লিভার ফেইলিউর চিকিৎসায় আশার আলো

লিভার ফেইলিউর মানেই আতঙ্ক আর উৎকণ্ঠাজনিত একটি রোগের নাম। সাধারণত ভাইরাল হেপাটাইটিসের মতো একিউট কন্ডিশন কিংবা লিভার সিরোসিসের মতো ক্রনিক ব্যাধিÑএই দুই ধরনের রোগের ক্ষেত্রেই রোগীদের লিভার ফেইলিউর দেখা দিতে পারে। এটি লিভারের সবচাইতে জটিল সমস্যাগুলোর একটি। লিভার ফেইলিউরে মৃত্যুর ঝুঁকি একিউট ও ক্রনিক লিভার রোগের ক্ষেত্রে একেক রকম, কিন্তু কোনো ক্ষেত্রেই তা বিন্দুমাত্র কম আশঙ্কাজনক নয়। একিউট লিভার ফেইলিউরে যেখানে মৃত্যুর ঝুঁকি ৬০ শতাংশ বা তার কাছাকাছি, ক্রনিক ফেইলিউরের ক্ষেত্রেও তা ৫০ শতাংশের আশপাশে।
এখন পর্যন্ত লিভার ফেইলিউরের সবচাইতে ব্যয়বহুল চিকিৎসা লিভার ট্রান্সপ্ল্যাানটেশন, তবে নানা কারণেই তা অনেক জটিল। একজন রোগীর ট্রান্সপ্ল্যাানটেশন করতে হলে আত্মীয়ের মধ্যে একজন ডোনারের প্রয়োজন হয় যা জোগাড় করা সবসময় সম্ভব নয়। বিশেষ করে এটি একিউট লিভার ফেইলিউরের ক্ষেত্রে অনেক বেশি প্রযোজ্য, কারণ এক্ষেত্রে সময় পাওয়া যায় খুবই কম। বাংলাদেশে এই মুহূর্তে লিভার ট্রান্সপ্ল্যানটেশনের বিশেষ কোনো সুবিধা নেই। এমনকি ভারতেও এই চিকিৎসা যথেষ্ট ব্যয়বহুল যা আমাদের মধ্যবিত্তদের নাগালের বাইরে।
তবে আশার আলো হলো স্টেমসেল থেরাপি এসব ক্ষেত্রে নতুন সম্ভাবনার সৃষ্টি করেছে। শুধু লিভার ফেইলিউরেই নয়, টাকে চুল গজানো থেকে শুরু করে হাঁটুর ব্যথা আর হার্ট ফেইলিউর, এমন অনেক রোগেই এর যথেষ্ট প্রয়োগ রয়েছে।

বাংলাদেশে অবশ্য স্টেমসেল থেরাপির কনসেপ্টটি একবারেই নতুন, বিশেষ করে লিভার ফেইলিউরের চিকিৎসায় তো বটেই।
সম্প্রতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের লিভার বিভাগে বাংলাদেশে প্রমবারের মতো ক্রনিক লিভার ফেইলিউরের চিকিৎসায় সাফল্যের সঙ্গে স্টেমসেল থেরাপি ব্যবহার শুরু হয়েছে এবং এ ব্যাপারে আমরা একই বিশ্ববিদ্যালয়ের হেমাটোলজি ও ট্রান্সফিউশন মেডিসিন বিভাগের সঙ্গে কোলাবোরেশন গড়ে উঠেছে।

স্টেমসেল থেরাপির জন্য জিসিএসএফ এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ ওষুধ যা ব্যবহার করা হলে রক্তে স্টেমসেলের সংখ্যা শত গুণে বেড়ে যায়। ওই স্টেমসেলগুলোই প্রবাহিত রক্তের মাধ্যমে টার্গেট অর্গানে পৌঁছে এটির রি-জেনারেশনে সাহায্য করে।

জিসিএসএফ ব্যবহার করে লিভার ফেইলিউরের এ ধরনের চিকিৎসাবহুল প্রচলিত না হলেও একেবারে নতুন নয়। নয়াদিল্লির ইনস্টিটিউট অব লিভার অ্যান্ড বিলিয়ারি সাইন্সেস এবং স্যার গঙ্গারাম হাসপাতালে এভাবে চিকিৎসা করা হয়ে থাকে এবং সম্প্রতি টাইমস অব ইন্ডিয়াতে এ সম্পর্কে একটি রিপোর্টও প্রকাশিত হয়েছে।
রক্ত থেকে জিসিএসএফ প্রয়োগের ফলে বেড়ে যাওয়া স্টেমসেলগুলোকে বিশেষ পদ্ধতিতে আলাদা করে নেয়া হয়, অনেকটা ছেঁকে নেয়ার মতো করে। এরপর আমরা ক্যাথ ল্যাবে এনজিওগ্রামের মাধ্যমে ওই স্টেমসেলগুলো সরাসরি হেপাটিক আর্টারি দিয়ে লিভারে ইংজেক্ট করা হয়।

আমরা একই পদ্ধতিতে লিভার ক্যান্সার চিকিৎসায় এদেশে প্রথমবারের মতো ট্রান্সআর্টারিয়াল কেমোএম্বোলাইজেশন বা টেইস চালু করি যা এই প্রাণঘাতী ক্যান্সারের চিকিৎসায় আধুনিকতম পদ্ধতি।
এভাবে স্টেমসেল ছেঁকে নিয়ে আবারো শরীরে প্রয়োগ করা বা অটোলোগাস ট্রান্সফিউশনের মাধ্যমে হায়দ্রাবাদের এশিয়ান ইনস্টিটিউট অব গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজিতেও স্টেমসেল থেরাপি করা হয়ে থাকে। তবে আমাদের চিকিৎসা পদ্ধতির অভিনবত্ব হচ্ছে যে আমরা ক্যাথ ল্যাবে এনজিওগ্রামের মাধ্যমে সরাসরি লিভারে স্টেমসেল থেরাপি করছি যা পৃথিবীতে এই প্রথম।

স্টেমসেলগুলো আক্রান্ত অর্গান অর্থাৎ লিভারের যত কাছাকাছি এবং সরাসরি প্রয়োগ করা যাবে, তাতে সাফল্যের সম্ভাবনাও ততই বেশি। আর তাই এদেশে লিভার ফেইলিউরের চিকিৎসায় স্টেমসেল থেরাপি শুধু প্রথমবারের মতো চালু করার জন্যই নয়, বরং লিভারে তা প্রয়োগের অভিনবত্বের জন্যও এদেশের এই কৃতী হেপাটোলজিস্টরা প্রশংসার দাবিদার।
বাংলাদেশে বর্তমানে ৩ কোটির উপরে রোগী হেপাটাইটিস বি, সি কিংবা ফ্যাটি লিভারের মতো জটিল লিভারের রোগে আক্রান্ত। পাশাপাশি হেপাটাইটিস এ এবং ই-এর মতো একিউট হেপাটাইটিস ভাইরাসগুলোর প্রকোপও এদেশে যথেষ্টই। প্রকাশিত তথ্য-উপাত্ত অনুযায়ী বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় ২০ হাজার লোক লিভার ফেইলিউরে মৃত্যুবরণ করেন। আশার কথা হলো, স্টেমসেল থেরাপি ভবিষ্যতে অনেক অসহায় রোগীকেই মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরিয়ে আনবে।

লেখক: অধ্যাপক ও ডিভিশন প্রধান, ইন্টারভেনশনাল হেপাটোলজি ডিভিশন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় এবং আঞ্চলিক পরামর্শক, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।
চেম্বার: ল্যাবএইড স্পেশালাইজড হাসপাতাল,
মিরপুর রোড, ধানমণ্ডি, ঢাকা।
হটলাইন-১০৬০৬