আহলে বাইত ও আওলাদে রাসূলগণের ভালোবাসায় পবিত্র রিজিক দান করেন আল্লাহতায়ালা

যাবতীয় প্রশংসা কেবলই আল্লাহ তা‘আলার যিনি সমগ্র জগতের মালিক ও রব। আর সালাত ও সালাম নাযিল হোক আমাদের নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর, যিনি সমস্ত নবীগণের সরদার ও সর্বোচ্চ সম্মানের অধিকারী। আরও নাযিল হোক তার পরিবার-পরিজন ও সমগ্র সাথী-সঙ্গীদের ওপর।
‘আহলে বাইত’ পবিত্র কোরআনের পরিভাষা। ‘আহলে বাইত’ হলেন প্রিয় নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর বংশধর ও আত্মীয়-স্বজন। প্রখ্যাত আলেম আল্লামা জালাল উদ্দিন সূয়ুতী (রহঃ) বর্ণনা করেন যে, পবিত্র কোরআন ও নবী (সা.)-এঁর হাদীস হতে এটা প্রমাণিত হয় যে, আহলে বাইত আলী, ফাতেমা, হাসান ও হোসাইন (রা.) এঁর মুয়াদ্দাত (আনুগত্যপূর্ণ ভালোবাসা) দ্বীনের ফরায়েজে গণ্য; সুতরাং ইমাম শাফেয়ী (রহঃ) এটার সমর্থনে এরূপ সনদ দিয়েছেন যে, “ইয়া আহলে বাইত-এ রাসূল,আল্লাহ তাঁর নাজিল করা পবিত্র কোরআনে আপনাদের মুয়াদ্দাতকে ফরজ করেছেন,যারা নামাজে আঁপনাদের উপর দরুদ পড়বে না, তাদের নামাজই কবুল হবে না”। আল্লাহ ও হজরত রাসূলুল্লাহর (সা.) প্রতি ভালোবাসা অতীব গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। নবীপ্রেম (এশকে রাসূল) ও আল্লাহ প্রেম (এশকে এলাহি) ছাড়া কোনো মানুষ প্রকৃত মোমিন-মুসলমান হতে পারে না। সহিহ বোখারি শরিফের এক হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, এক সাহাবি রাসূলুল্লাহকে (সা.) যখন বললেন, আমি বেশি কিছু আমল করতে পারি না, তবে আল্লাহতায়ালা ও তার রাসূলকে (সা.) ভালোবাসি, তখন রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছিলেন, তুমি তার সঙ্গি হবে, যাকে তুমি ভালোবাস। অর্থাৎ তুমি যেহেতু আল্লাহ ও তার রাসূলের ভালোবাসায় আমল করেছ, সুতরাং তুমি আমার সঙ্গে জান্নাতে থাকবে। আল্লাহতায়ালা তোমাকে জান্নাত দান করবেন। তিরমিজি শরিফের আরেক হাদিসে হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি আমাকে ভালোবাসল,সে জান্নাতে আমার সঙ্গে অবস্থান করবে। বর্ণিত হাদিসের আলোকে বলা যায়, এশকে রাসূল ও এশকে এলাহি অর্জন করতে হলে, রাসূলের আনুগত্য করতে হবে। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে, প্রতিটি কাজে রাসূলের নীতিমালা ও কর্মপন্থা অবলম্বন করতে হবে। এ ছাড়া রাসূলের এশক ও মহব্বত অর্জিত হতে পারে না।
হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, তোমরা আল্লাহকে ভালোবাস। কেননা তিনি তোমাদের তাঁর নেয়ামতগুলো খাওয়াচ্ছেন। আর আল্লাহর ভালোবাসায় তোমরা আমাকেও ভালোবাস এবং আমার ভালোবাসায় আমার আহলে বায়েতকেও ভালোবাস (তিরমিজি শরিফ)।
সব ধরনের রিজিকের জন্য আল্লাহকে ভালোবাসতে হবে। আল্লাহর ভালোবাসা পাওয়ার জন্য সব ধরনের রিজিকের জন্য রাসূল (সা.)কে ভালোবাসতে হবে। রাসূল (সা.)-এর ভালোবাসা পাওয়ার জন্য সব ধরনের রিজিকের জন্য আওলাদে রাসূলদের ভালোবাসতে হবেই। সব ধরনের রিজিকের জন্য আল্লাহকে ভালোবাসতে হবে, রাসূল (সা.) কে ভালোবাসতে হবে, আওলাদে রাসূলদের ভালোবাসতে হবেই-এর কোনো অন্যথা নেই।
সূরা আলে ইমরানের (৩:৩১) আয়াতে দেখা যাচ্ছে, রাসূল (সা.)-এর অনুসরণ করলে আল্লাহ তাকে ভলোবাসেন। সব ধরনের রিজিকের জন্য আল্লাহকে ভালোবাসতে হবে রাসূলের অনুসারী হয়ে। এ বেলায়েতি জামানায় আওলাদে রাসূলের অনুসারী হলে রাসূল (সা.)-এর অনুসরণ হবে। আর রাসূল (সা.)-এর অনুসরণ করলে আল্লাহর সব ধরনের ভালোবাসা পাওয়া যাবে।
আওলাদে রাসূলের অনুসরণ করলে রাসূল (সা.)-এর অনুসরণ হয়, রাসূল (সা.)-এর অনুসরণ করলে আল্লাহ খুশি হন এবং আল্লাহর ভালোবাসা পাওয়া যায়। রাসূল (সা.)-এর অনুসরণের মাধ্যমে আল্লাহর ভালোবাসা পাওয়া উম্মতে মোহাম্মদের মূল লক্ষ্য। ইব্রাহিম (আ.)-এর বংশধর, মোহাম্মদ (সা.)-এর বংশধর-আওলাদে রাসূল সম্পর্কে যাদের কোনো ধারণা নেই তারা মনে করেন, নামাজ, রোজা, হজ, জাকাতই সব।
নামাজ, রোজা, হজ, জাকাতেই রাসূল (সা.)-এর অনুসরণ হবে আর কিছুই লাগবে না। নবী বংশ আওলাদে রাসূলরা সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ-কোরআনের এ কথাটি তারা আমলেই আনতে চায় না। আওলাদে রাসূলরা সমগ্র সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ-এ কথাটির অর্থ হচ্ছে নামাজ, রোজা, হজ, জাকাতের চেয়ে শ্রেষ্ঠ হচ্ছে আওলাদে রাসূলদের মান্য করা।
হজরত যায়েদ ইবনে আরকাম (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, আমি তোমাদের মাঝে এমন জিনিস রেখে গেলাম যা তোমরা শক্তভাবে ধারণ (অনুসরণ) করলে আমার পরে কখনও গোমরাহ হবে না। তার একটি অপরটির চেয়ে অধিক মর্যাদাপূর্ণ ও গুরুত্বপূর্ণ, আল্লাহর কিতাব যা আসমান থেকে জমিন পর্যন্ত প্রসারিত এবং আমার পরিবার অর্থাৎ আমার আহলে বায়েত। এ দুটি কখনও পৃথক হবে না কাওসার নামক ঝর্ণায় আমার সঙ্গে উপস্থিত না হওয়া পর্যন্ত। অতএব, তোমরা লক্ষ কর, আমার পরে এতদুভয়ের সঙ্গে তোমরা কেমন আচরণ কর। (মুসলিম, তিরমিযি শরিফ)।
তোমরা কোরআনকে যতটুকু মর্যাদা দাও তাদেরও ততটুকু মর্যাদা দিও এবং তৃষ্ণার্ত উট যেভাবে পানির ঝর্ণার দিকে ছুটে যায়, হেদায়েতের তৃষ্ণা মিটানোর জন্য তোমরাও সেভাবে তাদের দিকে যেয়ো। নাহ্জ আল বালাঘা-মাওলা আলীর উপরোক্ত হাদিস থেকে স্পষ্ট, আমাদের আল্লাহর কোরআন ও রাসূল (সা.)-এর আহলাল বায়েত অর্থাৎ আওলাদে রাসূলদের দৃঢ়ভাবে ধারণ বা অনুসরণ করতে হবে। আল্লাহর কোরআন ও আওলাদে রাসূল এ দুটোর একটিকে বাদ দিয়ে হাউজে কাওসারে রাসূল (সা.)-এর কাছে যাওয়া যাবে না।
রাসূল (সা.) আত্মীয়-অনাত্মীয় সব ধরনের সাহাবিদের কাছে মা ফাতেমা, হজরত আলী, ইমাম হাসান, ইমাম হোসাইনের (রা.) সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণ সদ্ব্যবহার ছাড়া আর কিছুই চাননি। মা ফাতেমা, হজরত আলী, ইমাম হাসান, ইমাম হোসাইনের (রা.) বংশীয় ধারার আওলাদে রাসূলদের সঙ্গে মহাব্বতের আনুগত্যশীলতাই আল্লাহ ও রাসূলের মূল রিজিক পাওয়ার একমাত্র উপায়।
কোরআনের এ আয়াত বুঝে পড়তে হবে। আর তিনি নিজ বান্দাহদের তওবা গ্রহণ করেন এবং গুনাহগুলো মিটিয়ে দেন, আর তোমাদের কৃতকর্ম সম্পর্কে অবহিত। আয়াত-২৪: এ আয়াতের আগে আয়াত নাজিল হলে সাহাবারা জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ। আপনার কোন আত্মীয়ের সঙ্গে আমাদের মহাব্বত রাখার নির্দেশ দেয়া হচ্ছে ? রাসূল (সা.) বললেন, ফাতিমা আলী, হাসান এবং হোসাইন (রা.)।
তখন কতিপয় লোকের ধারণা জন্মাল, রাসূল (সা.)-এর এ আদেশ দেয়ার উদ্দেশ্য হল তারা যেন রাসূল (সা.)-এর পর আমাদের ওপর হুকুমত চালায় এবং আমরা তাদের প্রজা হয়ে থাকি। তখন এ আয়াতটি অবতীর্ণ হয়। (খাযিন) শানে নুজুল আয়াত-২৫:২৪ নং আয়াতটি নাজিল হওয়ার পর কুধারণাকারীরা লজ্জিত হয়ে পড়ল এবং আবেদন করল, হে আল্লাহর রাসূল। আমরা আমাদের কুধারণা থেকে তওবা করছি। তখন তওবা গ্রহণের সুসংবাদে আয়াতটি অবতীর্ণ হয়।
যারা আওলাদে রাসূলের প্রতি আনুগত্যশীল তাদের প্রতি আল্লাহ ক্ষমাশীল অর্থাৎ তারা সব ধরনের রিজিক পাবে। বেহেশতিদের জন্য সব ধরনের উত্তম নিয়ামতপূর্ণ রিজিকের সমাহার রয়েছে। বেহেশতি মহিলাদের সর্দার মা ফাতেমাসহ আওলাদে রাসূলদের প্রতি আনুগত্যশীল মহিলারা বেহেশতি নিয়ামতপ্রাপ্ত হবে মা ফাতেমার নেতৃত্বে।
বেহেশতি নিয়ামতপ্রাপ্ত যুবকদের সর্দার হচ্ছেন ইমাম হাসান-ইমাম হোসাইন (রা.) । ইমাম হাসান-ইমাম হোসাইন (রা.) সহ আওলাদে রাসূলদের প্রতি আনুগত্যশীলরাই বেহেশতে নিয়ামতপ্রাপ্ত হবে। যার বণ্টন ব্যবস্থা ইমাম হাসান-ইমাম হোসাইনের ওপর থাকবে। আওলাদে রাসূলদের এ শ্রেষ্ঠত্ব কোনো মানুষ-জিন-ফেরেশতা প্রদত্ত নয় স্বয়ং আল্লাহ প্রদত্ত।
সাহাবায়ে কেরামগণের মতো আমাদেরকেও রাসূল (সা.)-কে জান-প্রাণ দিয়ে ভালোবাসতে হবে। সর্বাবস্থায় তাঁর আদর্শকে সমুন্নত রাখার চেষ্টা করতে হবে। রাসূল (সা.) যা বলেছেন তা সত্য বলে মেনে নেয়া এবং তাঁর আনুগত্য করা আমাদের জন্য অপরিহার্য। প্রত্যেক কাজে রাসূলের অনুগত্য করাই হচ্ছে রাসূলের প্রতি ভালোবাসা। রাসূলের প্রতি ভালোবাসা যতো বাড়বে রাসূলের আনুগত্যও ততো বাড়বে। এতে আল্লাহ তা’লা সন্তুষ্ট হবেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘(হে রাসূল আপনি) বলুন, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালোবাসো, তাহলে আমাকে অনুসরণ কর, যাতে আল্লাহও তোমাদিগকে ভালোবাসেন এবং তিনি তোমাদের গোনাহখাতা মাফ করে দেবেন; আল্লাহ তা’লা অত্যন্ত ক্ষমাশীল ও দয়াবান।’ (সূরা আল-ইমরান: ৩১)। সব ধরনের রিজিকের জন্য আল্লাহকে ভালোবাসতে হবে, রাসূল (সা.) কে ভালোবাসতে হবে, আওলাদে রাসূলদের ভালোবাসতে হবেই-এর কোনো অন্যথা নেই। আওলাদে রাসূলদের ভালোবাসায় পবিত্র রিজিক দান করেন আল্লাহতায়ালা।
আহলে বাইত ও আওলাদে রাসূলদের কল্যাণ সাধন করা সমগ্র উম্মতের জন্য রাখা হয়েছে। যারা আল্লাহর পথ ধরে আওলাদে রাসূলের কল্যাণে ব্যয় করবে তার কল্যাণ বহুগুণে বৃদ্ধি করে দেবেন আল্লাহ। আল্লাহর এ প্রতিদান ইহকাল-পরকালে স্পষ্টভাবে পাওয়া যাবে।
মহান আল্লাহ পাক আমাদের সবাইকে আওলাদে রাসূল ও আহলে বাইতকে ভালোবাসার তাওফিক দান করুন। আর আমরা সবাই যেন আহলে বাইতের অনুসরণ ও মোহাব্বত নিয়ে কবরে যেতে পারি। মহান আল্লাহ তায়ালা আমাদের সঠিক বোঝার ও আমল করার তাওফিক দান করুন। আমীন।

লেখক : ফখরুল ইসলাম নোমানী, ইসলামি চিন্তক ও গবেষক ।