ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন ও সমসাময়িক ভাবনা

লায়ন মোঃ আবু ছালেহ্::
যৎসামান্য এই বয়সে যতটুকু উপলব্ধি করতে পেরেছি স্থানীয় সরকার নির্বাচনে পরিবার কেন্দ্রিক এবং বন্ধু বান্ধব প্রীতি আবেগ জড়ানো থাকে। তাই যখন এটি দলীয় প্রতীক বিহীন ছিল তখন মানুষ যেভাবে নির্বাচনকে উৎফুল্ল নিয়ে কাছে টেনেছে এখন আর সেভাবে টানেনা। কারণ একটাই কে কার বিরুদ্ধে যাবে? বাপ চাচা ভাই বেরাদর এরাইতো প্রার্থী। এদের মধ্যে বিবাদটা এখন এই প্রতীক বহন করে। ঘরোয়া সে জৌলস আর নেই। হানাহানি, হতাহতের খবর অহরহ অথচ দল বলতে এখন আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার স্বাধীনতার স্বপক্ষের শক্তি তারাই এখানে মূখ্য পদপ্রার্থী। অথচ দলীয় প্রার্থী নির্ধারণের পরেও অনেকে হেরে যায় স্বতন্ত্র প্রার্থীর কাছে। তাহলে দল যাকে নির্বাচন করেছে সেকি অযোগ্য ছিল? আসলে তা নয়। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে পরিবার ও সমাজ বলে একটা বিষয় সামনে এসে যায়। আর একারণেই সেখানে দলীয় বোধটা কম অনুভূত হয়। ফলশ্রুতি কিছু মানুষ মনে করে হয়ত তারা দলের বিরুদ্ধে কাজ করেছে। এর ফলে একটা দ্বিধা বিভক্তি কাজ করে। প্রতীক থাকা না থাকা প্রার্থীর পক্ষে বা বিপক্ষে নির্ভর করেনা। সামাজিক উন্নয়নের সাথে জড়িত ও একজন সুনাগরিককে নির্বাচন করাই স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ভোটাররা চান। তাহলে মানুষের চাহিদার প্রতিফলনে বাঁধা কি প্রতীক? বাংলাদেশে তিন স্তর বিশিষ্ট স্থানীয় সরকার বিদ্যমান। প্রথম স্তরের প্রশাসনিক একক বিভাগীয় পর্যায়ে কোনো স্থানীয় সরকার নেই। দ্বিতীয় স্তরের প্রশাসনিক একক জেলা পর্যায়ে জেলা পরিষদ, উপজেলা পর্যায়ে উপজেলা পরিষদ এবং গ্রাম পর্যায়ে ইউনিয়ন পরিষদ, ছোট শহরে পৌরসভা আর বড় শহরে সিটি কর্পোরেশন হলো স্থানীয় সরকারের একটি অংশ। কৈশোরে গ্রাম সরকারের মাধ্যমেই আমাদের কাছে ‘স্থানীয় সরকার’ শব্দদ্বয় পরিচিতি লাভ করে। ১৯৮০ সালে জেনারেল জিয়া ‘স্থানীয় সরকার অধ্যাদেশ ১৯৭৬’ সংশোধনের মাধ্যমে গ্রাম সরকার প্রতিষ্ঠা করেন। তখন দুষ্টলোকেরা জেনারেল জিয়ার গ্রাম সরকারকে গোপনে ‘গরম সরকার’ বলে ডাকত। গ্রামীণ যত টাউট-বাটপার-মাস্তান-গুন্ডা ছিল, সবার মিলন ক্ষেত্রে পরিণত হয় গ্রাম সরকার। ইউনিয়ন পরিষদেও তাদের দৌরাত্ম্য ছিল সীমাহীন। জেনারেল জিয়া গত হলে গ্রাম সরকারও বিদায় নেয়। ১৯৮৩ অথবা ১৯৮৪ সনে স্থানীয় সরকার নির্বাচন হয়। তখন দেখতাম, উৎসবমুখর ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন সহিংস, রক্তাক্ত নির্বাচনে রূপ নিতে। তিনজন মিলে ব্যালট বাক্স পূর্ণ করে। একজন সিল মারে, একজন ছিঁড়ে, অন্যজন ব্যালট পেপার ভাঁজ করে বাক্স ভর্তি করে। বাকীরা কেন্দ্র পাহারা দেয়। বুথ দখল, কেন্দ্র দখল, অস্ত্রের মহড়া সবই দেখতাম। ছাত্র নামধারী মাস্তানরা এক ইউনিয়ন থেকে অন্য ইউনিয়নে ভাড়া খাটছে। বেশিরভাগই ছিল এরশাদের অনুসারী। মাস্তান-গুন্ডা-পান্ডাদের সুবিধার্থে নাকি তখন ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল কয়েক ধাপে। ১৯৮২ সালে এরশাদ স্থানীয় সরকার অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে উপজেলা পরিষদ গঠন করেন। একইভাবে রক্তস্নাত সহিংসতার পথ অনুসরণ করে উপজেলা পরিষদ নির্বাচন হয়। নির্বাচনী সহিংসতা তখন নানা মাত্রা লাভ করে। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন অনেকাংশে সহিংসতা মুক্ত হয় নব্বইতে এসে এরশাদের পতনের পর। সারাদেশে আবার উৎসবমুখর পরিবেশে একযোগে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো। আবারও চায়ের দোকানে ঝড় তুলতে শুরু করে পত্রিকায় প্রকাশিত-‘দেবর-ভাবীর নির্বাচন’, ‘স্বামী-স্ত্রীর নির্বাচন’, ‘শাশুড়ি-বউয়ের নির্বাচন’ ইত্যাদি নানান সব মুখরোচক সংবাদ। স্থানীয় সরকার নির্বাচন উন্মুক্তভাবে হওয়ার ধারা ভেঙে আওয়ামী লীগ সরকার দলীয় প্রতীকে সম্পন্ন করার সিদ্ধান্ত নেয়। এলক্ষ্যে ২০১৫ সালে ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, পৌরসভা ও সিটি করপোরেশন-সংক্রান্ত পাঁচটি আইন সংশোধন করে। ২০১৫ সালের আগে পর্যন্ত ‘স্থানীয় সরকার’ নির্বাচন দলীয় প্রতীকবিহীন হলেও রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা তখনও ছিল। রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা ছিল নেপথ্যে। দলীয় ছায়া ছিল। নির্দলীয় নামে দলীয় নির্বাচন। রাজনৈতিক নেতারা নির্বাচন করতেন নিজস্ব ইচ্ছেয়। দলের অনুমতির প্রয়োজন হতো না। কেন্দ্রিয়ভাবে দল নিরপেক্ষ থাকলেও স্থানীয়ভাবে দলীয় নেতারা বিভিন্ন প্রার্থীর জন্য নির্বাচনী প্রচারে অংশ নিতেন। তখন ছিল ব্যক্তির প্রাধান্য। ভোটার ভোট দিয়েছে প্রার্থী দেখে, প্রতীক দেখে নয়। রাজনৈতিক দলসমূহের এধরনের লুকোচুরি খেলা অগ্রহণযোগ্য।
দলীয়ভাবে স্থানীয় সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠানের সুফল বহুবিধ। এর ফলে, তৃণমূল পর্যন্ত নেতৃত্বের বিকাশ ঘটবে। তৃণমূলের নেতারাও দলীয় এজেন্ডা বাস্তবায়নে কাজ করবে। এর ফলে আগের চেয়ে বাধ্যবাধকতা বাড়বে। দলগুলো কোনোভাবেই দায় এড়াতে পারবে না। এতে গণতন্ত্র শক্তিশালী হবে। জাতীয় নির্বাচনের মতো এসব ক্ষেত্রেও পূর্ণাঙ্গ নির্বাচনী আমেজ আসবে। কিন্তু আজ দেখছি, একটি ভালো উদ্যোগ নিয়ন্ত্রহীণতার কারণে বুমেরাং হয়ে গেল। দলীয় প্রতীকে স্থানীয় সরকার নির্বাচন ব্যবস্থার কারণে তৃণমূল পর্যন্ত মনোনয়ন বাণিজ্য আর সহিংসতা পৌঁছে গেছে। পুরো প্রক্রিয়াটি কলুষিত হয়ে গেছে। এবারের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের সহিংসতা, দুর্বৃত্তায়ন অতীতের সব দৃষ্টান্তকে ছাড়িয়ে গেছে। কোনো ধরনের নিয়ন্ত্রণ নেই। কেউ দলীয় কোনো নির্দেশনা মানছে না। আজ বাংলাদেশের রাজনীতি দুর্বৃত্তদের লুটপাটের সিন্ডিকেটে যে পরিণত হয়েছে, তার বহিঃপ্রকাশ ঘটছে চলমান ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে। দল হিসাবে আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছে। এসব কারণে সরকারের সমর্থক একটি অংশের ভেতরেও সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা তৈরি হচ্ছে। আজকের রাজনীতিতে মেধার চর্চা নেই, ত্যাগীদের মূল্যায়ন নেই। দুর্বৃত্তায়নের মহোৎসব চলছে। নৈতিকতা ও মূল্যবোধের সংকট চলছে তীব্রভাবে। দল হিসেবে এবং সরকার হিসাবে আওয়ামী লীগ তা ঠেকাতে ব্যর্থ হচ্ছে। ফলে আস্থার সংকট সৃষ্টি হচ্ছে। এখন ধরেই নেওয়া হচ্ছে, সরকারি দলের টিকিটে যিনি নির্বাচনে অংশ নেবেন, তিনিই জিতবেন। ফলে ভোটার ও সম্ভাব্য প্রার্থীদের মধ্যে ভোট প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণে অনাগ্রহ তৈরি হয়েছে।এটা গণতন্ত্রের জন্য অশনি সংকেত। মানুষ নির্বাচন বিমুখ হয়ে পড়ছে। বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ীর সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে। ফলে নির্বাচনী সংস্কৃতি ধ্বংস হতে চলেছে। এতে অনেক ক্ষতি হচ্ছে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে সমাজে। এটা মেনে নেওয়ার মতো না। এজন্য দলীয়ভাবে স্থানীয় সরকার নির্বাচনকেও দায়ী করা যায় না।
অনেক দেশে স্থানীয় সরকার নির্বাচন দলীয়ভাবে হয়। তাই ভাববার দরকার আছে। যেসব দেশে হয়, তাদের অভিজ্ঞতা জানতে হবে। স্থানীয় সরকার নির্বাচন আবার নির্দলীয় করার কথা ভাবলে ভুল হবে। দলীয় বাধ্যবাধকতা না থাকলে সহিংসতা, দুর্বৃত্তায়নের মাত্রা আরও বাড়বে। শুধু ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন নয়, আওয়ামীলীগকে গণতান্ত্রিক দল হিসাবে ভাবতে হবে সামষ্টিক দায়বদ্ধতা থেকে সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ে। গণতন্ত্রের ভিত্তিকে সুসংহত করতে, তৃণমূল পর্যন্ত গণতন্ত্রের চর্চাকে নিরঙ্কুশ করতে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির বিকাশকে তরান্বিত করতে হবে। দলীয়ভাবে স্থানীয় সরকার নির্বাচন এই বিকাশের অংশ মাত্র। মাথা ব্যথা হলে মাথা কেটে ফেলার প্রাচীন নীতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। গণতান্ত্রিক সরকার হিসাবে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির পক্ষে সরকারের অবস্থানকে আরও স্পষ্ট করতে হবে। গণজাগরণ তৈরি করতে হবে।
লেখকঃ গণমাধ্যমকর্মী ও সংগঠক