ভিয়েতনামে  ঈদ আনন্দ  

কাজী জাহাঙ্গীর:: সৌদি আরবের খবরে যখন দেখলাম ত্রিশ রোজা পালিত হবে এবার, নির্দিষ্ট ভাবে ধরে নিয়েছিলাম সোমবারেই ঈদ উদযাপন করবো, তাই চাঁদ রাতের হিসেব করে সন্ধ্যা হওয়ার আগেই পায়েশ আর মুরগী পোলাও রান্না বান্না সেরে যখন রিলাক্স হবো তখনই সাথে থাকা কলিগ ফোন করে বললেন এখনো কনফার্ম করা যায়নি ঈদ জামাত হবে কিনা, কেননা হো চো মিন সিটিতে রোজা শুরু হয়েছে বাংলাদেশের সাথে সুতরাং হানয় যদি সেটা ফলো করে তাহলে আমাদের রোজা হয়ে যাবে একত্রিশটা। তাই কাল আমারা হানয় যাচ্ছিনা, অন্য প্রভিন্সে থাকা আরোও কলিগরা বলেছে নিজেরা যে যেখানে আছে সেখানে থেকেই ঈদ করতে হবে। দুবছর পর সবাই একসাথে ঈদের জামাতে একত্রিত হওয়ার সম্ভাবনা এভাবেই চুপসে যাবে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না ।

ভিয়েতনামে মুসলিম কমিউনিটির যে সামান্য লোকজন আছেন, ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের পালনের জন্য তারা সৌদি আরবকে অনুসরণ করে থাকে। এছাড়া আরতো কোন উপায় নাই তাদের। জনসংখ্যার দশমিক এক শতাংশের নিচে যেখানে মুসলিম জনগোষ্ঠি সেখানে সরকারি কী ধরনের নির্দেশনা আছে সেটা যদিও আমাদের দৃষ্টিগোচরে আসেনি তবুও পূর্বের বছরগুলোতো স্থানীয় প্রসাশনের নির্দেশনায় হানয় ‍সিটির একমাত্র মসজিদ ’আল নুর মস্ক’ এর সামনের রাস্তায় যাতে যানজট না ঘটে সেজন্য রাস্তাটিকে নামাজ সময়কালিন একদিকে চলাচল করে দিয়ে মুসল্লীদের ক্ষুদ্র জমায়েতটাকে সাবলিল করার পদক্ষেপ চোখে পড়ার মতো দেখেছি। আশে পাশের মানুষদের সৌহার্দ্যও দেখেছি। মসজিদ রোডের মাথায় একটা মিষ্টি’র দোকানে প্রতিবছরই নামাজ শেষের ভিড়টা চোখের কোণে এখনও যেন হাতছানি দেয়। ভিয়েতনামিজ  সহকর্মীরা বলেই রাখে আমাদের জন্য কিছু না নিয়ে কিন্তু আসবেন না। তাই নামাজ শেষে সরাসরি কাজে যোগদিয়ে ভিয়েতনামিজ কলিগদের মাঝে মিষ্টি বিতরন করে যে একটা অপার আনন্দ পেতাম, দুবছর ধরে সেটা বন্ধ হয়ে আছে কভিড’১৯ এর জমায়েত নিষিদ্ধের সরকারি আদেশের কারণে। এসব স্মৃতি আওড়িয়ে যাচ্ছিল ত্রিশ রোজা শেষের সন্ধ্যার পরের সময়, দশটায় এশা’র নামাজ পড়ে শুতে যাওয়ার আগে হঠাৎ করে পেলাম আমার দু’রুম পরের রুমে থাকা কলিগের মেসেজ, কাল হানয় নামাজ হচ্ছে, খুব সকালে বের হতে হবে, সকাল সাতটা ‘ঈদ জামাত’।

ভিয়েতনাম তখনো সকালের নাস্তায় ব্যস্ত, ৬.৪৫টায় যখন আল নুর মজিদের রাস্তায় প্রবেশ করছি রাস্তার দু’ধারের দোকানগুলোর সামনে ফুটপাত লাগোয়া ফাঁকা জায়গায় ভিয়েতনামিজ লোকজন ছোট ছোট প্লাস্টিক পিড়িতে বসে তাদের সকালের নাস্তার ধুম চালাচ্ছেন। মসজিদটা পুরোনো হানয় সিটি এলাকায় , যেরকম আমরা বাংলাদেশে বলে থাকি ’পুরান ঢাকা’। তবে রাস্তা গুলো পুরোন ঢাকার মতো চিপা চাপা হলেও পরিচ্ছন্নতায় ঝকঝকে ভাবটায় ঈর্ষান্বিত হতেই হবে। ফুটপাতের দোকানগুলোতে পিড়িতে বসে নাস্তা খাওয়াটা এখানের ঐতিহ্য। যতবারই আসি চোখ জুড়িয়ে উপভোগ করি, কী নিশ্চিন্ত আপন মনে  নাস্তা সেরে নিচ্ছে যেন এই পুরোন শহরের বাসিন্দারা । আর এই সময়টাতেই ‍দুরদুরান্ত থেকে প্রবাসি মুসলিমরা এসে হাজির হয়ে গেছে ‍দু’বছর পর অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া ঈদ জামাতে অংশ নিতে। এক পরিসংখ্যানে দেখেছি এই মসজিদকে ঘিরে শ’খানেক মুসলিমের বাস। প্রবাসি বলতে কিছু কারখানা কর্মকর্তা আর বিভিন্ন মুসলিম দেশের দুতাবাসে পারিবার নিয়ে যেসব রাস্ট্রদুত  থাকেন তারা এবং তাদের কর্মচারী’রা। যাদের চোখে পড়েছে তারমধ্যে আফ্রিকান মুসলিম, ইরান, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, বাংলাদেশ এসব দেশের লোকজন এছাড়াও ‍কিছু বেড়াতে আসা মুসলিম পর্যটক।

একমাস রোজা পালন শেষে আল্লাহর দরবারে হাজারো শুকরিয়া জামাতে ঈদের নামাজ আদায় করতে পারলাম বলে, বছরে অন্তত একবার মসজিদে এসে ঈদের নামাজ আদায় করতে পারা এটাই আমাদের মতো প্রবাসিদের ঈদ আনন্দ।  ’আমাদের রোজা কবুল করে নাও আল্লাহ, সারা পৃথিবীর নির্যাতিত মজলুমদের মাঝে তুমি শান্তির সুবাতাস বইয়ে দাও’- এটাই যেন সকলের ফরিয়াদ আজ।

লেখক: কাজী জাহাঙ্গীর- প্রবাসী, লেখক ও সংগঠক