রহমত মাগফিরাত ও নাজাতের মাস পবিত্র রমজান

রহমত বরকত মাগফিরাত ও নাজাতের মাহে রমজান। পবিত্র রমজান মাসের প্রথম ১০ দিন রহমত, মধ্য ১০ দিন মাগফিরাত এবং শেষ দিনগুলো জাহান্নাম থেকে মুক্তির। অন্যান্য মাস অপেক্ষা রমজান মাসের শ্রেষ্ঠত্বের ব— কারণ এ মাসেই বিশ্বমানবতার মুক্তি সনদ পবিত্র আল-কোরআন নাজিল হয়। আল্লাহপাক বলেছেন রমজান সেই মাস যে মাসে কোরআন নাজিল হয়েছে। কাজেই তোমাদের মধ্যে যে কেউ এ মাসটি পাবে সে এ মাসের রোজা রাখবে। এ মাসেই এমন একটি রাত রয়েছে যাকে বলা হয় লাইলাতুল কদর বা সৌভাগ্য রজনী। হজরত উম্মে সালমা (রা.)-বলেন নবীজি (সা.)-তিনটি আমল জীবনে কখনো ছা—েননি। সেগুলো হলো তাহাজ্জুদ নামাজ, আইয়ামে বিদের রোজা এবং রমজান মাসে ইতিকাফ। তিনি প্রতিবছর ১০দিন ইতিকাফ করতেন শেষ বছর ২০ দিন ইতিকাফ করেছেন।
তাকওয়ার মাস রমজান। কোরআন নাজিলের মাস রমজান। রমজানে একটি ফরজ এক মাস রোজা রাখা ; দুটি ওয়াজিব সদকাতুল ফিতর প্রদান করা ও ঈদের নামাজ আদায় করা ; পাঁচটি সুন্নত-সাহ্রি খাওয়া, ইফতার করা, তারাবিহ প—া, কোরআন করিম তিলাওয়াত করা ও ইতিকাফ করা। ওহে তাক্ওয়া অর্জনের মাস ওহে গুনাহ মাফের মাস তোমায় সহস্র মোবারকবাদ বিশ্বমুসলিম সারা বছর অপেক্ষায় থাকেন এ পুণ্যময় পুত-পবিত্র মাসের। অসংখ্য ফজিলত ও মর্যাদাপূর্ণ মাস এটি। পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছে শাহ্র রমাদ্বান আল্লাজি উনজিলা ফিহিল কোরআন। রমজান মাস যাতে কোরআন অবতীর্ণ হয়েছে। মানব জাতির হেদায়তের জন্য এ গ্রন্থখানা সৎপথের স্পষ্ট নিদর্শন এবং সত্যাসত্যের পার্থক্যকারী। পবিত্র কোরানে আরবি বারো মাসের মধ্যে একমাত্র রমজান মাসের নাম উল্লেখ আছে। সর্বশ্রেষ্ঠ মহাগ্রন্থ আল কুরআন অবতীর্ণের কারণেও এ মাস শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী।
পবিত্র রমজান মাস। আরবি মাসসমূহের মধ্যে সবচেয়ে বরকতময় ও মর্যাদাপূর্ণ মাস। দীর্ঘ দুটি মাসের নিরন্তর দোয়া ও প্রার্থনা ছিল-হে আল্লাহ রজব ও শাবান মাস আমাদের জন্য বরকতময় করুন এবং রমাদান আমাদের নসিব করুন! এই দোয়া কবুল হলো। আজ তা বা স্তবে পরিণত হলো। হজরত আবু হুরায়রা (রা.)-বর্ণনা করেন রাসুলুল্লাহ (সা.)-বলেন : যখন রমাদান মাস আসে তখন বেহেশতের দরজা খুলে দেওয়া হয় দোজখের দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয় ; শয়তানকে শৃঙ্খলিত করা হয়।
পবিত্র রমজান হলো আমার উম্মতের মাস বলেছেন প্রিয়নবী (সা.)-তিনি আরো বলেন রজব আল্লাহর মাস শাবান আমার মাস আর রমজান আমার উম্মতের মাস। মহানবী (সা.)- এই হাদিসের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে রজব মাস জমি চাষ করার শাবান মাস বীজ বপন করার এবং রমজান মাসে ফল লাভ করার অফুরন্ত নেয়ামত পাওয়া যায়। হজরত আবু হোরায়রা (রা.)-বলেন হজরত মুহাম্মদ (স.)-ইরশাদ করেন যে ব্যক্তি ইমানের সঙ্গে সওয়াবের আশায় রমজানের রোজা রাখবে তার অতীতের গুনাহসমূহ মাফ করে দেওয়া হবে। হজরত আবদুল্লাহ্ ইবনে ওমর (রা.)-বর্ণনা করেন রাসুলে পাক (সা.)-ইরশাদ করেন সিয়াম এবং কোরআন হাশরের ময়দানে বান্দা-বান্দীর জন্য সুপারিশ করবে এবং আল্লাহ্তাআলা তঁদের উভয়ের সুপারিশ কবুল করবেন। হজরত আবু হোরায়রা (রা.)-আরও বর্ণনা করেন রাসুলে পাক (সা.)-বর্ণনা করেন প্রত্যেক বস্তুর জাকাত রয়েছে তেমনি শরীরেরও জাকাত আছে আর শরীরের জাকাত হচ্ছে রোজা পালন করা। অর্থাৎ জাকাতদানে যেভাবে মালের পবিত্রতা অর্জন হয় তেমনি রোজা পালনের মাধ্যমে শরীর পবিত্র হয় গুনাহ মুক্ত হয়। হজরত আবু হোরায়রা (রা.)-হতে বর্ণিত রাসুলে পাক (সা.)-ইরশাদ করেন মানুষের প্রত্যেক আমলের সওয়াব দশ গুণ হতে সাত শত গুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়। হাদিসে কুদসিতে আছে আল্লাহ্তাআলা বলেন রোজা এ নিয়মের ব্যতিক্রম কেননা তা বিশেষভাবে আমার জন্য আমি স্বয়ং তার প্রতিদান দেব বান্দা তার পানাহার ও কামনা– বাসনাকে আমার সন্তুষ্টির জন্য ত্যাগ করেছে।
হজরত সাহল বিন সাদ (রা.)-থেকে বর্ণিত রাসুলে পাক (সা.)-ইরশাদ করেন জান্নাতের আটটি দরজা রয়েছে। এর মধ্যে একটি দরজার নাম রাইয়ান। এ দরজা দিয়ে শুধু রোজাদারগণ প্রবেশ করবে। অন্যরাও এই দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে চাইবে। কিন্তু রোজাদার ব্যতীত অন্য কাউকে এ দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে দেওয়া হবে না। রহমতের বারিতে স্নাত হয়ে ক্ষমার মহিমায় উজ্জীবিত নব জীবন লাভ করে নাজাত বা অনন্ত মুক্তির নতুন দিগন্তের জান্নাতি আহ্বানে অফুরান কল্যাণের পথে অভিযাত্রার সুবর্ণ সুযোগ মাহে রমাদান।
হজরত আবু হোরায়রা (রা.)-বর্ণনা করেন রাসুল পাক (সা.)-ইরশাদ করেন রোজাদারের জন্য দুটি আনন্দ রয়েছে একটি তার ইফতারের সময় অপরটি হলো আল্লাহ্তাআলার দিদার বা সাক্ষাতের সময়। হাদিসে আরও উল্লেখ রয়েছে ইফতারের সময় দোয়া কবুলের সময়। আল্লাহ্তায়ালা বান্দার দোয়া কবুল করেন। আর এই সময়ের দোয়া হচ্ছে আল্লাহুম্মা ইন্নি আসআলুকা বিরাহমাতিকাল্লাতি ওয়াসিয়াত কুল্লা শাইয়িন আনতাগফিরা লিজুনুবি।
লাইলাতুল কদর হচ্ছে একমনে একটি রাত যে রাতে জেগে ইবাদত-বন্দেগি করলে এক হাজার মাসের ইবাদতের চেয়েও উত্তম বলে পবিত্র কোরআনে উল্লেখ রয়েছে। এক হাজার মাসের হিসাব করলে কদরের এক রাতের ইবাদত ৮৬ বছর ৪ মাসের সমান। কিন্তু আল্লাহ্তাআলা তার চেয়েও বেশি বা উত্তম বলেছেন। যে ব্যক্তি কদরের রাতে সওয়ারের আশায় ইবাদত করবে তার অতীতের গুনাহসমূহ মাফ করে দেওয়া হবে। উম্মুল মুমিনিন হজরত আয়শা সিদ্দিকা (রা.)-বলেন ইয়া রাসুলুল্লাহ (সা.)-আমি যদি কদরের রাত্রি পাই তাহলে আমি কী দোয়া পড়ব ? আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুওউন তুহিব্বুল আফওয়া ফাফুআন্নি এই দোয়া পড়বে। হাদিসে আছে তোমরা রমজানের শেষ দশকের বিজোড় রাত্রিতে (২১, ২৩, ২৫, ২৭ ও ২৯ তারিখ) শবে কদর তালাশ করবে। এশার সালাতের (ফরজ ও সুন্নতের) পর বিতরের আগে দুই রাকাত করে মোট ২০ রাকাত নামাজ আদায় করা সুন্নত। সম্ভব হলে খতম তারাবি আদায় করবে।
আল্লাহ্তাআলা ইরশাদ করেন ওয়া আনতুম আকিফুনা ফিল মাসজিদ তোমরা মসজিদে ইতিকাফ করো। ইতিকাফ শব্দের অর্থ নিজেকে আবদ্ধ রাখা। শরিয়তের পরিভাষায় ইতিকাফ হলো মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি ও নৈকট্য লাভের আশায় শর্ত সাপেক্ষে নিয়তসহকারে পুরুষেরা মসজিদে ও নারীরা ঘরের নির্দিষ্ট স্থানে অবস্থান করা। রমজানের শেষ দশক (২০ রমজান থেকে সূর্যাস্তের পূর্ব থেকে শাওয়াল মাসের চঁদ দেখা পর্যন্ত) ইতিকাফ করা সুন্নতে মুয়াক্কাদায়ে কিফায়া। বিনা প্রয়োজনে অর্থাৎ গোসল খাবার প্রস্রাব-পায়খানা ব্যতীত অন্য কোনো অজুহাতে ইতিকাফের স্থান ত্যাগ করতে পারবে না। ইতিকাফ অবস্থায় কোরআন তিলাওয়াত জিকির নফল নামাজ ইত্যাদিতে মশগুল থাকবে। প্রকৃতপক্ষে রমজান হলো পূর্বের সকল গুনাহর জন্য ক্ষমা চেয়ে সাচ্চা মুসলমান হয়ে জীবনযাপনের প্রতিজ্ঞা করার মাস। এ মাসের সময়গুলো খুব বেশি বেশি ইবাদত-বন্দেগিতে অতিবাহিত করা উচিত।
পবিত্র রমজান মাসের রোজার ফজিলত বা গুরুত্ব অপরিসীম। রোজা যেহেতু আল্লাহর জন্য তাই আল্লাহতায়ালা তাঁরই নিজহাতেই রোজার প্রতিদান দিবেন। কোন রোজাদার ব্যক্তি যদি অন্য রোজাদারকে ইফতার করায় তা হলে সে ব্যক্তিও সেই রোজাদারের সমান সওয়াব পাবে। রমজান তাকওয়া অর্জনের মাস। আর সিয়াম সাধনা বা রোজা পালন তাকওয়া অর্জনের অনন্য সোপান। রমজানে মাসব্যাপী রোজা পালন ফরজ করার তাৎপর্য এখানেই নিহিত। আল্লাহতাআলা বলেন হে মুমিনগণ তোমাদের জন্য রোজা ফরজ করা হলো যেমন তোমাদের পূর্ববর্তীদের জন্য ফরজ করা হয়েছিল ; যাতে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারো। (সুরা বাকারা-আয়াত : ১৮৩)
সদকাতুল ফিতর রমজান মাসে দিতে হয় এমন একটি অনুদান। যাতে মুসলিম সমাজের অভাবী ব্যক্তিরাও যেন স্বাচ্ছন্দে ঈদ উদযাপন করতে পারে। ঈদের নামাজের পূর্বেই এই সদকা আদায় করতে হয়। সাহাবায়ে কেরাম ঈদের বেশ কয়েক দিন পূর্বে অভাবীদের কাছে এ সদকা পৌঁছে দিতেন। যাতে তারা ঈদের জামা-কাপড় এবং বিভিন্ন খাদ্যসামগ্রী কেনাকাটা করে খুশি মনে ঈদ উদযাপন করতে পারে ।
প্রিয় নবী রাসুলুল্লাহ (সা.)-বলেছেন রমজান মাসের প্রথম ১০ দিন হলো রহমত ; তার দ্বিতীয় ১০ দিন মাগফিরাত ; এর শেষ ১০ দিন হলো নাজাত। সাধারণভাবে বলা হয়ে থাকে প্রথম ১০ দিন আল্লাহতাআলা তাঁর বান্দাদের প্রতি রহমত বা দয়া বণ্টন ও বিতরণ করতে থাকবেন। দ্বিতীয় ১০ দিন আল্লাহতাআলা তাঁর বান্দাদের ক্ষমা করতে থাকবেন। শেষ ১০ দিন আল্লাহতাআলা তাঁর বান্দাদের জাহান্নাম থেকে নাজাত বা মুক্তি দিতে থাকবেন।
রহমত, মাগফেরাত ও নাজাত– এ তিনের সমন্বয়ে পবিত্র মাহে রমজান। মাহে রমজান ও তাকওয়ার মধ্যে নিবিড় যোগসূত্র রয়েছে। কেননা রমজান মাসে প্রত্যেক রোজাদারকে অবশ্যই তাকওয়ার গুণাবলি অর্জন করতে হয়। তাকওয়া অর্জনের লক্ষ্যে মাহে রমজানের রোজা পালন ফরজ করা হয়েছে।
পবিত্র রমজান মাসের প্রতিটি মুহূর্ত মহামুল্যবান। দিন ও রাতের প্রতিটি ক্ষণ রোজা, নামাজ, তেলাওয়াত, জিকির, তাসবিহ,তাহলিলে পরিপূর্ণভাবে রমজানকে উদযাপন করাই প্রতিটি মুসলিম নর-নারীর একান্ত কর্তব্য। ফরজ,ওয়াজিবের পাশাপশি সুন্নত আমলসমূহের অনুসরণ করে মাহে রমজানের প্রতিটি মুহূর্তকে সফল করা বিশ্বাসী মুসলমানদের লক্ষ্য হওয়া উচিত। পবিত্র রমজান মাস মহান আল্লাহর সঙ্গে প্রিয় বান্দার প্রেম বিনিময়ের সবচেয়ে উত্তম সময়। এই মাসে পবিত্র কোরআন নাজিল হয়েছে। তাই এ মাসের ফজিলত ও মর্যাদা বেড়ে গেছে আরও বহুগুণ,আল্লাহ রব্বুল আলামীন আমাদের সকলকে হেফাজত করুক। সকল প্রকার খারাপ কাজ থেকে বিরত থাকার দৃঢ়তা দান করুক। আমাদের ঈমানকে মজবুত করার সুযোগ দিক। পবিত্র রমজানের ফজিলত জেনে বেশি বেশি নেক আমল করার তৌফিক দান করুক। রমজানের রহমত-বরকত-মাগফেরাত-নাজাত লাভের তাওফিক দান করুন। আমিন।


লেখক : ফখরুল ইসলাম নোমানী, ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট।