বেড়েই চলেছে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা

জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন কেন্দ্রের (পঙ্গু হাসপাতাল) জরুরি বিভাগের সামনে গতকাল রোববার বেলা আড়াইটার দিকে চিকিৎসার অপেক্ষায় ছিলেন ১৬ তরুণ। তাঁদের ১১ জনই মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় আহত। সবার বয়স ১৭ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে। তাঁরা কেউ ঈদের ছুটিতে, কেউ গত শনিবার, কেউবা গতকাল দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন।

পঙ্গু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, চলতি মে মাসের প্রথম সাত দিনে বিভিন্ন ধরনের দুর্ঘটনায় আহত ১ হাজার ৪৭৪ জন সেবা নিয়েছেন। এর মধ্যে ৬৫ থেকে ৭০ শতাংশই মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার শিকার। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় কেউ হাত বা পা ভাঙলে সুস্থ হতে ৩ থেকে ৯ মাস সময় লাগছে।

পঙ্গু হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক শফিকুল ইসলাম দেওয়ান বলেন, আহত হয়ে যাঁরা চিকিৎসা নিতে আসছেন, তাঁদের বড় অংশ মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার শিকার। আবার তাঁদের ৯০ শতাংশই তরুণ। মোটরসাইকেলের দুর্ঘটনায় রক্তক্ষরণ বেশি হয় এবং পায়ের হাড় বেশি ভাঙে।

রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম চার মাসে (জানুয়ারি-এপ্রিল) মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ৮৩০ জন। আর ২০১৯ সালে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মারা যান ৯৪৫ জন। ২০২০ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১ হাজার ৪৬৩ জনে। আর ২০২১ সালে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মারা যান ২ হাজার ২১৪ জন। ২০২১ সালে আগের বছরের চেয়ে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ৫০ শতাংশ ও এই দুর্ঘটনাগুলোতে মৃত্যু ৫১ শতাংশ বেড়েছে। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে ৭৫ শতাংশের বয়স ১৪ থেকে ৪৫ বছর।

গতকাল পঙ্গু হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, জরুরি অস্ত্রোপচারকক্ষের সামনের মেঝেতে সারি সারি রোগী, যাঁদের বেশির ভাগই মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় আহত। তাঁদের একজন কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচর থেকে চিকিৎসা নিতে আসা বরকতউল্লাহ। ১৯ বছরের এই তরুণের ডান পায়ের একাধিক জায়গা ভেঙেছে আর মাথায় আঘাত লেগেছে।

বরকতউল্লাহর ভাই হেমায়েতউল্লাহ বলেন, ১ মে রাতে মোটরসাইকেলের সঙ্গে পিকআপের সংঘর্ষ হয়। বরকতউল্লাহ মোটরসাইকেলে দুই বন্ধুকে নিয়ে ঘুরতে বের হয়েছিলেন। তাঁর পায়ে অস্ত্রোপচার হয়েছে। পায়ে রড লাগাতে হয়েছে।

সাভারের হেমায়েতপুরের বাসা থেকে গতকাল সকালে মিরপুরে নিজের অফিসে যাচ্ছিলেন শফিকুল ইসলাম। তিনি ভূমি নিবন্ধন অফিসের কম্পিউটার অপারেটর। মিরপুর বাঙলা কলেজের সামনে সিএনজিচালিত অটোরিকশার সঙ্গে শফিকুলের মোটরসাইকেলের সংঘর্ষ হয়। পঙ্গু হাসপাতালে কথা হয় তাঁর সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, অটোরিকশা ইউটার্ন নেওয়ার সময় সংঘর্ষ হয়। বাঁ হাত দুই জায়গায় ভেঙেছে। চিকিৎসক বলেছেন, অস্ত্রোপচার করাতে হবে। ছয় মাস লাগবে ঠিক হতে।

অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, মহাসড়ক, আঞ্চলিক সড়ক ও গ্রামীণ সড়কে মোটরসাইকেল চালানোর ক্ষেত্রে চালকেরা নিয়ম মানছেন না। চালক ও আরোহীরা হেলমেট পরেন না। এক মোটরসাইকেলে দুজনের বেশি না ওঠার নিয়মটিও মানা হয় না। জেলা-উপজেলা পর্যায়ে অনিবন্ধিত মোটরসাইকেলও অহরহ চলে। অনেকেরই মোটরসাইকেল চালানোর কোনো প্রশিক্ষণ থাকে না।

ঈদের দিন রাতে (৩ মে) ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদরে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় আহত হন তরুণ ব্যবসায়ী তানিম চৌধুরী। গতকাল দুপুরে তাঁকে পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি করান স্বজনেরা। তানিমের বাঁ হাতের কনুই ও কবজি ভেঙে গেছে। চিকিৎসকেরা বলেছেন, দুটি পৃথক অস্ত্রোপচার লাগবে। তানিম বলেন, ‘মোটরসাইকেল মোটামুটি ভালো গতিতে চলছিল। হঠাৎ সামনে মানুষ চলে আসে। ব্রেক করলে পড়ে যাই।’

দুর্ঘটনা বেড়ে যাওয়ার পেছনে মোটরসাইকেলের সহজলভ্যতাকে অন্যতম কারণ বলে মনে করেন সড়ক নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলো। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫ সাল পর্যন্ত দেশে নিবন্ধিত মোটরসাইকেল ছিল ১৫ লাখের কম। বর্তমানে নিবন্ধিত মোটরসাইকেলের সংখ্যা প্রায় ৩৬ লাখ। ২০১৬ সাল থেকে প্রতিবছর ৩ লাখের বেশি মোটরসাইকেল নিবন্ধিত হচ্ছে।বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) পরিচালক মো. হাদিউজ্জামান বলেন, নিবন্ধিত মোটরসাইকেল ছাড়াও জেলা শহর ও গ্রামীণ এলাকায় অনিবন্ধিত অন্তত ১৫ লাখ মোটরসাইকেল চলে। কোনো দেশ এভাবে মোটরসাইকেলকে সহজলভ্য করতে পারে না। গণপরিবহনকে গুরুত্ব না দেওয়ায় মোটরসাইকেল বিকল্প হয়ে উঠছে, এটি ভবিষ্যতে দুর্ঘটনা আরও বাড়াবে। মহাসড়কে যাত্রী নিয়ে মোটরসাইকেল চালানো সম্পূর্ণভাবে নিরুৎসাহিত করতে হবে। একই সঙ্গে মোটরসাইকেলচালকেরা যাতে মানসম্মত হেলমট ব্যবহার করেন এবং ট্রাফিক আইন মানেন, সেটি নিশ্চিত করতে হবে সরকারকে।