মস্কো সফরের পূর্বে শি জিনপিংকে ‘ভাল পুরনো বন্ধু’ বলে প্রশংসা করলেন পুতিন

রাশিয়া সফরে যাচ্ছেন চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। এর আগে তাকে ‘ভাল পুরনো বন্ধু’ বলে প্রশংসা করলেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। সোমবার এই দুই নেতার সরাসরি বৈঠকের কথা রয়েছে। এর আগেই চীনের একটি সংবাদপত্রে আর্টিকেল প্রকাশ করেন পুতিন। এতে ইউক্রেন সংকট সমাধানে গঠনমূলক পদক্ষেপ নিতে চীনের আগ্রহকে স্বাগত জানান রুশ প্রেসিডেন্ট।

খবরে জানানো হয়, ওই আর্টিকেলেই শি জিনপিংকে ঘনিষ্ঠ বন্ধু বলে আখ্যায়িত করেন পুতিন। এই সফরের মধ্য দিয়ে বিশ্বের সামনে নিজেদের বন্ধুত্ব কত দৃঢ় তা তুলে ধরবেন এই দুই নেতা। ইউক্রেনে আক্রমণ করার পর যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্ক ইতিহাসের সবথেকে খারাপ অবস্থায় রয়েছে। পশ্চিমাদের থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে রাশিয়া। এই সময়ে চীনসহ এশিয়ার দেশগুলো রাশিয়ার ঘনিষ্ঠ হয়েছে।

শি জিনপিং-এর সফরের মাধ্যমে পুতিন পশ্চিমাদের দেখাতে চান যে, রাশিয়া মোটেও বিশ্ব সম্প্রদায় থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়নি।
আগে থেকেই ধারণা করা হয় যে, শি জিনপিং ও পুতিনের মধ্যে ব্যক্তিগত পর্যায়েও দারুণ সম্পর্ক রয়েছে। আনুষ্ঠানিক বৈঠকের আগে তারা অনানুষ্ঠানিক মধ্যাহ্নভোজনেও অংশ নেবেন। চীনা প্রেসিডেন্টের মস্কো সফরের আগেই চীনা গণমাধ্যমে আর্টিকেল প্রকাশ করে চমক সৃষ্টি করেছেন পুতিন। এতে তিনি জানান, পুরনো বন্ধু শি জিনপিং-এর রাশিয়া সফর নিয়ে তিনি অনেক আশাবাদী। গত এক দশকে এই দুই নেতা প্রায় প্রতি বছরই একাধিকবার নিজেদের মধ্যে সাক্ষাৎ করেছেন। তবে ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরুর পর এটিই শি জিনপিং-এর প্রথম মস্কো সফর। ওই আর্টিকেলে পুতিন বলেন, ইউক্রেনে যা ঘটছে তা নিয়ে চীনের অবস্থানে রাশিয়া অত্যন্ত খুশি। রাশিয়ার এই অভিযানের ব্যাকগ্রাউন্ড এবং আসল উদ্দেশ্য বুঝতে পারার জন্য চীনকে ধন্যবাদ। এখন চীন এই সংকট সমাধানে যে আগ্রহ দেখাচ্ছে আমরা তাকেও স্বাগত জানাই।

এদিকে পুতিনের পাশাপাশি শি জিনপিং-ও রাশিয়ার গণমাধ্যম রোসিস্কায়া গ্যাজেটা-তে একটি আর্টিকেল লিখেছেন। এতে তিনি ইউক্রেন সংকট সমাধানে বিশ্বকে বাস্তবিক হওয়ার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ইউক্রেন সংকট সমাধানে চীনের ১২ দফা প্রস্তাবে বিশ্ব সম্প্রদায়ের ঐক্যের বিষয়টি যথাসম্ভব রাখা হয়েছে। রাশিয়ায় তার সফরের লক্ষ্য হচ্ছে, দুই দেশের মধ্যে বন্ধুত্বকে শক্তিশালী করা। তিনি চীন-রাশিয়া সম্পর্ককে একটি ‘সর্বব্যাপী অংশীদারিত্ব’ হিসাবে আখ্যায়িত করেন। বলেন, এই বন্ধুত্ব এখন পশ্চিমাদের ‘আধিপত্য, স্বৈরাচার এবং গুন্ডামি’র হুমকিতে রয়েছে। বিশ্বে এমন কোনো ব্যবস্থা চলতে পারে না যেখানে একটি দেশ বাকি সব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারে।

পশ্চিমা বিশ্লেষকরা বলেছেন, শি জিনপিং-এর এই সফর মস্কোর জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কার্নেগি এনডাউমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিস-এর চীন-রাশিয়া সম্পর্ক বিশ্লেষক আলেকজান্ডার গাবুয়েভ বলেন, চীন এখন পর্যন্ত রাশিয়ার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মিত্র। অর্থনৈতিক দিক থেকে বিশ্বের দ্বিতীয় শক্তিশালী দেশের নেতা শি জিনপিং। ইউক্রেনে যখন রাশিয়া যুদ্ধ করছে তখন তার মস্কো সফরে যাওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

এমন এক সময় শি জিনপিং মস্কো সফরে যাচ্ছেন যখন ইউক্রেনীয় শিশুদের অপহরণের কথিত এক অভিযোগের জেরে পুতিনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে আন্তর্জাতিক আদালত। পশ্চিমা দেশগুলোর সরকার আন্তর্জাতিক আদালতের এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে। যদিও এই রায় অনেকটা প্রতীকী এবং পুতিনকে গ্রেপ্তারের বিষয়টিও অসম্ভব বলেই দেখা হয়। তারপরেও শি জিনপিং-এর এই সফর পুতিনকে আশ্বস্ত করবে যে, এই বিশ্বব্যবস্থায় রাশিয়া মোটেও বিচ্ছিন্ন কোনো দেশ নয়, চীন তার পাশে আছে।

এর আগে সদ্য রাশিয়ায় যুক্ত হওয়া দনেতস্ক অঞ্চলের মারিউপোল শহর পরিদর্শনে যান পুতিন। যদিও যে গণভোটের মাধ্যমে দনেতস্ক রাশিয়ায় যুক্ত হয়েছে তাকে স্বীকৃতি দেয় না পশ্চিমা দেশগুলো। মারিউপোলে গাড়িতে করে ঘুরে বেড়ান পুতিন, কথা বলেন সাধারণ মানুষদের সঙ্গে। নিজেই ঘুরে ঘুরে দেখেন শহরের নানা অংশ। এটিও হতে পারে পশ্চিমের জন্য তার একটি বার্তা। আন্তর্জাতিক আদালতের ওই রায়ের পরই আকস্মিক মারিউপোল ও ক্রাইমিয়া সফর করলেন পুতিন। যদিও ক্রাইমিয়া সফর পুতিনের জন্য নতুন কিছু না এবং তার মারিউপোলে যাওয়ার বিষয়টিও আগে থেকেই শোনা যাচ্ছিল।

বিশ্লেষকরা বলছেন, গত এক বছর ধরে পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে এভাবে দারুণভাবে টিকে থাকতে রাশিয়াকে সর্বোচ্চ সাহায্য করে গেছে চীন। গাবুয়েভ বলেন, যুদ্ধের আগে ক্ষমতায় একটি বড় ভারসাম্যহীনতা ছিল। তবে গত এক বছরের ঘটনাপ্রবাহ এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটিয়েছে। চীন-রাশিয়া সম্পর্ক আরও শক্তিশালী হয়েছে। চীন এখন শুধু সামনের দিকেই বাড়বে। গাবুয়েভ বেইজিংয়ের উপর রাশিয়ার ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক নির্ভরতার দিকে ইঙ্গিত করে বলেন, রাশিয়া যত আমদানি করে তার ৪০ শতাংশের বেশি আসে এখন চীন থেকে।

চীন রাশিয়ায় বেসামরিক এবং সামরিক উভয় ক্ষেত্রে প্রচুর পরিমাণে পণ্য সরবরাহ করতে পদক্ষেপ নিয়েছে। কাঁচামাল থেকে কম্পিউটার চিপস সবই মস্কোতে পাঠাচ্ছে বেইজিং। যুদ্ধের সময় রাশিয়া যাতে কোনো সংকটে না পড়ে তা মোকাবিলা করেছে চীন। রাশিয়ার সঙ্গে চীনের বাণিজ্য এখন ২০০ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। যা এক বছর আগেও অসম্ভব মনে হতো। দেশ দুটি এখন এই বাণিজ্য ৪০০ বিলিয়ন ডলারে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করছে। গত বছর রাশিয়া থেকে চীনের জ্বালানি তেল আমদানি ৮ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। রাশিয়ার শীর্ষ উৎপাদক গ্যাজপ্রম বলছে, রাশিয়া থেকে চীনে গ্যাস রপ্তানি বেড়েছে ৫০ শতাংশেরও বেশি। এটাই প্রমাণ করে যে, কেনো এত এত পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার পরেও রাশিয়ার অর্থনীতি ভাল করছে।