সিলেটে প্রতারকদের ফাঁদে পল্লী ডাক্তাররা সার্টিফিকেটও জাল

সকাল থেকে ক্ষোভ জানাচ্ছিলেন ট্রেনিং কোর্স সম্পন্ন করা সিলেটে পল্লী চিকিৎসকরা। একপর্যায়ে তারা কেন্দ্রের ইনচার্জ সোলেমানের উপর ক্ষেপে যান। আইন হাতে তুলে না নিয়ে তারা ফোন দেন ৯৯৯-এ। নগরীর সুবহানীঘাট থানা পুলিশের একটি টিম সেখানে আসে। কিন্তু পুলিশ যাওয়ার আগে পালিয়ে যায় সোলাইমান। বিকাল পর্যন্ত পুলিশের ডাকেও দেয়নি সাড়া। এমন ঘটনা ঘটেছে সিলেটের উপশহরের ডি ব্লকের বনরূপা বিল্ডিংয়ের তৃতীয় তলায়। ঢাকার প্রতিষ্ঠান হেলথ এডুকেশন এন্ড ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন। এটি মূলত পল্লী চিকিৎসক ট্রেনিং দিতে ডিএমএস ও এলএমএফ নামে দুটি কোর্সের ট্রেনিং সেন্টার। এই সেন্টারে গতকাল সকালে ট্রেনিং সম্পন্ন করা পল্লী চিকিৎসকদের অভিযোগের প্রেক্ষিতে তালা ঝুলিয়ে দিয়েছে পুলিশ।

ট্রেনিংপ্রাপ্ত পল্লী চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, হেলথ এডুকেশন এন্ড ডেভোলপমেন্ট ফাউন্ডেশন ঢাকার কাজী সাহাদাত হোসেন নামের এক ব্যক্তির পরিচালিত প্রতিষ্ঠান।

সিলেটের উপশহরে ২০১৮ সাল থেকে এই প্রতিষ্ঠানে সরকারের অনুমোদন সাপেক্ষে পল্লী চিকিৎসক ট্রেনিং দেয়া হচ্ছে। প্রতিষ্ঠানের সিলেট অফিসের ইনচার্জ হচ্ছেন কানাইঘাটের গাছবাড়ি এলাকার বাসিন্দা মো. সোলায়মান। বিগত ৪ বছর ধরে এই প্রতিষ্ঠানে গ্রাম্য ডাক্তারদের ট্রেনিং, পরীক্ষা গ্রহণ এবং সার্টিফিকেট প্রদান করা হচ্ছে। কিন্তু সম্প্রতি শেষ হওয়া কয়েকটি ব্যাচের শিক্ষার্থীদের ট্রেনিং শেষে জাল সার্টিফিকেট প্রদান নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়। রমিজ উদ্দিন নামের ১৫ নম্বর ব্যাচের এক শিক্ষার্থী মানবজমিনকে জানিয়েছেন, প্রতিষ্ঠান থেকে যে সার্টিফিকেট দেয়া হয় সেটি সংশ্লিষ্ট বিভাগের অনুমোদিত।
কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে যেসব সার্টিফিকেট দেয়া হয়েছে সেগুলোতে বারকোডে কোনো কিছুই আসে না। ফলে সার্টিফিকেট নিয়ে প্রশ্ন তোলেন ট্রেনিং শেষ করা পল্লী চিকিৎসকরা। আর এ প্রশ্ন তুলতেই গোমর ফাঁস হয়। ৯, ১০, ১১ এবং পরবর্তী আরও কয়েকটি ব্যাচের শিক্ষার্থীদের সংখ্যা হবে প্রায় ১৫০ জন। এর মধ্যে অর্ধেককে জাল সার্টিফিকেট দেয়া হয়েছে। ওরা সার্টিফিকেট নিয়ে যার যার এলাকায় চলে যায়। জাল সার্টিফিকেট জানার পর তারা এখন প্রতিষ্ঠানে ছুটে আসেন। ট্রেনিংপ্রাপ্ত পল্লী চিকিৎসক মো. আজাদ জানিয়েছেন, গতকাল সকালে যখন কয়েকজন শিক্ষার্থী ক্ষোভ প্রকাশ করেন তখন প্রতিষ্ঠান রেখে পালিয়ে যায় ইনচার্জ সোলেমান। পরে পুলিশ এসে তাকে পায়নি। এখন পুলিশই প্রতিষ্ঠানটিতে তালা ঝুলিয়ে দিয়েছে। তিনি বলেন, ওই প্রতিষ্ঠান ট্রেনিং ও সার্র্টিফিকেট দেয়ার কথা বলে অন্তত ১৩০ জন শিক্ষার্থীর কাছ থেকে ৪০ থেকে ৫০ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। আমরা তো দায়ী করছি সোলায়মানকে। কারণ- তাদের হেড অফিসের কর্মকর্তারা সোলায়মানকে অস্বীকার করেছেন। জাল সার্টিফিকেট দেয়া হয়েছে বিশ্বনাথের পল্লী চিকিৎসক নিউটন সরকারকে।

বিষয়টি জানার পর তিনিও অবাক। নিউটন সরকার জানিয়েছেন, আমাদের কাছ থেকে ট্রেনিং ও সার্টিফিকেট দেয়ার কথা বলে ৫০-৬০ হাজার টাকা নিয়েছে। তিনি জানান, এই প্রতারণার জন্য ঢাকা এবং সিলেটের কর্মকর্তা দু’জনই দায়ী। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, ২০১৮ সালে আইএলও কোচিং সেন্টারের নামে উপশহরে আসেন ঢাকার কাজী শাহাদাত হোসেন। এরপর সিলেটের ইনচার্জ হিসেবে সোলায়মানকে নিয়োগ দেন। এরপর সাহাদাত ও সোলায়মান মিলে পল্লী চিকিৎসক ট্রেনিং সেন্টার খুলে বসেন। সিলেট নিয়ন্ত্রণ করে সোলায়মান এবং ঢাকা নিয়ন্ত্রণ করেন কাজী সাহাদাত। জাল সার্টিফিকেট দেয়া হচ্ছে ঢাকা থেকে। গত কয়েক দিন ধরে এ নিয়ে উত্তাপ বিরাজ করছিল। সিলেটের ইনচার্জ সোলায়মান ট্রেনিং প্রাপ্তদের ক্ষোভ প্রশমনের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। পরে শুক্রবার ক্ষোভ দেখা দিলে তিনি পালিয়ে যান।

পরে যখন পুলিশ আসে তখন স্থানীয়দের মধ্যেও বিষয়টি জানাজানি হয়। সার্টিফিকেট প্রতারণা, টাকা আত্মসাৎ পুরো ঘটনার জন্য হেলথ এডুকেশন এন্ড ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান কাজী সাহাদাত হোসেনকে দায়ী করেন সিলেটের ইনচার্জ মো. সোলায়মান। তিনি মানবজমিনকে জানিয়েছেন, আমি তো প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী। কাজী শাহাদাত হোসেনের কথামতো প্রতিষ্ঠান চলছে। ট্রেনিংপ্রাপ্ত পল্লী চিকিৎসকদের কাছে যে সার্টিফিকেট বিরতণ করা হয়েছে সেটি ঢাকা থেকে কাজী শাহাদাতই পাঠিয়েছেন। ভুয়া হলে দোষ তার। দায়ভার তার। এখানে আমার কিছুই করার নেই। তিনি জানান, পুলিশ আমাকে ডেকেছে। আমি পুলিশের কাছে আমার বক্তব্য উপস্থাপন করবো। অন্যায় করলে প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান শাহাদাত করেছেন, আমি নই। তবে- সোলায়মানকে প্রতারক বলে উল্লেখ করেছেন প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান কাজী শাহাদাত হোসেন। তিনি মানবজমিনকে জানিয়েছেন, ২০১৮ সালে সোলায়মান আমার সঙ্গে আইএলও কোচিং সেন্টারে ছিল।

এরপর ওই ট্রেনিং সেন্টারের কার্যক্রম গুটিয়ে আমি চলে আসার পর সোলায়মান আমাদের প্রতিষ্ঠানের নামে ট্রেনিং সেন্টার খুলে প্রতারণা করে আসছিল। আমাদের সিলেটে কোনো অফিস নেই এবং সোলায়মানের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই। তিনি বলেন, আমি যে সার্টিফিকেট দেই সেটিতে কোনো ধোঁকাবাজি নেই। সোলায়মান আমার প্রতিষ্ঠানের নাম করে যে প্রতারণা করেছে সেজন্য তিনি আইনের আশ্রয় নেবেন। সোলেয়মানের বিরুদ্ধে মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে জানান তিনি। অন্যদিকে- সোলায়মানও বলেছেন, তিনিও মামলা করবেন। তার সঙ্গে প্রতারণা করা হয়েছে। এদিকে- শাহাদাত ও সোলায়মানের পাল্টাপাল্টিতে অসহায় পল্লী চিকিৎসক ট্রেনিং নেয়া শিক্ষার্থীরা। তারা জানিয়েছেন, কেউ এক বছর, কেউ ৬ মাস ধরে ট্রেনিং নিয়ে এখন সার্টিফিকেট নিয়ে এলাকায় চলে যাবে। কিন্তু জাল সার্টিফিকেট দেয়ার কারণে তারা যেতে পারছেন না। প্রতারকদের প্রতারণা সত্যতা নিশ্চিত হওয়ার পর তারা পুলিশের শরণাপন্ন হয়েছেন। তবে পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে- তারা বিষয়টির তদন্ত করছেন। শিক্ষার্থীদের অভিযোগের সত্যতা মিললে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।