জামিন নাকচ, কারাগারে শামসুজ্জামান

সিআইডি পরিচয়ে তুলে নেয়ার ৩৩ ঘণ্টা পর সাংবাদিক শামসুজ্জামানকে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। গতকাল সকালে তাকে আদালতে হাজির করে পুলিশ। হাজতখানায় ৪ ঘণ্টা রেখে আদালতে তোলা হয়। শুনানি শেষে বিচারক রমনা থানার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে করা মামলায় শামসকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। আসামির জামিন আবেদনের শুনানি করে ঢাকার অতিরিক্ত মুখ্য মহানগর হাকিম তোফাজ্জল হোসেন গতকাল এই আদেশ দেন। আদেশের পরেই বিকালে তাকে আদালত থেকে প্রিজন ভ্যানে করে কেরানীগঞ্জ কেন্দ্রীয় কারাগারে নেয়া হয়। এদিন আদালতে সাংবাদিক শামসের পক্ষে জামিন আবেদনের শুনানি করেন আইনজীবী এহসানুল হক সমাজী ও প্রশান্ত কুমার কর্মকার। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন প্রসিকিউশন পুলিশের কর্মকর্তা নিজামুদ্দিন ফকির।
ওদিকে রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্নে র অভিযোগে একজন ব্যক্তি কী করে বাদী হয়ে মামলা দায়ের করলেন, এমন প্রশ্ন এসেছে সাংবাদিক শামসুজ্জামান শামসের জামিন শুনানিতে।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের যেসব ধারায় এই মামলা করা হয়েছে, সেগুলো বিশ্লেষণ করে শামসের আইনজীবী এহসানুল হক সমাজী বলেছেন, এ ধরনের অভিযোগ তো স্টেটের শোলডারে পড়ে। এ খবরে একজন ব্যক্তি ক্ষুব্ধ হয় কী করে? শুনানির শুরুতে আইনজীবী প্রশান্ত কুমার কর্মকার বলেন, আসামির বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয়েছে তা ভিত্তিহীন।
এ মামলার এজাহারে বর্ণিত ঘটনা, অর্থাৎ প্রতিবেদনটি করা হয়েছে দিনমজুর জাকির হোসেন এবং সবুজ নামের প্রথম শ্রেণির একজন ছাত্রের বক্তব্য দিয়ে। এটিতে ভুল বুঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছে।

এখানে দেশের স্বাধীনতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়নি।
আইনজীবী এহসানুল হক সমাজী বলেন, শুনানির সময় ইউটিউব, ফেসবুক ও একাত্তর টেলিভিশনের ৩টি লিংক প্রামাণ্য হিসেবে এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে, তবে সেগুলো আদালতের সামনে উপস্থাপন করা হয়নি। তাই আসামি কী অপরাধ করেছেন তা ‘নির্ণয় করা সম্ভব হচ্ছে না’।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের এজাহারের ধারাগুলো বিশ্লেষণ করে এ আইনজীবী বলেন, রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্নের কথা বলা হয়েছে। বাদী কি কোনো রাষ্ট্রীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অথবা রাষ্ট্রের কোনো কর্মচারী? প্রাইমারি রেসপনসিবিলিটি কার?
এ ধরনের অভিযোগ তো স্টেটের শোলডারে পড়ে। এ খবরে একজন ব্যক্তি ক্ষুব্ধ হয় কী করে? তিনি কীভাবে ব্যক্তিগতভাবে ক্ষুব্ধ হলেন? আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটানোর বিষয়ে প্রতিকার চাওয়া বা অভিযোগ দেয়ার অধিকার কীভাবে বাদীর হলো?

তিনি বলেন, যদি কোনো ব্যক্তি ওয়েবসাইটে বা অন্য কোনো ডিজিটাল প্ল্যাটফরমে ইচ্ছাকৃত বা জ্ঞাতসারে এমন কোনো তথ্য-উপাত্ত প্রেরণ করেন, যা আক্রমণাত্মক, ভীতিপ্রদর্শক অথবা মিথ্যা বলে কোনো ব্যক্তিকে বিরক্ত অপমান, অপদস্থ বা হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য প্রেরণ, প্রকাশ প্রচার করেন, তাহলে এ অপরাধ হয়। মামলার বাদীকে কীভাবে হেয় করা হলো?

এরপর আসামির এ আইনজীবী এজাহারের পুরো অংশ আদালতে পড়ে শোনান। তিনি বলেন, “প্রসিকিউশন কেইস ওয়েল ফাউন্ডেড নয়। সেহেতু ফৌজদারি কার্যবিধির ৪৯৮ ধারায় আসামি জামিন পাওয়ার অধিকারী।’
মাত্র এক মিনিটে এর বিরোধিতা করে রাষ্ট্রপক্ষে বক্তব্য দেন আদালত পুলিশের সাধারণ নিবন্ধন কমকর্তা এস আই নিজাম উদ্দিন ফকির।

প্রায় ২৫ মিনিট শুনানি নিয়ে তার জামিন আবেদন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন ঢাকার অতিরিক্ত মুখ্য মহানগর হাকিম তোফাজ্জল হোসেন।
বুধবার গভীর রাতে রমনা থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান ও প্রতিবেদক শামসুজ্জামানের বিরুদ্ধে মামলা করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মশিউর মালেক। সেখানে প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমানকে হুকুমের আসামি করা হয়েছে। এ ছাড়া নাম উল্লেখ না করে একজন সহযোগী ক্যামেরাম্যানকে আসামি করা হয়েছে। পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ওই প্রতিবেদন লাইক, শেয়ার, কমেন্টকারী আরও অজ্ঞাতদের আসামি করেছেন মামলার বাদী। ওই প্রতিবেদনে মিথ্যা ও মানহানিকর তথ্য প্রচারের অভিযোগে এর আগে তেজগাঁও থানায় আরেকটি মামলা করেন ঢাকা মহানগর উত্তর যুবলীগের নেতা মো. গোলাম কিবরিয়া। সেই মামলায় কেবল শামসকেই আসামি করা হয়।

তেজগাঁও থানার সেই মামলার খবর প্রকাশ্যে আসার আগেই বুধবার ভোর রাতে শামসকে তার সাভারের বাসা থেকে সিআইডি পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। সিআইডি তাকে আটকের বিষয়টি স্বীকার না করলেও ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী স্থানীয় একজন সাংবাদিক, শামসের বাড়িওয়ালা এবং পাশের জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা বলেছেন, যারা শামসকে ধরে নিয়ে গেছেন, তারা সিআইডি পুলিশ হিসেবেই পরিচয় দিয়েছেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বুধবার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, যেহেতু মামলা হয়েছে, পুলিশ আটক করতেও পারে। এরপর বৃহস্পতিবার সকালে শামসকে আদালতে নেয়া হয়। শামস প্রথম আলোর সাভারে কর্মরত নিজস্ব প্রতিবেদক। তিনি থাকতেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় লাগোয়া আমবাগান এলাকায় একটি ভাড়া বাসায়।
প্রথম আলো সম্পাদকের বিরুদ্ধে ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনে মামলা দৈনিক প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে রাজধানীর রমনা থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করা হয়েছে। মামলা নম্বর-১৯। মামলায় পত্রিকাটির সাভারে কর্মরত সাংবাদিক শামসুজ্জামান শামস ও ক্যামেরাম্যানসহ অজ্ঞাতনামা কয়েকজনকে আসামি করা হয়েছে। গত বুধবার রাতে রমনা থানায় মামলাটি করেন আইনজীবী আবদুল মালেক। মামলার তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে রমনা থানার পরিদর্শক (নিরস্ত্র) আবু আনছারকে। এ মামলার পর গতকাল দুপুরে আসামি শামসুজ্জামানকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে তোলা হয়। এ সময় তার জামিন আবেদন করলে তা বাতিল করে কারা হেফাজতে পাঠানো হয়। বাদী আইনজীবী আবদুল মালেক মামলার বিষয়ে বলেন, প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান, সাংবাদিক শামসুজ্জামান ও ক্যামেরাম্যানের বিরুদ্ধে একটি এজাহার করেছি। এর আগে বুধবার সৈয়দ মো. গোলাম কিবরিয়া নামের একজন বাদী হয়ে ডিএমপি’র তেজগাঁও থানায় সাংবাদিক শামসুজ্জামানের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে একটি মামলা করেন। রমনা থানায় এজাহারে উল্লেখ করা হয়, গত ২৬শে মার্চ মহান স্বাধীনতা দিবসে দৈনিক প্রথম আলোর ওয়েবসাইটে একটি ছবিসহ সংবাদ প্রকাশ করা হয়। একই সঙ্গে সংবাদটি তাদের ফেসবুক পেজে শেয়ার করা হয়। সংবাদটিতে দেখা যায়, একটি শিশু ফুল হাতে জাতীয় স্মৃতিসৌধের ফটকে দাঁড়িয়ে আছে। প্রতিবেদকের দাবি, ওই শিশুটির নাম জাকির হোসেন। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, শিশু জাকির হোসেন বলে- ‘পেটে ভাত না জুটলে স্বাধীনতা দিয়া কী করুম। বাজারে গেলে ঘাম ছুটে যায়। আমাগো মাছ, মাংস আর চাইলের স্বাধীনতা লাগবো। প্রকৃতপক্ষে শিশুটি এ ধরনের কোনো কথা বলেনি। এতে প্রমাণিত হয়, বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবসে দেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা হয়েছে। এবং বাংলাদেশের অর্জনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার হীনউদ্দেশ্যে একটি অশুভ চক্র দ্বারা প্রভাবিত হয়ে সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট করার জন্য এই মিথ্যা সংবাদ তৈরি ও পরিবেশন করে অনলাইন ও সামাজিক মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে। ফলে দেশের অভ্যন্তরে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতির সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে।

রাতে মামলা হওয়ার পর প্রথম আলোর প্রধান কার্যালয়ে পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ৮টা থেকে পুলিশ মোতায়েন রয়েছে। মিরপুর থানাধীন স্ট্রাইকিং রিজার্ভ ফোর্স পুলিশের ১৫ জন সদস্য কার্যালয়ের সামনে ডিউটিরত ছিলেন। টিমটির নেতৃত্বে ছিলেন তেজগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) অপূর্ব হাসান।
মামলা প্রসঙ্গে আসামি পক্ষের আইনজীবী প্রশান্ত কুমার কর্মকার মানবজমিনকে বলেন, রমনা থানায় হওয়া মামলায় শামসুজ্জামানকে আদালতে তুলে জামিন আবেদন করলে তা নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠানো হয়। এই মামলায় প্রথম আলো পত্রিকার সম্পাদককে হুকুমের আসামি করা হয়েছে। খুব শিগগিরই তার জামিনের জন্য উচ্চ আদালত কিংবা নিম্ন আদালতে আবেদন করা হবে বলে জানান এই আইনজীবী।