ত্বকের দাগ: কেন এবং কীভাবে সারাবেন

মুখের কালো দাগ একটু হলেও মনে দাগ ফেলে না, এমন মানুষ কমই আছেন। মহিলারা তো বটেই পুরুষরাও এ দাগ দূর করার জন্য বিস্তর অর্থকড়ি খরচ করে থাকেন।
তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই রোগীদের অভিযোগ, দীর্ঘ চিকিৎসার পরও কাক্সিক্ষত ফল লাভ হয় না। অবশ্য কিছু রোগী বলে থাকেন, সাময়িকভাবে সুফল পেলেও, পরবর্তীতে এ রোগ ফিরে আসে।
সাধারণভাবে আমরা মুখের দাগকে কালো বললেও প্রকৃতপক্ষে এ দাগ বাদামী বা কালচে বাদামী হয়ে থাকে। মানুষের ত্বক মূলত তিনটি স্তরে বিন্যস্ত। প্রতিটি স্তরেই বিভিন্ন ধরনের কোষ থাকে। মেলানোসাইট নামের একধরনের বিশেষ কোষ রয়েছে, যা মেলানিন নামে এক ধরনের রঞ্জক পদার্থ তৈরি করে থাকে। নানা কারণেই এ কোষ উদ্দীপিত হয় এবং ত্বককে মেলানিন এর মাধ্যমে কালচে করে তোলে। মেলানিনের পরিমাণ যদি ত্বকের উপরের স্তরে বিস্তৃত থাকে, তবে ত্বকের দাগ বেশ স্পষ্ট থাকে অর্থাৎ গাঢ় রঙের হয়ে থাকে। এ দাগগুলো চিকিৎসায় সহজেই সেরে যায়। কিন্তু মেলানিন যদি ত্বকের গভীর স্তরে বিস্তৃতি লাভ করে তবে ত্বকের দাগ খুব বেশি স্পষ্ট থাকে না এবং অনেকটা হালকা রঙের হয়ে থাকে।

এ দাগগুলো চিকিৎসায় সহজে ভালো হয়না।
দাগের কয়েকটি মূল কারণ এখানে আলোচনা করা হলো।
মহিলাদের ক্ষেত্রে অন্যতম কারণ হরমোনের ভারসাম্যহীনতা। বিশেষ করে গর্ভকালীন সময়ে হরমোনের বড় ধরনের পরিবর্তন লক্ষ করা যায় এবং গর্ভকালীন সময়ের শেষদিকে মুখে কালো ছোপ এর উপস্থিতি লক্ষণীয় হয়। এ দাগগুলোর বিশেষ একটি প্যাটার্ন বা ধরন রয়েছে। গাল, নাক, কপাল ও ক্ষেত্রবিশেষে ঠোঁটের উপরে দাগ পরিলক্ষিত হয়। এটাকে অনেক সময় প্রেগনেন্সি মাস্ক বলে অভিহিত করা হয়। মেডিকেল পরিভাষায় এটাকে মেলাজমা বলা হয়ে থাকে। পুরুষদের মুখেও মেলাসমা হয়ে থাকে। মোট মেলাসমা রোগীর ১০ শতাংশ পুরুষ।
রোদের আলো সবসময়ই মেলানোসাইটকে উদ্দীপিত করে এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এটা মানুষের ত্বকের গাঢ় রঙের জন্য দায়ী। যেসব দেশে রোদের আলো কম থাকে, সেসব দেশে স্বাভাবিক ভাবেই মানুষের ত্বক ফর্সা হয়ে থাকে। নতুন গবেষণায় দেখা গেছে, টিভি, মোবাইল বা কম্পিউটার থেকে নির্গত লেড লাইট ও ত্বকের দাগের জন্য সমানভাবে ক্ষতিকর।

ত্বকের রঙের ক্ষেত্রে বংশগত বা জেনেটিক প্রভাব অত্যন্ত বেশি। মা-বাবা যে রঙের থাকেন, সাধারণত বাচ্চারাও সেই রঙের অধিকারী হয়ে থাকে। আবার, কারো কারো ত্বকের বিশেষ কোনো অংশ জেনেটিকভাবেই আল্ট্রাভায়োলেট লাইট অথবা ইস্ট্রোজেন হরমোনের প্রতি বেশ সংবেদনশীল থাকে। এরা স্বাভাবিক রোদ বা স্বাভাবিক লেভেলের হরমোনেই মেলাসমার শিকার হয়ে যান। মেলাসমা রোগীদের প্রায় ৪০ শতাংশের পরিবারে এ ধরনের রোগের ইতিহাস থাকে। এ গ্রুপের রোগীরাই বেশির ভাগ ক্ষেত্রে চিকিৎসায় বারবার বিফল হন।

কিছু কিছু হরমোন যেমন থাইরয়েড হরমোনের ভারসাম্যহীনতা, কিছু ক্রনিক ডিজিজ যেমন ক্যান্সার, কিডনি ডিজিজ ইত্যাদির কারণে শরীরে মেলানোসাইট স্টিমুলেটিং হরমোনের আধিক্য ঘটে, যা প্রত্যক্ষ ভাবে শরীরের রঙ গাঢ় করে ফেলতে পারে।
কিছু কিছু ওষুধ যেমন মৃগী রোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত কিছু ওষুধ, হরমোনাল পিল, আলোক-সংবেদনশীল ওষুধ ইত্যাদি সেবনের কারণে ত্বকে কালো দাগ পড়তে পারে।
আবার অনেকের ত্বক প্রসাধনী ও সাবানের প্রতি সংবেদনশীল। এগুলোর ব্যবহারে মেলাজমা তীব্র অবস্থা ধারণ করে।

ত্বক ও মুখের দাগের চিকিৎসায় একক কোনো পদ্ধতি কার্যকরী নয়। রোগী ভেদে চিকিৎসাও ভিন্ন হয়ে থাকে। এ রোগটি সম্পূর্ণভাবে একটি ক্রনিক রোগ, এর অর্থ হচ্ছে এ রোগটি দীর্ঘকালীন। কেউ কেউ কয়েক বছর, কেউ কেউ আজীবন এ রোগে ভুগতে পারেন। অনেকে স্বল্প সময়ে ও সেরে যান। এ রোগ মোটেই ক্ষতিকর নয়। কোনো ধরনের ব্যথা বা চুলকানিও থাকে না। তবে ব্যক্তিত্ব ও শারীরিক সৌন্দর্যের বিচারে এ রোগ অনেকেরই মনোকষ্টের কারণ।

একজন উপযুক্ত ত্বকরোগ বিশেষজ্ঞ আপনার এ রোগের পরিপূর্ণ চিকিৎসা দিতে পারেন।
চিকিৎসার প্রথমেই প্রয়োজন ত্বকের দাগের জন্য ক্ষতিকর বিষয়গুলো পরিহার করা। সূর্যের আলো এবং লেডলাইট থেকে ত্বককে সুরক্ষিত রাখতে হবে। বাইরে বের হলে একটি ছাতা বা বড় একটি ছায়াটুপি মাথায় পরা উচিত। দিনের বেলা অবশ্যই ভালো মানের সানস্ক্রিন ব্যবহার করতে হবে। যেসব ওষুধ বা প্রসাধনী ক্ষতিকর সেগুলো বর্জন করতে হবে।
চিকিৎসক আপনার ত্বকের অবস্থা বুঝে কিছু মলম প্রেসক্রাইব করতে পারেন- যেমন হাইড্রোকুইনন, ট্রেটি-নয়ন, এজলেইক এসিড, এসকরবিক এসিড, আর বিউটিন, গ্লুটাথিওন ইত্যাদি। এ উপাদানগুলো এককভাবে অথবা মিশ্রিতভাবেও বিভিন্ন ফর্মুলায় পাওয়া যায়।
ক্ষেত্রবিশেষে, কেমিক্যাল পিলিং এর প্রয়োজন হয়। অধুনা কিছু কিছু ক্ষেত্রে লেজার থেরাপি ব্যবহৃত হচ্ছে। লক্ষ্য রাখতে হবে যে, মুখের দাগের বা মেলাসমার বিভিন্ন ধরন রয়েছে এবং ধরনভেদে চিকিৎসা ভিন্ন এবং চিকিৎসার ফলাফল ও ভিন্ন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসার প্রয়োজন হয়।

লেখক: (চর্ম, যৌন ও এলার্জি রোগ বিশেষজ্ঞ) জালালাবাদ রাগীব-রাবেয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। চেম্বার: ১২, স্টেডিয়াম মার্কেট, সিলেট। ফোন: ০১৭১২-২৯১৮৮৭