পবিত্র লাইলাতুল কদর হাজার মাস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ

যাবতীয় প্রশংসা কেবলই আল্লাহ তাআলার যিনি সমগ্র জগতের মালিক ও রব। আর সালাত ও সালাম নাযিল হোক আমাদের নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর, যিনি সমস্ত নবীগণের সরদার ও সর্বোচ্চ সম্মানের অধিকারী। আরও নাযিল হোক তার পরিবার-পরিজন ও সমগ্র সাথী-সঙ্গীদের ওপর।

মুসলিম উম্মাহর কাছে লাইলাতুল কদর অতিশয় মর্যাদাপূর্ণ একটি পবিত্র রজনী। পবিত্র কোরআনে এই রাতের গুরুত্ব তুলে ধরে সুরা কদর নামে একটি পূর্ণ সুরা নাজিল হয়েছে। তাতে এই মহিমান্বিত রাতকে হাজার মাসের চেয়েও উত্তম বলে ইরশাদ করা হয়েছে। এজন্য রাসূল (সা.)–রমজানের শেষ দশ দিন মসজিদে ইতেকাফে থাকতেন এবং ইবাদতে গভীর মনোনিবেশ করতেন। কোরআন এই রাতেই প্রথম নাজিল হয়েছিল। আল্লাহ তাআলা বলেন,‘নিশ্চয়ই আমি কোরআন নাজিল করেছি মাহাত্ম্যপূর্ণ রজনীতে।

 

বছরের সর্বশ্রেষ্ঠ বরকতময় রাত হলো শবে কদর। আরবি ভাষায় ‘লাইলাতুন’ শব্দের অর্থ রাত বা রজনী এবং ‘কদর’ শব্দের অর্থ সম্মানিত, মহিমান্বিত। এই দুটি শব্দ মিলিয়ে লাইলাতুল কদর অর্থ অত্যন্ত সম্মানিত বা মহিমান্বিত রজনী।‘লাইলাতুল কদর’ আরবি শব্দ। শবে কদর হলো লাইলাতুল কদরের ফারসি পরিভাষা। অর্থ সম্মানিত মর্যাদাপূর্ণ ও মহিমান্বিত, সম্ভাবনাময়, ভাগ্যনির্ধারণী রজনী।

 

পবিত্র কোরআন নাজিলের মাস রমজান মাস, কোরআন নাজিলের রাত শবে কদর। এ রাতেই প্রথম পবিত্র মক্কা মুকাররমার জাবালে রহমত তথা হেরা পর্বতের গুহায় আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের পক্ষ থেকে জিবরাইল (আ.)–এর মাধ্যমে প্রিয় নবী  (সা.)-এর প্রতি কোরআন কারিম অবতীর্ণের সূচনা হয়।

 

কোরআন নাজিলের মাস মাহে রমজানের শেষ ১০ দিনের বিজোড় রাতগুলোর কোনো একটিই এই পুণ্যময় লাইলাতুল কদর। তবে ওলামায়ে কেরাম মনে করেন, রমজান মাসের ২৬তম দিনের শেষের রাতটিই লাইলাতুল কদর হওয়ার সম্ভাবনা সর্বাধিক। সেই হিসাবে এই রাতটিকেই লাইলাতুল কদর ধরে ধর্মপ্রাণ মুসলিম নর-নারীরা সারা রাত নফল নামাজ, কোরআন তিলাওয়াত, জিকির আসকারে মগ্ন থাকেন। এই এক রাতে ইবাদতের বিনিময়ে হাজার মাসের ইবাদতের সওয়াবের চেয়েও বেশি সওয়াব পাওয়া যায়। তাই পবিত্র লাইলাতুল কদর হাজার মাস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ।

রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের মাস মাহে রমজান। প্রিয় নবী (সা.) বলেন,‘যে ব্যক্তি ইমানসহ সওয়াবের নিয়তে রমজানে রোজা পালন করে, তার পূর্বের গুনাহ মাফ করে দেওয়া হয়।’ ‘যে ব্যক্তি ইমানের সহিত সওয়াবের আশায় রমজানে রাত জেগে ইবাদত করে, তার পূর্বের গুনাহ মাফ করে দেওয়া হয়।’ ‘যে ব্যক্তি ইমানের সঙ্গে সওয়াবের আশায় কদরের রাতে জেগে ইবাদত করবে, তার অতীতের গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে।’ (বুখারি, প্রথম খন্ড, হাদিস : ৩৭, ৩৬, ও ৩৪)।

হাদিস শাস্ত্রে উল্লেখ রয়েছে, একদিন নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই ভেবে অস্থির হচ্ছিলেন যে, আগের নবীর উম্মতেরা দীর্ঘ হায়াত পেত। ফলে তারা অনেক বেশি ইবাদত-বন্দেগির সুযোগ পেত। কিন্তু শেষ নবীর উম্মতের হায়াত খুবই সীমিত। অতএব তাদের পক্ষে উচ্চমর্যাদা লাভের সুযোগ কম। তখন আল্লাহর পক্ষ থেকে সূরা কদর নিয়ে উপস্থিত হন হজরত জিবরাইল (আ.)। আল্লাহ তায়ালা এ রাতেই কুরআন নাজিল করেছেন বলে জানিয়ে দিয়েছেন। তেমনি এ রাতটির মর্যাদা হাজার মাসের চেয়ে উত্তম বলেও ঘোষণা করেছেন।

কিন্তু কদরের রাত কোনটি তা সুনির্দিষ্টভাবে বলে দেননি আল্লাহপাক। হাদিস শরিফেও নির্দিষ্ট করে বলা হয়নি কোনটি কদরের রাত। প্রিয় নবী  (সা.)-ইরশাদ করেন, তোমরা রমজানের শেষ দশকের বেজোড় রাতগুলোতে কদরের রাত অনুসন্ধান করবে।

 

লাইলাতুল কদরের গুরুত্ব ও ফজিলত :

পবিত্র কুরআন ও সহিহ্ হাদিস দ্বারা লাইলাতুল কদরের গুরুত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ‘শবেবরাত’ নিয়ে হাদিস বিশেষজ্ঞ ও ফকিহদের মধ্যে যে সংশয় রয়েছে-লাইলাতুল কদরের ব্যাপারে তার কোনো অবকাশ নেই। পবিত্র কুরআন, নির্ভরযোগ্য হাদিস এবং প্রিয় নবী  (সা.)-এর লাইলাতুল কদরের জন্য গ্রহীত কর্মতৎপরতা লাইলাতুল কদরের গুরুত্ব বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে।

এ সম্মানিত রজনীর গুরুত্ব সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন,”আমি এ (কুরআনকে) কদরের রাতে নাজিল করেছি। তুমি কি জানো, কদরের রাত কী? কদরের রাত হাজার মাস হতেও উত্তম-কল্যাণময়।” (আল কদর: ১-৩)

রমজানের ২১, ২৩, ২৫, ২৭ ও ২৯ তারিখের রাতগুলোই (অর্থাৎ ২০, ২২, ২৪, ২৬ ও ২৮ রোজার দিবাগত রাত) হলো শেষ দশকের বিজোড় রাত। এ রাতের আরেকটি গুরুত্ব হলো এ পবিত্র রাতেই কুরআন নাজিল হয়েছে। আর এ কুরআনের সাথেই মানুষের ভাগ্য জড়িয়ে আছে। তাহলে লাইলাতুল কদরের আ‌রেক‌টি অর্থ হয় ভাগ্য রজনী। যে মানুষ, যে সমাজ, যে জাতি, কুরআনকে বাস্তব জীবনবিধান হিসেবে গ্রহণ করবে, তারা পার্থিব জীবনে ও পরকালীন জীবনে সম্মানীত হবে। এ রাতে নাজিলকৃত কুরআনকে যারা অবহেলা করবে, তারা ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হবে। এ রাতেই মানবকল্যাণে আল্লাহ মানুষের জন্য চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত ফেরেশতাদের জানান। আল্লাহ বলেন–“এ রাতে প্রতিটি ব্যাপারে অত্যন্ত বিজ্ঞানসম্মত ও সুদৃঢ় ফায়সালা জারি করা হয়।”(সূরা দুখান : ৪) মহান আল্লাহ আরো বলেন-“ফেরেশতারা ও রূহ (জিব্রাইল আ:) এ রাতে তাদের রবের অনুমতিক্রমে সব হুকুম নিয়ে অবতীর্ণ হয়, সে রাত পুরোপুরি শান্তি ও নিরাপত্তার-ফজর উদয় হওয়া পর্যন্ত।”(আল-কদর : ৪-৫)

 

লাইলাতুল কদরের ফজিলত গুলো :

* এ রাতটি হাজার মাস থেকে উত্তম- কল্যাণময় (কুরআন)

* এ রাতেই পবিত্র কুরআন নাজিল করা হয়েছে। (কুরআন)

* এ রাতে ফেরেশতা নাজিল হয় এবং আবেদ বান্দাহদের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে।

*  ফজর পর্যন্ত এ রাতে পুরোপুরি শান্তি ও নিরাপত্তার (কুরআন)

* এ রাতে প্রতিটি ব্যাপারে অত্যন্ত বিজ্ঞানসম্মত ও সুদৃঢ় ফায়সালা জারি করা হয়।(কুরআন)

* এ রাতে ইবাদতে মশগুল বান্দাদের জন্য অবতরণকৃত ফেরেশতারা দোয়া করেন।(হাদিস)।

* গুনাহ মাফ :”যে ব্যক্তি লাইলাতুল কদরে ঈমান সহকারে ও আল্লাহর নিকট হতে বড় শুভফল লাভের আশায়   ইবাদতের জন্য দাঁড়িয়ে থাকবে, তার পেছনের সব গুনাহ মাফ হয়ে যাবে।”(বুখারি-মুসলিম)।

* এ রাতে কল্যাণ থেকে একমাত্র হতভাগ্য লোক ছাড়া আর কেউ বঞ্চিত হয় না।(ইবনে মাজাহ-মিশকাত)।

 

লাইলাতুল কদরে যেসব আমল করা যায় : নফল নামাজ-তাহিয়্যাতুল অজু, দুখুলিল মাসজিদ, আউওয়াবিন, তাহাজ্জুত, সালাতুত তাসবিহ, তাওবার নামাজ, সালাতুল হাজাত, সালাতুশ শোকর ও অন্যান্য নফল ইত্যাদি পড়া। নামাজে কিরাআত ও রুকু-সিজদা দীর্ঘ করা। কোরআন শরিফ: সুরা কদর, সুরা দুখান, সুরা মুজাম্মিল, সুরা মুদ্দাচ্ছির, ইয়া-সিন, সুরা ত-হা, সুরা আর রহমান ও অন্যান্য ফজিলতের সুরা তিলাওয়াত করা; দরুদ শরিফ বেশি বেশি পড়া; তাওবা ইস্তিগফার অধিক পরিমাণে করা ; দোয়া কালাম, তাসবিহ তাহলিল, জিকির আসকার ইত্যাদি করা; কবর জিয়ারত করা। নিজের জন্য, পিতামাতার জন্য, আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব ও সব মুমিন মুসলমানের জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করা এবং দেশ ও জাতির কল্যাণ ও সমৃদ্ধি এবং বিশ্ববাসীর মুক্তি কামনা করে দোয়া করা।

 

এই রাতে সূর্যাস্তের পর আল্লাহ তাআলা প্রথম আসমানে অবতরণ করে বান্দাদের ডেকে ডেকে বলেন, ‘কে আছ অসুস্থ আমার কাছে চাও আমি শেফা দান করব, কে আছ অভাবগ্রস্ত আমার কাছে চাও আমি প্রাচুর্য দান করব, কে আছ বিপদগ্রস্ত আমার কাছে চাও আমি বিপদমুক্ত করে দেব।’

 

লাইলাতুল কদর পাওয়ার জন্য নবীজি (সা.) শেষের ১০ দিন ইতিকাফ করতেন। হজরত আয়িশা (রা.) বলেন, ‘ওফাতের আগ পর্যন্ত প্রত্যেক রমজানের শেষের ১০ দিন প্রিয় নবী  (সা.)-ইতিকাফ করতেন।’ (বুখারি: ২৩২৬, মুসলিম: ১১৭২)। ‘কিন্তু তিনি যে বছর ওফাত পান, সে বছর ২০ দিন ইতিকাফ করেন।’ (বুখারি: ৪৯৯৮)। ‘রাসুল (সা.)–এর ওফাতের পরও তাঁর স্ত্রী গণ ইতিকাফ করতেন।’ (বুখারি: ২০২৬, তিরমিজি: ৭৯০)।

 

প্রিয় নবী (সা.)-রমজানের শেষ দশ দিন মসজিদে ইতেকাফে থাকতেন এবং ইবাদতে গভীর মনোনিবেশ করতেন। কাজেই আমরা কোনো একটা বিশেষ রাতকে নির্দিষ্ট না করে হাদিস অনুযায়ী অন্তত রমজানের শেষ দশ দিনের বিজোড় রাতগুলোতে লাইলাতুল কদরের সৌভাগ্য লাভের আশায় ইবাদতে মশগুল হই।

 

আমরা এতে অবহেলা করলে হাদিসের ভাষায় হতভাগ্য হিসেবে চিহ্নিত হব। প্রিয় নবী (সা.)-বলেন–“যে ব্যক্তি এ রাত থেকে বঞ্চিত হবে সে সমগ্র কল্যাণ ও বরকত হতে বঞ্চিত হবে এর কল্যাণ থেকে একমাত্র হতভাগ্য লোক ছাড়া আর কেউ বঞ্চিত হয় না।”(মিশকাত) সকলকে  প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর প্রতি বেশি বেশি দরুদ ও সালাম পাঠানোর তৌফিক দিন। সকলেই পড়ি,‘আল্লাহুম্মা সাল্লে আলা সাইয়েদিনা মুহাম্মদ,ওয়ালা আলেহি ওয়া আসহাবিহি ওয়া সাল্লাম।

 

পরিশেষে, মহান রাব্বুল আলামীনের নিকট প্রার্থনা, তিনি যেন আমাদেরকে এ পুণ্যময় ও মহিমান্বিত রজনী নসীব করেন, ইহার সকল কল্যাণ ও বরকত দান করেন এবং যে কুরআনের বদৌলতে এ মাস ও রাত্রি এত মর্যাদাশীল সে কুরআন পড়ার, বুঝার ও সে অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করার তাওফিক দান করেন।

 

লেখক :

ফখরুল ইসলাম নোমানী

লেখক, গবেষক ও ইসলামী চিন্তাবিদ