বোমা আতঙ্ক, রক্তপাত, লাশের মধ্যে মানসিক ক্ষত নিয়ে বেড়ে উঠছে ফিলিস্তিনি শিশু

প্রায়দিনই বোমা আতঙ্ক। আকস্মিক ঘেরাও। রক্তপাত। লাশ। এসব দেখতে দেখতে ফিলিস্তিনের শিশুরা বেড়ে উঠছে মানসিক অসুস্থতায়। তাদের মধ্যে স্থায়ীভাবে বাসা বাঁধছে ভয় আর আতঙ্ক। চোখের সামনে পাখির মতো গুলি করে মেরে ফেলা হচ্ছে মানুষ। এসব বিষয়ে প্রামাণ্য আকারে রিপোর্ট উপস্থাপন করেছে ডিফেন্স ফর চিলড্রেন ইন্টারন্যাশনাল প্যালেস্টাইন’। তাতে দেখা গেছে জেনিনের শিশুরা যে সাক্ষ্য দিয়েছে তাতে ইসরাইলি সেনাবাহিনীর চালানো নির্যাতনের কথা ফুটে উঠেছে।

এই রিপোর্টে বলা হয়, বছর শুরু থেকে সেখানে ১৭ শিশুর জীবনের অধিকার লঙ্ঘন করা হয়েছে। ইসরাইলি বাহিনীর শক্তি প্রয়োগের ফলে অন্য শিশুদের ওপরও বড় রকম প্রভাব ফেলেছে। এর মধ্য দিয়ে তাদের আচরণ, চিন্তাভাবনা ও শিক্ষাগত পারফরমেন্সে প্রভাব ফেলছে। শিশুরা এসব নিয়ম লঙ্ঘন প্রত্যক্ষ করেছে। আন্তর্জাতিক আইন দিয়ে তাদের এসব অধিকার সুরক্ষিত থাকার কথা। কিন্তু তা হচ্ছে না। এর ফলে তাদের মানসিক এবং সামাজিক নিরাপত্তার প্রতি হুমকি সৃষ্টি হচ্ছে। এ বছরের শুরু থেকে যে ১৭ শিশুকে তারা হত্যা করেছে, তার মধ্যে ৬টিই জেনিনের। ওই রিপোর্টে বলা হয়েছে, শিশুদেরকে মানবঢাল হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। দীর্ঘ সময় তাদেরকে বাড়িতে আটকে রাখা হয়েছে। এসব বাড়ি সামরিক ব্যারাক হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।
১৭ বছর বয়সী একটি টিনেজার বলেছে, সকালে আমি এবং আমার ১৭ বছর বয়সী সহপাঠী মাহমুদ আল সাদি স্কুলে যাচ্ছিলাম। এমন সময় আমাদের ক্যাম্পে হানা দেয় ইসরাইলি বাহিনী। সব দিক থেকে গুলি করা শুরু করে। এতে আমার সহপাঠী মারা যায়। আমরা দু’জনেই স্কুলের পড়া শেষ করে গ্রাজুয়েশন সম্পন্ন করতে চাইছিলাম। পড়াশোনা করতে চাইছিলাম একসাথে। কিন্তু সেই স্বপ্ন ধুলিস্মাৎ হয়ে গেছে।

১৬ বছর বয়সী আরেক টিনেজার বলেছে, ক্যাম্পে দখলদারদের ঘেরাও এখন নিয়মিত বিষয় হয়ে উঠেছে। যেকোন সময় সেনাবাহিনী প্রবেশ করতে পারে। তাই বাড়ি ছেড়ে কোথাও আর যেতে পারছি না। বাড়ির বাইরে থাকলে সেনাদের ঘেরাওয়ের মধ্যে পড়তে পারি। এ জন্য ভয়ে থাকি।

ডিসিআইপির পরিচালক খালেদ কুজমার বলেছেন, ফিলিস্তিনি শিশুদের ওপর অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগ করছে ইসরাইলি সেনারা। এক্ষেত্রে নিরাপত্তার কোনো সেন্স কাজ করছে না। ভবিষ্যতের জন্য কোনো আস্থা বাড়ছে না। তিনি বলেন, এ অবস্থায় অসহায়ভাবে বসবাস করছে শিশুরা। একটি শিশুকে যদি দেখা যায় ধিয়েশেহ ক্যাম্পে ঘোরাফেরা করছে আর তার পকেটে যদি কিছু লেখা এক টুকরো কাগজ থাকে, তাহলে সে ভয়ে থাকে। সে ভাবতে পারে, ভুল জায়গায় সে চলে গিয়েছে। তাকে হত্যা করা হতে পারে। যে ১৭টি শিশুকে হত্যা করেছে ইসরাইলি সেনাবাহিনী তারা নিরাপত্তায় কোনোরকম হুমকি নয়। যখন কোনো শিশু ক্লাসে ফেরত আসে এবং দেখে তারই এক সহপাঠীকে ইসরাইলি সেনারা হত্যা করেছে, তখন তার মধ্যে গভীর মানসিক ক্ষত দেখা দেয়।

বার বার সামরিক অভিযানে যেসব এলাকার ফিলিস্তিনি শিশু, যেমন জেনিস ক্যাম্প এবং বেথলেহেমের কাছে ধিয়েশেহ ক্যাম্পের শিশু- তাদের প্রয়োজন মনস্তাত্ত্বিক সাপোর্ট।
১৭ বছর বয়সী আরেকটি টিনেজার বলেছে, প্রতিটি ঘেরাওয়ের সময় তারা শিশুদের শহীদ করে। গুলি করে। বাড়িঘর, সহায় সম্পদ লুট করে। আমাদের বাড়ির দেয়াল বুলেটের আঘাতে ফুটো হয়ে আছে। বিপদ আমার পিছু পিছু ঘোরে। যখন ঘরের ভিতর প্রবেশ করি, তখন হামাগুঁড়ি দিই। কারণ, স্নাইপার অথবা ছড়রা গুলির শিকারে পরিণত হতে পারি। এই ভয়, হতাশার চেয়ে মৃত্যু অনেক ভাল। এক বছরের বেশি সময় আমি স্বাভাবিকভাবে ঘুমাতে পারি না। মাঝে মাঝেই বুলেটের শব্দে, বিস্ফোরণের শব্দে ঘুম থেকে জেগে উঠি। আবার কখনো ভয়ে জেগে উঠি। এখন আমি আর স্বপ্ন আর বাস্তবতার মধ্যে কোনো পার্থক্য খুঁজে পাই না।
১৫ বছর বয়সী এক টিনেজার বলেছে, আশ্রয়শিবিরে শহীদের ছবিতে ভরে গেছে। প্রতিজন শহীদের নেপথ্যে আছে একটি কাহিনী, স্মৃতি। বাড়িঘরের জানালা থেকে আমি দেখি যুবকদের কিভাবে রক্তাক্ত অবস্থায় ক্ষতবিক্ষত করে দিয়েছে। কখনো কখনো দেখি শহীদের দেহ কিভাবে পুরোপুরি পুড়ে গেছে। দখলদার বাহিনী আমার শিক্ষক জাওয়াদ বাওয়াকনাকে হত্যা করেছে। তিনি আমাদের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ শিক্ষক ছিলেন। তার কর্মকান্ডের মধ্য দিয়ে আমাদেরকে শক্তি ও আশার সঞ্চার করেছেন।