি সময়ের মধ্যদিয়ে অতিবাহিত হচ্ছে যে, ২০২৬ সালে আমরা স্বল্পোন্নত দেশ থেকে একটি উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হবো। একই সঙ্গে আমাদের সামনে রয়েছে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের মাইলস্টোন। যখন আমরা আইএমএফ-এর কাছ থেকে ঋণ নিয়েছি ৪.৭ মিলিয়ন ডলার। এসব কিছু বিবেচনায় এবারের বাজেটটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সেই হিসাবে বাজেটে আমাদের অনেক প্রত্যাশা ছিল।

এই কঠিন সময়ে কঠিন কিছু ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ ছিল, সেটি নেয়া হয়নি। সামষ্টিক অর্থনীতির বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের কথা উল্লেখ করে ফাহমিদা খাতুন বলেন, সামষ্টিক অর্থনীতিতে প্রায় ১৫টি চাপ রয়েছে। এরমধ্যে একটি হলো- রাজস্ব আহরণ কমে যাচ্ছে এবং এই বছরে ঘাটতি হয়েছে। এ ছাড়া সরকারি ব্যয় সেটাও এক জায়গায় স্থবির হয়ে আছে। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন কম হয়েছে। পাশাপাশি ব্যাংক খাত থেকেও ঋণ নেয়া হয়েছে। বিশেষ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়া হয়েছে। আর মানুষের জীবনে যেটা সবচেয়ে বেশি আঘাত করেছে সেটি হচ্ছে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য আকাশচুম্বি হয়ে আছে। পাশাপাশি ব্যাংকিং খাতে ঋণ খেলাপির পরিমাণ ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। এ ছাড়া ব্যাংকিং খাতে এক ধরনের তারল্যের উপর চাপ পড়েছে। যদি বহিঃখাতের দিকে তাকাই, রপ্তানি প্রবৃদ্ধির হার নিম্নমুখী। রেমিট্যান্স প্রবাহের প্রবৃদ্ধি নিম্নে। এ ছাড়া বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ক্রমান্বয়ে নিম্নমুখী হচ্ছে। এটার ক্ষেত্রে আমরা দেখছি যে আমদানি যতটুকু করার কথা ততটুকু করা যাচ্ছে না। একই সঙ্গে বিদ্যুৎ এবং জ্বালানি খাতে ব্যাপক ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। যার ফলে অভ্যন্তরীণ উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। পাশাপাশি আমরা দেখছি যে টাকা ও ডলারের বিনিময় হার অবনমন হচ্ছে। এই সমস্ত চাপেই কিন্তু সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা ভঙ্গুর হয়ে গিয়েছে।

তিনি বলেন, প্রস্তাবিত বাজেটে আমরা যদি দেখি জিডিপি এবং বিনিয়োগের ক্ষেত্রে যেই ধরনের প্রক্ষেপণ করা হয়েছে সেখানে আমরা গত অর্থবছরে এবং তার আগের অর্থবছরের সঙ্গে এই অর্থবছরের তুলনা করেছি। সেখানে অনেকগুলো সূচকের প্রবৃদ্ধি এবং প্রক্ষেপণ করা হয়েছে, সেগুলোর অনুমিতিগুলো বাস্তবতার সঙ্গে তেমন মিল নেই। নতুন অর্থবছর ২০২৩-২৪ এ জিডিপি’র প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ৭.৫ শতাংশ। গত অর্থবছরেও ৭.৫ শতাংশ ধরা হয়েছিল। পরে এটাকে নামিয়ে ৬ শতাংশ করা হয়েছে। মনে করা হচ্ছে যে আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ঘুরে দাঁড়িয়ে আমাদের জিডিপি’র প্রবৃদ্ধি সাড়ে ৭ শতাংশ হবে।

আমরা যদি সরকারি বিনিয়োগের হার দেখি সেটা ৬.২ শতাংশ ধরা হয়েছে। ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ জিডিপি’র অংশ হিসেবে ২৭.৪ শতাংশ ২০২৪ সালের জন্য ধরা হয়েছে। কিন্তু আসলে ২০২৩ সালে আমরা দেখেছি যেটা ধরা হয়েছিল, সেটা কম হয়েছে এখন পর্যন্ত, এবং সেটা ২১.৮ শতাংশ। এখান থেকে কীভাবে লাফ দিয়ে ২৭ শতাংশ হবে? সেটা আমাদের কাছে মনে হচ্ছে উচ্চাকাঙ্ক্ষা। ফাহমিদা খাতুন বলেন, ব্যক্তি খাতে ঋণ প্রবাহ ১৫ শতাংশ ধরা হয়েছে। এই বছরের ঋণ প্রবাহ যেটা ধরা হয়েছে সেটা গত বছরের ধরা ঋণ প্রবাহের সঙ্গে মিলছে না। এ ছাড়া ব্যক্তি খাতের যে বিনিয়োগের হার ধরা হয়েছে সেটা এমন ঋণ প্রবাহ দিয়ে কীভাবে বাস্তবায়ন হবে সেটা বোধগম্য নয়।
নতুন অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট বলা হয়েছে ব্যাপকভাবে মূল্যস্ফীতি কমে গিয়ে সেটা ৬ শতাংশ হবে। এই মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন আমাদের কাছে উচ্চাকাঙ্ক্ষা মনে হয়েছে। পরিসংখ্যানে দেখা যায় আমদানি প্রবৃদ্ধি, রেমিট্যান্স প্রবৃদ্ধি ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের যে পারফরম্যান্স ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেখা গেছে তার থেকে আরও বেশি হবে বলে নতুন অর্থবছরের বাজেটে বলা হয়েছে।
ফাহমিদা খাতুন বলেন, ট্যাক্স রিটার্নের নামে ন্যূনতম কর ২ হাজার টাকা নির্ধারণ করা বৈষম্যমূলক। নৈতিকভাবে এটা ঠিক হয়নি। এটি তুলে দেয়া উচিত। তবে করের সীমারেখা ৩ লাখ থেকে সাড়ে ৩ লাখ করাকে ভালো দিক বলে মনে করেন তিনি। তিনি উল্লেখ করেন, একটা গুরুত্বপূর্ণ খাত সামাজিক নিরাপত্তা। এখানে বর্তমান অর্থবছরের তুলনায় আগামী অর্থবছরে বরাদ্দের পরিমাণ বাড়ানো হয়েছে। বাড়ানোর পরিমাণটা ৭.৩৪ শতাংশ। কিন্তু এটা আরও বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তা অনেক বেশি। সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারীদের পেনশনের টাকাটা এখানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। যেটা সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর মধ্যে থাকার কথা না। এটা থাকার ফলে কিন্তু সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দের পরিমাণটা অনেক বেশি দেখা যায়।
তিনি বলেন, জ্বালানি তেল থেকে শুরু করে আমরা অনেক পণ্য বিদেশ থেকে আমদানি করি। কিন্তু বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারে সব পণ্যের দাম নিম্নমুখী। সুতরাং সম্পুর্ণভাবে বৈদেশিক উৎসের উপরে মূল্যস্ফীতির চাপটা সরিয়ে দেয়ার যুক্তিযুক্ত না।
সিপিডি’র গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ঘোষিত প্রস্তাবিত বাজেটের সবচেয়ে দুর্বল জায়গা হলো মূল্যস্ফীতির ক্ষেত্রে কার্যকর কোনো উদ্যোগ ঘোষণা না করা। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকারের কাছে সাধারণ জনগণের যে প্রত্যাশা রয়েছে, যে আকাঙ্ক্ষা ছিল সেই আকাঙ্ক্ষা মেটাতে এই বাজেটটি ব্যর্থ হয়েছে।
গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, সংস্কার সম্পৃক্ত বিভিন্ন সূচকে আমরা আইএমএফ-এর বিভিন্ন শর্তের প্রতিফলন কমবেশি দেখতে পাই, যদিও এটি পর্যাপ্ত নয়। সরকার ধীরে ধীরে সে পথে হাঁটছে। নির্বাচনকে সামনে রেখে সব সংস্কারে হাত দেয়া হয়নি। সম্ভবত নির্বাচনের পরে কৃষি ও জ্বালানি খাতে মূল্য সমন্বয় করবে। তিনি বলেন, সংস্কার সম্পৃক্ত বিভিন্ন সূচকে আমরা আইএমএফ-এর বিভিন্ন শর্তের প্রতিফলন কম বেশি দেখতে পাই, যদিও এটি পর্যাপ্ত না।

সিপিডি’র বিশেষ ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, আগেও আমরা দেখেছি সংকটের মূল কারণগুলো অনুধাবন না করে বাজেটে লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়। এ জন্য শেষ পর্যন্ত অনুমিতিগুলো সত্য হয় না। বাস্তবতাকে বিবেচনায় না নিয়ে আকাঙ্ক্ষার পরিপ্রেক্ষিতে বাজেট করলে এমন অবস্থা হয়। মোস্তাফিজুর রহমান জানান, দেশের অর্থনীতি ভালোই চলছিল। কিন্তু হঠাৎ বৈশ্বিক সংকট তৈরি হওয়ার পরে সেটাকে বিবেচনায় না নিয়ে গত বছর বাজেট করা হয়েছে। ফলে বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থা তৈরি হয়েছে। প্রস্তাবিত বাজেটেও বর্তমান বাস্তবতাকে বিবেচনায় নেয়া হয়নি। এই উচ্চ আকাঙ্ক্ষার বাজেট বাস্তবায়ন করতে হলে রাজস্ব আয় চলতি বছরের তুলনায় প্রায় ৪০ শতাংশ বাড়াতে হবে। আর লক্ষ্য অনুযায়ী রাজস্ব আদায় না হলে তখন ঘাটতি মেটাতে হয় ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে হবে বা এডিপি কাটছাঁট করতে হবে। তা না হলে বৈদেশিক ঋণ নিতে হবে। ফলে অনুমিতির দুর্বলতার কারণে পরে অর্থনীতি প্রতিটি জায়গায় হোঁচট খাবে।