রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের মাস মাহে রমজান

যাবতীয় প্রশংসা কেবলই আল্লাহ তাআলার যিনি সমগ্র জগতের মালিক ও রব। আর সালাত ও সালাম নাযিল হোক আমাদের নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর, যিনি সমস্ত নবীগণের সরদার ও সর্বোচ্চ সম্মানের অধিকারী। আরও নাযিল হোক তার পরিবার-পরিজন ও সমগ্র সাথী-সঙ্গীদের ওপর ।
রজব ও শাবান দুই মাসব্যাপী আমরা দোয়া করে আসছি, ‘হে আল্লাহ, রজব ও শাবান মাস আমাদের জন্য বরকতময় করুন এবং রমজান আমাদের নসিব করুন! এই প্রার্থনা কবুল হলো। তাই সবাই বলছি ‘খোশ আমদেদ মাহে রমজান। আহলান সাহলান মাহে রমজান। মুসলমানদের হৃদয়ে আনন্দের হিল্লোল বয়ে যাচ্ছে। কারণ বছর ঘুরে আবার যে এসেছে মাহে রমজান।
রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের সুসংবাদ নিয়ে এল মাহে রমজান। প্রিয় নবী (সা.) বলেন,‘যে ব্যক্তি ইমানসহ সওয়াবের নিয়তে রমজানে রোজা পালন করে, তার পূর্বের গুনাহ মাফ করে দেওয়া হয়।’ ‘যে ব্যক্তি ইমানের সহিত সওয়াবের আশায় রমজানে রাত জেগে ইবাদত করে, তার পূর্বের গুনাহ মাফ করে দেওয়া হয়।’ ‘যে ব্যক্তি ইমানের সঙ্গে সওয়াবের আশায় কদরের রাতে জেগে ইবাদত করবে, তার অতীতের গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে।’ (বুখারি, প্রথম খন্ড, হাদিস : ৩৭, ৩৬, ও ৩৪)।
রমজান মাসে একটি ফরজ, পূর্ণ এক মাস রোজা পালন করা। রমজানের সঙ্গে সম্পূর্ণ দুটি ওয়াজিব, যথা : সদকাতুল ফিতরা প্রদান করা এবং ঈদের নামাজ আদায় করা। রমজানের বিশেষ সুন্নাতগুলো হলো রজব মাস ও শাবান মাস বরকতের জন্য এবং রমজান প্রাপ্তির জন্য দোয়া করতে থাকা ; রজব ও শাবান মাস থেকে রমজানের প্রস্তুতি গ্রহণ করা, রজব ও শাবান মাসে অধিক পরিমাণে নফল রোজা রাখা ও নফল নামাজ আদায় করা, শাবান মাসের চাঁদের তারিখের হিসাব রাখা ; রমজানের চাঁদ দেখা ; সাহারি খাওয়া, তাহাজ্জত নামাজ আদায় করা, ইফতার করা ও করানো, ২০ রাকাত তারাবিহ নামাজ আদায় করা, কোরআন কারিম বেশি বেশি তিলাওয়াত করা এবং ইতিকাফ করা ; রমজানের শেষ দশকের বিজোড় রাতগুলোয় শবে কদর সন্ধান করা এবং ঈদের জন্য শাওয়াল মাসের চাঁদ দেখা।
‘রমজান হলো আমার উম্মতের মাস’, বলেছেন প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। তিনি আরো বলেন, ‘রজব আল্লাহর মাস, শাবান আমার মাস আর রমজান আমার উম্মতের মাস।’ মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এই হাদিসের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, রজব মাস জমি চাষ করার, শাবান মাস বীজ বপন করার এবং রমজান মাসে ফল লাভ করার অফুরন্ত নেয়ামত পাওয়া যায়।
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘জান্নাতে রায়্যান নামক একটি দরজা আছে। এ দরজা দিয়ে কিয়ামতের দিন শুধু রোজাদারেরাই প্রবেশ করবে। তাদের প্রবেশের পরে এই দরজাটি বন্ধ করে দেওয়া হবে। তারা ছাড়া আর কেউ এই দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না।’ (বুখারি, খন্ড : ৩, হাদিস: ১,৭৭৫)
রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের সওগাত নিয়ে এল মাহে রমাদান। প্রিয় নবী (সা.) বলেন : রমাদানের প্রথম অংশ রহমত বা দয়া করুণা, মধ্যের অংশ মাগফিরাত বা ক্ষমা, শেষাংশ নাজাত বা মুক্তি। (বায়হাকি)
প্রথম দশকে আল্লাহ তাআলা তাঁর বান্দাকে রহমতের বারিধারা বর্ষণ করে মাগফিরাত তথা ক্ষমার উপযোগী করেন। দ্বিতীয় দশকে ক্ষমা করে তৃতীয় দশকে বান্দার জন্য নাজাতের ফয়সালা করেন। রোজাদারদের জন্যে দু’টি আনন্দ রয়েছে। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেছেন ‘রোজাদারদের জন্য আনন্দের সময় হলো দু’টি। ১. যখন সে ইফতার করে তখন সে ইফতারের আনন্দ পায়। ২. যখন সে তার প্রতিপালকের সঙ্গে মিলিত হবে, তখন তার রোজার কারণে আনন্দিত হবে।’ (আল-বোখারি : ১৯০৪)।
রমাদান মাসে প্রতিটি নেক আমলের ফজিলত সত্তর গুণ বৃদ্ধি করে দেওয়া হয়। একেকটি নফল ইবাদতের সওয়াব বা বিনিময় ফরজ ইবাদতের সমান দান করা হয়। তাই রমাদানে কোরআন পড়ুন, কোরআন বুঝুন, কোরআনের মতো জীবন গড়ুন।
রমাদানের পবিত্রতা রক্ষা করুন। রমাদানে ইবাদতের পরিবেশ বজায় রাখুন। রমাদানের ফরজ, ওয়াজিব ও সুন্নতসমূহ পালন করুন। দুনিয়ার শান্তি ও পরকালের মুক্তি নিশ্চিত করুন। হাদিসে কুদসিতে আল্লাহ তাআলা বলেন : রোজা আমারই জন্য, আমিই এর বিনিময় প্রতিদান দেব। (বুখারি, খন্ড : ২, পৃষ্ঠা: ২২৬)।
রহমতের বারিতে স্নাত হয়ে, ক্ষমার মহিমায় উজ্জীবিত নব জীবন লাভ করে, নাজাত বা অনন্ত মুক্তির নতুন দিগন্তের জান্নাতি আহ্বানে অফুরান কল্যাণের পথে অভিযাত্রার সুবর্ণ সুযোগ মাহে রমাদান।
চন্দ্রবর্ষ গণনায় ৩৬৫ দিনের মধ্যে রমজানের দিনগুলো হচ্ছে শ্রেষ্ঠ। এই মাস কল্যাণময়। এই মাস কোরআন নাজিলের মাস। রহমত-বরকত, মাগফিরাত ও নাজাতের মাস। এই মাস তাকওয়া ও সংযম প্রশিক্ষণের মাস। এই মাস সবরের মাস। এই মাস জীবনকে সব পাপ-পঙ্কিলতা থেকে মুক্তি দেয়। এই মাস আল্লাহর নৈকট্য ও রেজামন্দি অর্জনের মাস। আল্লাহপাক পবিত্র কালামে ঘোষণা করেন, রমজান মাসে মানুষের দিশারি, সৎপথের স্পষ্ট নিদর্শন সত্যাসত্যের পার্থক্যকারীরূপে আল-কোরআন নাজিল হয়েছে।
পবিত্র মাহে রমজান মুমিন বান্দাদের জন্য প্রশিক্ষণের মাস। দীর্ঘ এক মাস সিয়াম সাধনার দ্বারা তাকওয়া অর্জনের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে বাকি ১১ মাস আল্লাহর বিধিবিধান পালনের মাধ্যমে জীবন পরিচালনার জন্য আল্লাহ পবিত্র রমজানের রোজা ফরজ করেছেন।
মূলত রমজান হলো ইবাদতের বসন্ত ঋতু। তাই এ মাসে যথাসম্ভব বেশি বেশি নেক আমল করতে হবে। নিজেকে সঁপে দিতে হবে মহান আল্লাহর দরবারে। তাওবা ও পাপমুক্তির প্রতি খুবই মনোযোগী হতে হবে। সর্বোপরি তাকওয়া অর্জনের মাধ্যমে নিজের জীবনকে ঢেলে সাজাতে হবে। মোবারক হো মাহে রমজান।
অতএব, রমজান মাসের প্রতিটি মুহূর্ত মহামুল্যবান। দিন ও রাতের প্রতিটি ক্ষণ রোজা, নামাজ, তেলাওয়াত, জিকির, তাসবিহ, তাহলিলে পরিপূর্ণভাবে রমজানকে উদযাপন করাই প্রতিটি মুসলিম নর-নারীর একান্ত কর্তব্য। ফরজ, ওয়াজিবের পাশাপশি সুন্নত আমলসমূহের অনুসরণ করে মাহে রমজানের প্রতিটি মুহূর্তকে সফল করা বিশ্বাসী মুসলমানদের লক্ষ্য হওয়া উচিত।
মাহে রমজানে সমাজের স্থিতিশীলতা, শান্তি, সম্প্রীতি ও নিরাপত্তার সুদূরপ্রসারী প্রভাব বিদ্যমান। সমাজের প্রত্যেক ধর্মপ্রাণ মানুষ যদি মাহে রমজানের মতো অন্যান্য মাসেও আত্মসংযমের সঙ্গে জাতি-ধর্ম-বর্ণ ও দলমতনির্বিশেষে সব ধরনের বিরোধ এড়িয়ে যান, তাহলে কোনো রকম সামাজিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয় না। তাই সমাজজীবনে পরস্পরের প্রতি সাহায্য-সহযোগিতা, সহানুভূতি ও সহমর্মিতা প্রদর্শনের ক্ষেত্রে এবং সাম্য, মৈত্রী, ঐক্য ও ভ্রাতৃত্ব বন্ধনের ক্ষেত্রে রোজার ভূমিকা অনস্বীকার্য। মাসব্যাপী রোজাদার ধনী লোকেরা গরিবের দুঃখ-কষ্ট এবং অনাহারের জ্বালা মর্মে মর্মে অনুভব করে স্বভাবতই সমাজের অসহায়, হতদরিদ্র ও দুস্থদের প্রতি অত্যন্ত সদয় আচরণ করেন। এ ছাড়াা, সারা বছরই হতদরিদ্র ও আর্তমানবতার প্রতি সমবেদনা, সহানুভূতি ও সহমর্মিতা প্রকাশ মাহে রমজানের মহান শিক্ষা।
মহান আল্লাহর একটি বাণীর উল্লেখপূর্বক এখানে বিশেষভাবে বলতে চাই,’রাব্বানা আতিনা ফিদ্দুন্য়া হাসানা ওয়াফিল আখিরাতি হাসানাতাও ওয়াকিনা আযাবান্নার’ অর্থাৎ হে রব! আমাদেরকে ইহকালীন ও পারলৌকিক উভয় জীবনে কল্যাণ দান করুন এবং দোজখের আজাব থেকে রক্ষা করুন। আল্লাহতায়ালা আমাদের পরকালীন জীবনে সাফল্য লাভ ও জাহান্নামের শাস্তি থেকে মওকুফের প্রার্থনার পাশাপাশি পৃথিবীর যাবতীয় অকল্যাণ ও অসহনীয় বিষয় থেকেও পরিত্রাণের তরে তার নিকট মিনতি করতে নির্দেশনা দিয়েছেন। উল্লিখিত বাণীর আলোকে আমরা পৃথিবীজুড়ে চলমান করোনা মহামারি থেকে মুক্তির নিমিত্তে এই পবিত্র রমজানের রহমত-বরকত, মাগফিরাত ও নাজাতের মাসে মহান স্রষ্টার নিকট প্রার্থনা করি; তিনি যেন আমাদের রক্ষা করেন। সকলকে প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর প্রতি বেশি বেশি দরুদ ও সালাম পাঠানোর তৌফিক দিন। সকলেই পড়ি,‘আল্লাহুম্মা সাল্লে আলা সাইয়েদিনা মুহাম্মদ, ওয়ালা আলেহি ওয়া আসহাবিহি ওয়া সাল্লাম।
লেখক :
ফখরুল ইসলাম নোমানী
হেড অব ফাইন্যান্স এন্ড একাউন্টস
এপিক হেলথ কেয়ার লিমিটেড