বিস্ময়কর! হুবুহু মিলে গেল ৬০ বছর আগের সায়েন্স ফিকশনের ভবিষ্যদ্বাণী

মানুষ ভবিষ্যত দেখতে পায় না। তবে কল্পলোকের চোখে সেই ভবিষ্যতকে বিনির্মাণ করে। ভবিষ্যতে কি ঘটবে তা নিয়ে সাহিত্যের যে শাখা গড়ে উঠেছে তাকে বলা হয় কল্পবিজ্ঞান বা সায়েন্স ফিকশন। এসব উপন্যাস কালক্রমে তরুণ ও যুব সমাজের কাছে হয়েছে সুখপাঠ্য। তাদেরকে কল্পিত এক বিশ্বে নিয়ে গিয়েছে। যে বিশ্ব হয়তো অনাগত ভবিষ্যতে বর্ণিত উপন্যাসের মতোই হয়ে উঠতে পারে। এই যেমন মঙ্গলগ্রহে মানুষের বসবাস। অথবা ক্রোমিয়াম অরণ্যে মানুষের ছুটে চলা। তেমনই একটি কল্পকাহিনী জন ব্রুনারের লেখা ‘স্ট্যান্ড অন জাঞ্জিবার’। এই উপন্যাসটি নিয়ে একটি চমৎকার আলোচনা, পর্যালোচনা উপস্থাপন করেছেন ড. অলিভার টিয়ারল

১৯৬০ এর দশকের লেখা দুর্দান্ত এই বিজ্ঞান কল্পকাহিনী নিয়ে তিনি লিখেছেন- সবচেয়ে বেশি ভবিষ্যদ্বাণী করে এমন বইয়ের নাম কি মনে করতে পারেন? নস্ট্রাডামাসের নোটবুক? এ সপ্তাহের শুক্রবারে আমাকে আমার কলামের নাম দেয়া হয়েছে “The Secret Library: A Book-Lovers’ Journey through Curiosities of History” । আমি জুল ভার্নের ১৮৬৩ সালের উপন্যাস ‘প্যারিস ইন দ্য টুয়েন্টিথ সেঞ্চুরি’র পক্ষে। এ উপন্যাসটি একটি ভবিষ্যত বিশ্বের বর্ণনা করে। এতে বর্ণনা করা হয়েছে মানুষ অভ্যন্তরীণ প্রজ্বলন (ইন্টারনাল কম্বাসন) দ্বারা চালিত মোটরগাড়ি চালায়। চালকবিহীন ট্রেনে করে বাইরে বের হয় কাজে। তাদের ঘর বৈদ্যুতিক আলোয় আলোকিত হয়। তারা ফ্যাক্স মেশিন, টেলিফোন এবং কম্পিউটার ব্যবহার করে এবং লিফট এবং টেলিভিশন দিয়ে সজ্জিত আকাশচুম্বী ভবনে বাস করে। তারা ইলেকট্রিক চেয়ার ব্যবহার করে অপরাধীদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করে। গ্রীক এবং ল্যাতিন ভাষা এখন আর স্কুলে খুব বেশি পড়ানো হয় না। উল্টো ইংরেজি থেকে শব্দ ধার নিয়েছে ফরাসি ভাষা। এতে ভাষা ‘দুষিত’ হয়েছে। মানুষ বিশাল ডিপার্টমেন্টাল স্টোরগুলিতে কেনাকাটা করে এবং রাস্তাগুলি বৈদ্যুতিক আলোয় বিজ্ঞাপন শোভা পায়।
কিন্তু জুল ভার্নের উপন্যাসটি জন ব্রুনারের ‘স্ট্যান্ড অন জাঞ্জিবার’ (সায়েন্স ফিকশন মাস্টারওয়ার্কস)-এর প্রেক্ষাপটে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। জন ব্রুনারের এই বইটি এখন থেকে পঞ্চাশ বছর আগের। ১৯৬৮ সালে প্রকাশিত হয়েছিল। যাহোক, এ বইটিকে আলোচনায় আনা হয়েছিল ২০১০ সালে। স্ট্যান্ড অন জাঞ্জিবারে একুশ শতকের শুরুর দিকের অনেক কিছু সঠিকভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে, ২০১০ সালের মধ্যে বিশ্বের জনসংখ্যা ৭ বিলিয়ন ছাড়িয়ে যাবে। প্রকৃতপক্ষে, তার পূর্বাভাসে দেয়া সময় মাত্র এক বছর পেরিয়েছিল। আর ২০১১ সালের অক্টোবরেই তার পূর্বাভাস সত্য হয়েছিল। ব্রুনার আরও আগে থেকেই দেখতে পেয়েছিলেন যে, ইউরোপ একটি যৌথ ইউনিয়ন (অর্থাৎ ইইউ) গঠন করবে এবং চীন একটি প্রতিযোগিতামূলক বিশ্ব শক্তি হয়ে উঠবে।

এতে প্রেসিডেন্ট ওবোমি নামে একটি চরিত্র রয়েছে। এতে ইউরো, ইলেকট্রনিক মিউজিক, হোন্ডা গাড়ির ভবিষ্যদ্বাণী রয়েছে। সে সময়ে এসব ছিল মোটরবাইক প্রস্তুতকারক হিসাবে পরিচিত। স্ট্যান্ড অন জাঞ্জিবার প্রকাশিত হওয়ার এক বছর পরে প্রথম গাড়ি এসেছিল। তামাকের জনপ্রিয়তা হ্রাস, গাঁজাকে ডিক্রিমিনালাইজেশন করা, ডেট্রয়েট শহর জনশূন্য হয়ে পড়া, গ্লোবাল নিউজ চ্যানেল, টিভো বা স্কাই বক্স, ভিডিও ফোন কল, ভায়াগ্রা, লেজার প্রিন্টার এবং সমকামি বিবাহের বৈধতা নিয়েও এতে পূর্বাভাস দেয়া হয়েছে। মানুষজন নিজের উপর গুলি করার আগে উন্মাদের মতো বেপরোয়া গুলি চালাবে, বিশেষ করে আমেরিকান উচ্চ বিদ্যালয়গুলোতে এসবও বলা হয়েছিল। যদিও স্ট্যান্ড অন জাঞ্জিবার ঠিক ৯/১১ এর পূর্বাভাস দেয়নি, তবু ব্রুনার ২০১০ সালে সন্ত্রাসবাদ নিয়ে যে পূর্বাভাস দিয়েছিলেন তা যুক্তরাষ্ট্রে একটি প্রধান উদ্বেগের বিষয় হয়ে উঠেছে। যুক্তরাষ্ট্রের অনেক ভবনে বেশ কয়েকটি সন্ত্রাসী হামলা চালানো হয়েছে।

উপন্যাসটির মূল বিষয়বস্তু অতিরিক্ত জনসংখ্যা। ‘স্ট্যান্ড অন জাঞ্জিবার’ শিরোনামটি এর একটি ইঙ্গিত দেয়: বিংশ শতাব্দীর শুরুতে হিসাব করা হয়েছিল যে, বিশ্বের জনসংখ্যার প্রতিটি সদস্য কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ‘আইল অব ওয়েট’- এ অবস্থান করতে পারে। কিন্তু তখন থেকে জনসংখ্যা বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে, ব্রুনার অনুমান করেছিলেন যে, ২০১০-এর দশকে ৭০০ কোটি মানুষকে বসবাসের জন্য ভারত মহাসাগরের জাঞ্জিবারের মতো একটি ব-দ্বীপের প্রয়োজন হবে। গল্প বলা এবং বিশ্ব-নির্মাণের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করেছে বইটির কাহিনী। কিছু অধ্যায় ভবিষ্যত বিশ্ব সম্পর্কে বিভিন্ন ধরনের ভিন্ন পাঠ্য আকারে তথ্য সামান্য এড়িয়ে গেছে। যথার্থই ১৯৬৯ সালে হুগো পুরস্কার জিতেছে ব্রুনার। একে দেখা হয় কল্পবিজ্ঞানের শীর্ষ পুরস্কার হিসেবে। সায়েন্স ফিকশন মাস্টারওয়ার্ক সিরিজে এই উপন্যাসটি পুনঃমুদ্রিত হয়েছে। ফলে এটি এখনও প্রিন্ট সংস্করণে পাওয়া যায় এবং যৌক্তিক দামে তা পাওয়া যায়।

এসব বিষয় খুবই আকর্ষণীয়। কিন্তু বইটি কি কোনো অর্থে ভালো? স্ট্যান্ড ইন জাঞ্জিবার উপন্যাসটি সত্যিই কতটা ‘গ্রেট’ তা নিয়ে পাঠকরা বিভক্ত। কেউ কেউ একে খুব স্ব-সচেতনভাবে পরীক্ষামূলক এবং কল্পিত হিসেবে খুঁজে পেয়েছেন। অর্থাৎ ব্রুনার নিজেকে একটি বা দুটি সাহিত্য পুরস্কার পাওয়ার অভিপ্রায় নিয়ে বইটি লিখেছেন। আবার অন্য দলের পাঠকরা মনে করেন এটা কেবল একটি অপঠনযোগ্য উপন্যাস। কিন্তু তখন অনেকেই বিংশ শতাব্দীর অন্যতম সেরা উপন্যাস ‘ইউলিসিস’ সম্পর্কে একই কথা বলেন। আমার মতে স্ট্যান্ড অন জাঞ্জিবার অবশ্যই বিজ্ঞান-কল্পকাহিনী উপন্যাসগুলির মধ্যে মহৎ কর্মের একটি। এমনকি শতাব্দীর মহান উপন্যাসগুলির মধ্যে একটি । এটা একটা মাস্টারপিস। যদি এটি ডস পাসোসের কাছে বিজ্ঞান কল্পকাহিনীর উত্তর হয়, তবে এটি জয়েসের ‘ইউলিসিসের’ উত্তরও। এটি একটি সুবিশাল এবং বিস্তৃত উপন্যাস, যা এর অন্তর্গত ফর্ম এবং রীতিকে বিস্তৃত করে, প্রথাগত এবং আধুনিক উভয় ধরনের মিডিয়া, লেখা এবং যোগাযোগের বিভিন্ন প্রকারকে অন্তর্ভুক্ত করে এবং তারপর পুনর্নির্মাণ করে।

এটি এমন ভান করার জন্য নয় যে এটি কখনও কখনও একটি চ্যালেঞ্জিং পাঠ্য নয়। বিশেষ করে প্রথম কয়েকশ পৃষ্ঠা। কিন্তু আপনি ব্রুনারের অসাধারণভাবে প্রাণবন্তভাবে উপলব্ধি করা ভবিষ্যত জগতে যত বেশি নিজেকে নিমজ্জিত করবেন এবং ততই আপনি এই উপন্যাস পড়তে পড়তে এগিয়ে যাবেন, প্রধান চরিত্রগুলির সংগ্রামের সাথে জড়িত হবেন, বিশেষ করে দুই গৃহকর্মীর সাথে: যারা হলেন ডনাল্ড হোগান- যিনি একজন গোপন গুপ্তচর এবং নিজেকে স্নাতকোত্তর ছাত্র হিসাবে জাহির করছেন এবং অন্যজন হলেন নরম্যান নিব্লক হাউস- তিনি একজন ‘আফ্রাম’ বা আফ্রিকান-আমেরিকান মুসলিম। তিনি দ্রুত কর্পোরেট সিঁড়ি বেয়ে উঠে এসেছেন এবং যে বিশাল কর্পোরেশনের জন্য তিনি কাজ করেন তার ভাইস-প্রেসিডেন্ট। এসবই আপনাকে বিমোহিত করবে।

এক অর্থে, স্ট্যান্ড অন জাঞ্জিবার (সায়েন্স ফিকশন মাস্টারওয়ার্কস) আমাদের উভয় জগতের সেরা অনুভূতির স্বাদ দেয়। এতে আছে তরতাজা এবং নতুন শৈলীগত পরীক্ষা এবং প্রতিটি পৃষ্ঠায় আছে অ্যাকশনের বর্ণনা। কিন্তু পরের ঘটনার সঙ্গে পরিচিত হতে আপনাকে আগের ঘটনা সম্পর্কে ভালভাবে পরিচিত হতে হবে।