বাইকের চাকায় জীবিকা লাখো মানুষের

ব্যক্তিগত বাহন মোটরসাইকেল। এতে করে এড়িয়ে চলা যায় যানজট। গন্তব্যে পৌঁছানো যায় কম সময়ে। বর্তমানে মোটরসাইকেলের জনপ্রিয়তা তুঙ্গে। মোটরসাইকেলে ব্যক্তিগত কাজের পাশাপাশি অনেকে রাইড শেয়ারিং করছেন। বেকারদের কেউ কেউ এটিকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন। ঢাকায় মোটরসাইকেলে রাইড শেয়ার করে জীবিকা নির্বাহ করছেন লাখো মানুষ। তাই দিন দিন মোটরসাইকেলের চাহিদা বাড়ছে। বিআরটিএ’র তথ্য বলছে, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত বাংলাদেশে নিবন্ধিত মোটরসাইকেলের সংখ্যা ৪০ লাখ ৬৮ হাজার ৮১৯টি। এরমধ্যে শুধু ঢাকায় নিবন্ধন হয়েছে ১০ লাখ ৩০ হাজার ৬৪৭টি।

ঢাকায় জনপ্রিয় রাইড শেয়ারিং অ্যাপ উবার, পাঠাও, সহজ ডট কম, স্যাম, ওভাই, ওবোন এর মাধ্যমে রাইড শেয়ার করা হয়।

তবে এখন এসব অ্যাপের মাধ্যমে রাইড শেয়ারিংয়ে আগ্রহ হারাচ্ছেন চালকরা। তাই অ্যাপ ছাড়া খ্যাপের মাধ্যমে রাইড শেয়ার করছেন। রাজধানীতে মোটরসাইকেলে রাইড শেয়ার করে একজন দৈনিক ৮০০ থেকে ১ হাজার টাকা আয় করতে পারেন। বেকারদের অনেকেই তাই রাইড শেয়ার করে আয় করেন। তাদের মতো একজন নিয়ামুল হক। ৪ বছর ধরে তিনি ঢাকার রাস্তায় রাইড শেয়ার করেন। প্রতিদিন ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা আয় হয় তার। তিনি বলেন, বেকার থাকার চেয়ে রাইড শেয়ার করা ভালো। অন্তত সংসার চালাতে পারি। ছেলে-মেয়ের লেখাপড়া করাতে পারি। আমার জীবিকার অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে এটি।
করোনায় চাকরি হারিয়ে রায়হান হোসেন ২ বছর ধরে রাইড শেয়ার করছেন। প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত তিনি রাইড শেয়ার করেন। এতে তার কোনোদিন ৮০০ টাকা, কোনোদিন ১ হাজার টাকা আয় হয়। রায়হান বলেন, করোনায় চাকরি যাওয়ার পরে নতুন করে আর চাকরি পাচ্ছিলাম না। পরে কিস্তিতে একটা বাইক কিনে রাইড শেয়ারিং শুরু করি। এখন এটা দিয়েই আমার সবকিছু চলছে। এক মেয়ে লেখাপড়া করছে। সকালে তাকে স্কুলে দিয়ে রাইড শেয়ারে বেরিয়ে পড়ি।

ঢাকায় তীব্র যানজট লেগেই থাকে। এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় পৌঁছাতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটে আটকে থাকতে হয়। দিনের অনেকটা সময় চলে যায় যানজটে। অনেক চাকরিজীবির অফিসে যেতেও দেরি হয়। তাই এসব চাকরিজীবীরা মোটরসাইকেলে যাতায়াত পছন্দ করেন। তারা জানান, ঢাকায় গণপরিবহনে এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে যেতে দীর্ঘ সময় লাগে। বাসের সংকটে স্টপেজেই অপেক্ষা করা লাগে। কখনো কখনো বাসে ঝুলে ঝুলে যেতে হয় অফিসে। এসব ভোগান্তি থেকে যাতায়াত সহজ করতেই তারা মোটরসাইকেল ব্যবহার করেন।

আসাদুজ্জামান উৎসব নামের এক বেসরকারি চাকরিজীবী বলেন, ঢাকায় গণপরিবহনে চলা কঠিন। সরাক্ষণ যানজট লেগে থাকে। ভাড়াও অনেক বেশি। মোটরসাইকেলে আমাদের বেশি যানজট পোহাতে হয় না। সময়মতো গন্তব্যে পৌঁছাতে পারি। সিয়াম আহমেদ নামের এক মোটরসাইকেল চালক বলেন, ঢাকার মতো যানজটপ্রবণ রাস্তায় মোটরসাইকেলের বিকল্প নেই। অল্প জায়গা লাগে মোটরসাইকেলের জন্য। তাই যেকোনো রাস্তা দিয়ে আমরা সহজে গন্তব্যে যেতে পারি।

চাকরিজীবী ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যেও মোটরসাইকেলের জনপ্রিয়তা বাড়ছে। অনেকে পার্ট টাইম রাইড শেয়ারিং করে নিজের লেখাপড়ার খরচের পাশাপাশি সংসারেও সহায়তা করছেন। তেমন একজন বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থী আবু আব্দাল। তিনি মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজিতে অধ্যায়নরত। আব্দাল জানান, রাজধানীর বাসাবো থেকে সকাল ৭টায় তিনি মিরপুরে তার বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশ্যে রওনা দেন। সেখানে পৌঁছাতে তার এক ঘণ্টা লাগে। এরপর ক্লাস শেষ করে দুপুর ১২টার পর ৩-৪ ঘণ্টা রাইড শেয়ার করেন। এতেই তার লেখাপড়ার খরচ হয়ে যায়। পাশাপাশি সংসারেও সহযোগিতা করেন। আব্দাল বলেন, আমার বিশ্ববিদ্যালয় অনেক দূরে। বাসে যেতে আসতে প্রতিদিন ৬ ঘণ্টার মতো লেগে যায়। তাই বাইক কিনে নিয়েছি। এখন দ্রুত সেখানে যেতে পারি। আবার রাইড শেয়ার করে কিছু আয়ও হয়।

মেহেদী হাসান নামের উত্তরা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী বলেন, বৌদ্ধমন্দির থেকে উত্তরা যেতে ৩ ঘণ্টা লেগে যায়। সেখানে বাইকে মাত্র ১ ঘণ্টা লাগে। যেতে আসতে প্রতিদিন ৪ ঘণ্টা করে বেঁচে যায়। এই সময়টা পড়ালেখা কিংবা অন্য কাজে ব্যবহার করতে পারি। মাঝেমধ্যে আর্থিক প্রয়োজন মনে করলে রাইড শেয়ার করি। এতে আমার পকেট খরচও হয়ে যায়।

এসিআই মোটরসের সহকারী ম্যানেজার রাজিয়া সুলতানা লিনা বলেন, ঢাকায় যারা বসবাস করে জীবিকা নির্বাহ করে তাদের বেশির ভাগ মানুষ প্রয়োজনের জন্য বাইক ব্যবহার করে। এতে সময় সাশ্রয় হয়। মানুষ গণপরিবহনের দুর্ভোগ থেকে রক্ষা পায়। বাইকের জন্য সরকার রেজিস্ট্রেশন ফি নিচ্ছে, লাইসেন্স ফি নিচ্ছে। এই অর্থ রাজস্ব খাতে যোগ হচ্ছে। বাইকের জনপ্রিয়তা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সরকারের কোষাগারে অর্থও বেশি জমা হচ্ছে।