ইসলামী জীবন-দর্শনে মানবজীবনে তাকওয়ার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা

যাবতীয় প্রশংসা কেবলই আল্লাহ তাআলার যিনি সমগ্র জগতের মালিক ও রব। আর সালাত ও সালাম নাযিল হোক আমাদের নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর যিনি সমস্ত নবীগণের সরদার ও সর্বোচ্চ সম্মানের অধিকারী। আরও নাযিল হোক তার পরিবার-পরিজন ও সমগ্র সাথী-সঙ্গীদের ওপর। নিশ্চয়ই আপনি প্রশংসিত সম্মানিত।
তাকওয়া আরবি শব্দটির আভিধানিক অর্থ ভয় করা। পরিভাষায় তাকওয়া বলতে মানব মনের এমন এক প্রবৃত্তিকে বোঝায় যা মুমিন ব্যক্তিকে সর্বদা আল্লাহর ভয়ে ভীত রাখে। সে সদা সর্বদা এই ভয়ে ভীত থাকে যে জীবনের ক্ষুদ্রাতি ক্ষুদ্র কোনো কাজেও যদি আল্লাহর হুকুম অমান্য করা হয় তা হলেও কিয়ামতের দিন সেজন্য জবাবদিহি করতে হবে এবং জাহান্নামের কঠিন শাস্তি ভোগ করতে হবে। ইসলামী আখলাকের অন্যতম বৈশিষ্ট্য তাকওয়া। তাকওয়া বা আল্লাভীতি মুমিন ধজীবনের ভূষণ। মানব জীবনে তাকওয়া এমন একটি মহৎগুণ যা মানবকে যাবতীয় কুকর্ম হতে রক্ষা করে এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের পথ সুগম করে।
শাব্দিক অর্থে তাকওয়া শব্দের অর্থ ভয় করা, বিরত থাকা, রক্ষা করা, আত্মশুদ্ধি-পরহেজগারী নিজকে কোন বিপদ ও অকল্যাণ থেকে সম্ভাব্য সকল উপায়ে বাঁচিয়ে রাখা বা কোন অনিষ্ট হতে আপনাকে দূরে রাখা ইত্যাদি। তাকওয়া মানে সতর্কতা সাবধানতা। তাকওয়া মানুষকে পাপ থেকে দূরে রাখে এবং সৎকাজে অনুপ্রাণিত করে। আল্লাহ তাআলা বলেছেন হে মুমিনগণ ! তোমরা তাকওয়া অর্জন করো আল্লাহকে ভয় করো এবং সত্যবাদীগণের সঙ্গী হও। (সুরা-৯ : তওবা,আয়াত : ১১৯)।
পারিভাষিক অর্থে সকল প্রকার অন্যায় ও অনাচার বর্জন করে কুরআন ও সুন্নাহর নির্দেশ মত জীবনযাপনের মাধ্যমে আল্লাহকে প্রতিনিয়ত ভয় করে চলাকে তাকওয়া বলে। যিনিই এ অতীব মহৎ গুণের অধিকারী তিনিই মুত্তাকী বলে অভিহিত। ইসলাম মানুষকে যে সব চিন্তা তৎপরতা কথা কাজ প্রভৃতি বিষয় নিষেধ করেছে তা পরিহার করে তথা যাবতীয় মন্দ অশ্লীল ও অকল্যাণকর দিক বর্জন করে কল্যাণময় দিকগুলো গ্রহণ করাই তাকওয়ার বাস্তবতা। সাবধান ! আল্লাহওয়ালাগণের কোনো ভয় নেই এবং তারা দুশ্চিন্তাগ্রস্তও হবে না যারা ইমান আনে এবং তাকওয়া অর্জন করে।
তাকওয়ার গুরুত্ব প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেন যদি তোমরা আল্লাহকে ভয় করে চলতে থাক (তাকওয়া অবলম্বন কর) তাহলে তিনি তোমাদের ভাল-মন্দের মধ্যে পার্থক্য করার মানদন্ড বা যোগ্যতা ও শক্তি দান করবেন তোমাদের ভুলত্রুটি ও গুণাহরাশি ক্ষমা করবেন। কেন না আল্লাহ বড়ই অনুগ্রহশীল। তাকওয়া অবলম্বন করার সুফল ও পুরস্কার হিসেবে আল্লাহ বলেন যে ব্যক্তি আল্লাহর সামনে দাঁড়াবার ভয় করে এবং নিজেকে কুপ্রবৃত্তি থেকে বিরত রাখে তার স্থান হবে জান্নাত।
ইসলামী জীবন-দর্শনে তাকওয়াই সকল সৎগুণের মূল। তাকওয়া একটি মহৎ চারিত্রক বৈশিষ্ট্য। মানুষের ব্যক্তি ও সামাজিক চরিত্র গঠনে তাকওয়ার প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব অপরিসীম। ব্যক্তি চরিত্র গঠনে তাকওয়া একটি সুদৃঢ় দুর্গস্বরূপ। যার মধ্যে তাকওয়া বিদ্যমান সে সর্বদা আল্লাহর উপস্থিতি অনুভব করে। আর যে আল্লাহকে হাজির-নাজির মনে করে সে কোন পাপ কাজে জড়াতে পারে না। অপর পক্ষে যে তাকওয়া শূন্য তার দ্বারা সকল অপকর্ম করাই সম্ভব। সুতরাং তাকওয়া সুন্দর, পরিচ্ছন্ন, পরিশুদ্ধ ও সৎ জীবনযাপনের মূল কথা।
মানবজীবনে তাকওয়ার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা :
১. ব্যক্তি চরিত্র গঠনে : মানুষের ব্যক্তি জীবনে তাকওয়ার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। ব্যক্তি চরিত্র গঠনে তাকওয়ার বিকল্প নেই। যে মুমিনের হৃদয়ে তাকওয়া আছে সে কোন অবস্থাতেই প্রলোভনে পড়ে না এবং নির্জন থেকে নির্জনতর স্থানেও পাপ কাজে লিপ্ত হয় না। কারণ সে জানে সবাইকে ফাঁকি দেয়া গেলেও আল্লাহকে ফাঁকি দেয়া যায় না। তাই চরিত্র গঠনে তাকওয়া একটি সুদৃঢ় দুর্গস্বরূপ।
২. ইবাদতের মূল বস্তু : তাকওয়া হচ্ছে ইবাদত-বন্দেগীর মূল বস্তু। ইবাদতের আনুষ্ঠানিকতার কোন মূল্য নেই যদি সেখানে তাকওয়া বা আল্লাহর ভয় না থাকে। যেমন আল্লাহর ঘোষণা আল্লাহর নিকট তোমাদের কুরবানীর গোশত রক্ত কিছুই পৌঁছে না, পৌঁছে শুধু এ থেকে অর্জিত শিক্ষা সংযমের অভ্যাস তাকওয়া। (সূরা-আলহাজ্জ : ৩৭)।
৩. ঈমানের পরিপূর্ণতা : আল্লাহ তায়ালাকে যথাযথভাবে ভয় না করলে ঈমানের পরিপূর্ণতা আসে না। তাই আল্লাহ তাকওয়া অর্জনের নির্দেশ দিয়ে ঘোষণা করেন হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহকে যথাযথভাবে ভয় কর এবং আল্লাহর কাছে পরিপূর্ণভাবে আত্মসমর্পণ না করে মৃত্যু বরণ করো না। (সূরা-আল ইমরান : ১০২)।
৪. আল্লাহর সান্নিধ্য লাভ : আল্লাহর সান্নিধ্য নৈকট্য ও সহায়তা লাভের জন্য তাকওয়া অবলম্বন করা অপরিহার্য। আল্লাহ বলেন : তোমরা আল্লাহকে ভয় কর। কেননা জেনে রেখ আল্লাহ মুত্তাকীদের সাথে আছেন। (সূরা-আল বাকারাহ : ১৯৪)।
৫. মর্যাদার মাপকাঠি : আল্লাহর নিকট তাকওয়াই হচ্ছে শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদা লাভের মাপকাঠি। আল্লাহ ঘোষণা করেন : তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তিই বেশি মর্যাদাবান, যার মধ্যে বেশি তাকওয়া আছে। (সূরা-আল হুজুরাত : ১৩)।
৬. জীবনের সাফল্য : তাকওয়ার গুণই মানুষের ইহ-পরকালীন জীবনে সামগ্রিক সাফল্য বয়ে আনবে। আল্লাহ বলেন : নিশ্চয়ই তাকওয়াবানদের জন্যে রয়েছে সফলতা। (সূরা আন-নাবা : ৩১)।
৭. আত্মার পরিশুদ্ধি : মানুষের আত্মার পরিশুদ্ধি ও পরিশোধনের জন্য তাকওয়া একান্ত অপরিহার্য। হৃদয়ে তাকওয়া থাকলে সে মানুষ কোন অন্যায়-অশ্লীল কাজ করতে পারে না এবং কোন পাপ চিন্তা তার আত্মাকে কলুষিত করতে পারে না।
৮. নিষ্ঠায় : তাকওয়া ব্যক্তি মানুষের চরিত্রে তার আকীদা-বিশ্বাসে, কাজ-কর্মে আচার-আচরণে ইবাদত-বন্দেগীতে এবং দায়িত্ব পালনে নিষ্ঠার সৃষ্টি করে। তাই সে হয় সকল কাজে অতীব আন্তরিক ও নিষ্ঠাবান।
৯. ঈমানের মজবুতি : তাকওয়া মানুষের ঈমানের মজবুতি ও পূর্ণতা এনে দেয়। যে ব্যক্তি যত তাকওয়া সম্পন্ন, তার ঈমান তত বেশি মজবুত। সে জীবনে-মরণে কখনো তাকওয়া থেকে এতটুকু বিচ্যুত হয় না। সে ব্যক্তিগত পারিবারিক সামাজিক অর্থনৈতিক রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আল্লাহকে ভয় করে চলে এবং তাকওয়ার সাথে জীবনযাপন করে।
১০. জাহান্নাম থেকে পরিত্রাণ : তাকওয়া মানুষকে জাহান্নামের ভয়াবহ কঠিন শাস্তি হতে মুক্তি দান করে। মহানবী (সা.)- এ বিষয়ে বলেন : জ্ঞান-বিজ্ঞানের মূল হলো আল্লাহর ভয়। তিনি আরো বলেন সে দু’টো চোখকে জাহান্নামের আগুন স্পর্শ করবে না : (ক) যে চোখ আল্লাহর ভয়ে অশ্রু ঝরায় (খ) আর যে চোখ আল্লাহর রাস্তায় পাহারায় রত থেকে কাঁদে।
১১. জান্নাতে দুটি উদ্যান লাভ : মুত্তাকীরা নিশ্চিতভাবে জান্নাত লাভ করবে তাকওয়ার মানদন্ড অনুযায়ী কেউ কেউ দু’টি উদ্যান লাভে ধন্য হবে। আল্লাহ বলেন : যে ব্যক্তি তার পালনকর্তার সামনে পেশ হওয়ার ভয় রাখে তার জন্য দুটি উদ্যান রয়েছে। (সূরা-আল-রাহমান : ৪৬)।
উপরোক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলতে পারি, তাকওয়া বা আল্লাহ ভীতি মানুষের সবচেয়ে বড় গুণ। আর যে সমাজের মানুষের মধ্যে এ গুণ অর্জিত হয় সে সমাজ হয় সুখী সমৃদ্ধশীল। তাকওয়াবান মানুষ কখনও ব্যক্তি ও সমাজকে ফাঁকি দেয় না। তাই মানুষ ব্যক্তি জীবনে যেমন হয় সৎ তেমনি সমাজ জীবনে হয় কর্তব্যনিষ্ঠ। এ জন্য সুষ্ঠু সুন্দর ও সুশৃক্মখল সমাজ প্রতিষ্ঠা একমাত্র তাকওয়া দ্বারাই সম্ভব। হে আল্লাহ ! তোমার করুণাধারায় আমাদের সিক্ত করো।


লেখক : ফখরুল ইসলাম নোমানী, ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট।