নির্বাচনী বাজেটে বাড়বে ব্যয়, ভারী হচ্ছে করের বোঝা

আসছে জাতীয় নির্বাচন। নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় বাজেট ঘোষণা করতে যাচ্ছে সরকার। তবে নির্বাচনকে মাথায় রেখে জনতুষ্টির বাজেট করতে পারছে না সরকার। রেকর্ড মূল্যস্ফীতির চাপ, রাজস্ব আদায়ে অদক্ষতা, রিজার্ভ ও ডলার সংকটের মতো বিষয়গুলোর কারণে বাজেটের অর্থ সংস্থানকে কঠিন করে তুলেছে। ফলে উচ্চাভিলাষী লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে আগামী বাজেটে করহার ব্যাপকভাবে বাড়ানো হচ্ছে। ভ্যাটের হার এবং আওতাও বাড়ানো হবে। এতে মূল্যস্ফীতির চাপে থাকা মানুষের একটি বড় অংশ নতুন করে আরও চাপে পড়তে পারে।

আগামী বাজেটে রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৪ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা, যা চলতি অর্থবছরের মূল লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ১৬ শতাংশ বেশি। গত ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) রাজস্ব আয়ে রেকর্ড পরিমাণ ঘাটতি হয়েছে, প্রায় ৩৪ হাজার ৬৩১ কোটি টাকা। অর্থবছর শেষে ঘাটতির পরিমাণ ৩০ হাজার কোটি টাকা হলে আগামী অর্থবছরের রাজস্ব লক্ষ্য অর্জনে ২৬ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হবে। এই বিশাল পরিমাণ প্রবৃদ্ধি অর্জনে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) করজাল বাড়ানোর পাশাপাশি করহার বাড়ানোর দিকে জোর দিবে।

সূত্রে জানা গেছে, আগামী বাজেটে করহার ব্যাপকভাবে বাড়ানো হচ্ছে।

গৃহস্থালি সামগ্রীর ক্ষেত্রে বাসাবাড়িতে ব্যবহৃত প্লাস্টিকের তৈরি সব ধরনের টেবিলওয়্যার, কিচেনওয়্যার, গৃহস্থালি সামগ্রী উৎপাদনে ৫ শতাংশ ভ্যাট আছে, যা বাড়িয়ে ৭ দশমিক ৫০ শতাংশ করা হচ্ছে। একই হারে অ্যালুমিনিয়ামের তৈরি গৃহস্থালি সামগ্রী ও তৈজসপত্রের (হাঁড়িপাতিল, থালাবাসন) ভ্যাট বাড়ানো হচ্ছে। কিচেন টাওয়াল, টয়লেট টিস্যু, ন্যাপকিন টিস্যু, ফেসিয়াল টিস্যু/পকেট টিস্যু ও পেপার টাওয়াল উৎপাদনে ৫ শতাংশ ভ্যাট আছে, এটি বাড়িয়ে ৭ দশমিক ৫০ শতাংশ করা হচ্ছে। এতে বাড়তে পারে টিস্যু পেপারের দাম। শুল্ক ফাঁকি রোধে বাজেটে সব ধরনের ওভেন আমদানির শুল্ক ৩০ শতাংশ বাড়াচ্ছে, মোট করভার ৮৯ দশমিক ৩২ শতাংশ করা হচ্ছে। এতে বিদেশি ওভেনের দাম বাড়তে পারে। এ ছাড়া সারা দেশে রান্নার কাজে এলপি গ্যাস সিলিন্ডার ব্যাপক হারে ব্যবহৃত হয়। বাজেটে সিলিন্ডার উৎপাদনে ব্যবহৃত স্টিল ও ওয়েল্ডিং ওয়্যার আমদানিতে শুল্ক আরোপ এবং উৎপাদন পর্যায়ে ভ্যাট বাড়ানো হচ্ছে।
বিরিয়ানি-তেহারির প্রধান উপকরণ বাসমতি চাল আমদানিতে ভ্যাট বসানো হচ্ছে। এতে চালের দাম বাড়তে পারে। বাজেটে তাজা ও শুকনা খেজুর আমদানিতে ২৫ শতাংশ শুল্কের পাশাপাশি ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করা হচ্ছে। দেশে বাদাম চাষকে উৎসাহিত করতে কাজুবাদাম আমদানিতে শুল্ক ১৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৪৩ শতাংশ করা হচ্ছে। তাই আমদানি করা কাজুবাদামের দাম বাড়তে পারে। এ ছাড়া বিভিন্ন ধরনের ফল ও বাদামের আমদানি শুল্ক বাড়ানো হচ্ছে। বাড়ানো হচ্ছে সব ধরনের সিগারেটের দামও। নিম্নস্তরের এক প্যাকেট (২০ শলাকার) সিগারেটের দাম ৯০ টাকা, মধ্যমস্তরের ১৩৪, উচ্চস্তরের ২২৬ এবং অতি উচ্চস্তরের সিগারেটের দাম ৩০০ টাকা করা হচ্ছে। রাজস্ব আয় বাড়াতে আইএমএফ এর পরামর্শে মোবাইল ফোনকে বিলাসী পণ্য বিবেচনায় নিয়ে বাজেটে ভ্যাট আরোপ করা হচ্ছে। বর্তমানে মোবাইল ফোন উৎপাদনে ভ্যাট অব্যাহতি আছে, সেখানে ২ শতাংশ ভ্যাট বসানো হচ্ছে।

আর সংযোজন পর্যায়ে ৩ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৫ শতাংশ এবং ৫ শতাংশ থেকে ৭ দশমিক ৫০ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করা হচ্ছে। এ কারণে খুচরা পর্যায়ে মোবাইল ফোনের দাম বাড়তে পারে। এ ছাড়া কলম উৎপাদনে বর্তমানে ভ্যাট অব্যাহতি রয়েছে, সেখানে ১৫ শতাংশ ভ্যাট বসানো হচ্ছে। ফলে কলমের দাম বাড়বে। চশমার ফ্রেম ও সানগ্লাস আমদানিতে শুল্ক ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২৫ শতাংশ করা হচ্ছে। সাইকেলের যন্ত্রাংশ আমদানিতে শুল্ক বাড়ানো হচ্ছে। বাড়ি নির্মাণের প্রধান উপকরণ সিমেন্টের কাঁচামাল ক্লিংকার আমদানিতে বর্তমানে টনপ্রতি ৫০০ টাকা শুল্ক আছে, এটি বাড়িয়ে ৭০০ টাকা করা হচ্ছে। বাসাবাড়িতে ব্যবহৃত বিদেশি টাইলস আমদানিতে রেয়াতি সুবিধা প্রত্যাহার করা হচ্ছে। ফলে আসন্ন বাজেটে বাড়ি নির্মাণের খরচ বাড়াবে। দেশের অভ্যন্তরে উড়োজাহাজে ভ্রমণকারীদের প্রথমবারের মতো করের আওতায় আনার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। একই সঙ্গে বিদেশগামী উড়োজাহাজ যাত্রীদের ৬৭ শতাংশ পর্যন্ত বেশি কর দিতে হতে পারে।

অন্যদিকে কম আয়ের মানুষকে করজালের মধ্যে আনার ছক থাকছে বাজেটে। কারণ শূণ্য আয় দেখিয়ে আগে রিটার্ন জমা দেয়া গেলেও আগামী দিনে সিøপ পেতে ন্যূনতম দুই হাজার টাকা কর দিতে হবে। আর রিটার্ন জমার সিøপ না নিলে সঞ্চয়পত্র কেনা এবং ব্যাংক ঋণ নেয়া যাবে না। ব্যবসার ট্রেড লাইসেন্স, গাড়ির ফিটনেস নবায়ন, গ্যাস-বিদ্যুৎ সংযোগ, বাড়ির নকশা অনুমোদনসহ সবমিলিয়ে সরকারি-বেসরকারি ৪৪ ধরনের সেবা পাওয়া যাবে না।

এদিকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে ৪৭০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ নেয়ার শর্ত পূরণের প্রতিফলন থাকছে আসছে অর্থবছরের বাজেটে। ঋণের শর্ত হিসেবে আইএমএফ যা যা করতে বলেছে, অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের বাজেট বক্তব্যে সেগুলোর প্রতিফলন থাকবে। গত ৩০শে জানুয়ারি ঋণ অনুমোদনের পর নতুন বাজেটে এখন বাধ্য হয়েই আইএমএফের চাওয়া অনুযায়ী কিছু পদক্ষেপ রাখা হচ্ছে। থাকছে কিছু সংস্কারের ঘোষণাও। আইএমএফের ঋণের একটা অংশ আসছে লেনদেনের ভারসাম্য বজায়ের সহায়তা হিসেবে। আইএমএফ বলেছে, স্বাভাবিক বৃদ্ধির চেয়ে আগামী অর্থবছরে যাতে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) তুলনায় দশমিক ৫ শতাংশ হারে রাজস্ব আয় বাড়ে, সেই কৌশল প্রণয়ন করতে হবে আগামী মাস জুনের মধ্যে। আর এনবিআরকে শুল্ক ও ভ্যাট বিভাগে ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা ইউনিট করতে হবে আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে। অর্থ বিভাগকে বলা হয়েছে, মোট অভ্যন্তরীণ ঋণের এক-চতুর্থাংশের বেশি যাতে না হয় সঞ্চয়পত্র থেকে নেয়া ঋণ।

আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে এ ব্যাপারে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। একই সময়ের মধ্যে প্রণয়ন করতে হবে জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয়ের সময়ভিত্তিক সূত্র। আইএমএফ বলেছে, আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোকে (বিবিএস) ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে জিডিপি’র তথ্য প্রকাশের ব্যবস্থা তৈরি করতে হবে। আর ব্যাংক কোম্পানি আইন সংসদে উপস্থাপন করতে হবে আগামী সেপ্টেম্বরের মধ্যে। এ ছাড়া সেপ্টেম্বরের মধ্যে একটি টেকসই গণ খাতে ক্রয় নীতিমালা প্রণয়ন করতে বলেছে আইএমএফ। এ ছাড়া সংস্থাটি রাষ্ট্র মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের হার ১০ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনা, বার্ষিক আর্থিক স্থিতিশীলতা প্রতিবেদনে পুনঃতফসিল করা ঋণ ও খেলাপি ঋণের তথ্য অন্তর্ভুক্ত করা এবং ভর্তুকি কমিয়ে আনার কৌশল তৈরির শর্ত দিয়েছে।
আসছে বাজেট নিয়ে সিপিডি’র ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেছেন, ঘাটতি বাজেটের অর্থায়ন কীভাবে হবে এটা অবশ্যই একটা বড় চ্যালেঞ্জ। এই অর্থ কোথা থেকে সরকার জোগাড় করবে, এটা কি ব্যাংকিং সেক্টর থেকে ঋণ নেবে, না কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নেবে, না বৈদেশিক ঋণ নেবে সেটা সরকারকে নির্ধারণ করতে হবে। চলতি (২০২২-২৩) অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি প্রায় ২৮ হাজার কোটি টাকা।

আর ১২ মাসে এই ঘাটতি হতে পারে ৪০ হাজার কোটি টাকা। এর বাইরে আরও যে বড় চ্যালেঞ্জ আছে তা হলো উচ্চ মূল্যস্ফীতি। এখন মূল্যস্ফীতির সাধারণ হার ৯ দশমকি ৩৩। খাদ্যপণ্যে এটা আরও বেশি। এই মূল্যস্ফীতির কারণে অনেকের আয় কমেছে, ক্রয়ক্ষমতা কমেছে। আর সেজন্য সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির বিস্তৃতি ঘটাতে হবে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সক্ষমতা যদি না বাড়ানো যায়, তাহলে রাজস্ব আদায়ের টার্গেট পূরণ হবে না। উন্নয়ন কর্মসূচির বাস্তবায়ন এই অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে মাত্র ৫০ ভাগ হয়েছে। বিদেশি ঋণের যেসব প্রকল্প পাইপ লাইনে আছে সেগুলো দ্রুত বাস্তবায়ন করা হলে তার একটা প্রভাব রিজার্ভে পড়বে। অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, নির্বাচনের আগে বাজেট হলেও তথাকথিত জনতুষ্টির বাজেট করার সুযোগ নাই।