নির্বাচনে সহিংসতায় বিজিবি সদস্যসহ প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত ৯ জন

গতকাল অনুষ্ঠিত তৃতীয় ধাপের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে সহিংসতায় বিজিবি সদস্যসহ প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত ৯ জন। এর মধ্যে ভোটের আগের রাতে আধিপত্য বিস্তার ও কেন্দ্র দখলের লড়াইয়ে প্রতিপক্ষের হামলায় নিহত হয়েছেন অন্তত ২ জন। ভোটের দিন বিকালে ও সন্ধ্যা রাতে ব্যালট বাক্স ছিনতাইয়ের সময় সংঘর্ষ ও গুলিতে প্রাণ গেছে আরও সাতজনের। এর মধ্যে নরসিংদীর রায়পুরায় ২ জন, ঠাকুরগাঁওয়ের পীরগঞ্জে ৩ জন, নীলফামারীর কিশোরগঞ্জে বিজিবি সদস্য, লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জে ১ জন রয়েছেন। এছাড়া ভোটের আগের রাতে সহিংসতায় খুলনার তেরখাদায় ১ জন ও যশোরের শার্শায় ১ জন মারা যান।
বিস্তারিত আমাদের প্রতিনিধিদের পাঠানো রিপোর্টে-
নরসিংদী প্রতিনিধি জানান, নরসিংদীর রায়পুরায় পুলিশের গাড়িতে হামলা করে ব্যালট বাক্স ছিনতাইয়ের চেষ্টাকালে গুলিবিদ্ধ হয়ে ২ জন নিহত হয়েছেন। এসময় ৩ পুলিশ সদস্যসহ আরও ২২ জন আহত হয়েছেন। রোববার (২৮ নভেম্বর) সন্ধ্যা ৭টার দিকে রায়পুরা উপজেলার চান্দেরকান্দি ও উত্তর বাঘারনগর ইউনিয়নে এ ঘটনা ঘটে।
নিহত ব্যক্তির নাম আরিফ (৩২) ও উত্তর বাখরনগরে ফরিদ মিয়া (৩২)।

আরিফ শিবপুর যোশর জাঙ্গারটেক গ্রামের মৃত চান মিয়ার ছেলে। পেশায় তিনি সিএনজিচালক ছিলেন।

 

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, উপজেলার চান্দেরকান্দি ইউনিয়নের দাইরের পার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোট গণনার পর ৮ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বারপ্রার্থী আব্দুল ওহাবের পরাজিত হওয়ার পর তার ছেলে অর্ধশতাধিক লোক দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে পুলিশের গাড়িতে হামলা চালান। তখন পুলিশ সদস্য শাহিনুর ইসলাম সরকারি মালামাল ও ব্যালট বক্স রক্ষায় পরপর ১৬ রাউন্ড ফাঁকা গুলি বর্ষণ করেন। এসময় ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও এলোপাতাড়ি গুলিতে পুলিশের রিকুইজিশন করা সিএনজিচালক আরিফ নিহত হন। পরে গ্রামবাসীরা পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়লে পুলিশ সদস্য শহিনুর ইসলাম ও এক আনসার সদস্যসহ অতন্ত ১০ জন আহত হন।

 

নরসিংদীর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) সাহেব আলী পাঠান বলেন, হট্টগোলের খবর পেয়েছি। আমার বিষয়টি খোঁজ নিচ্ছি। তবে নিহতের বিষয়ে এখনও কিছু জানি না।
এদিকে উপজেলার উত্তর বাখরনগরে ইউপিতে নির্বাচনী সহিংসতায় ফরিদ মিয়া (৩২) নামের একজন গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হয়েছেন। আজ রোববার রাত সাড়ে ৯টার দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাঁর মৃত্যু হয়।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, উত্তর বাখরনগর ইউপির ৫ নং ওয়ার্ডে সদস্য পদে ভোট গণনা নিয়ে রোববার সন্ধ্যার দিকে দুই প্রার্থীর কথা কাটাকাটি ও হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। এ সময় দুই পক্ষের সমর্থকরা উত্তেজিত হয়ে ব্যালট বাক্স ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। পরে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ বেধে গেলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ গুলি ছোড়ে। এরপরই রক্তাক্ত অবস্থায় গুলিবিদ্ধ ফরিদ মিয়াকে উদ্ধার করে রায়পুরা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হয়।

 

রায়পুরা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা আবু সাইদ মোহাম্মদ ফারুক খান জানান, ফরিদকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে অ্যাম্বুলেন্সে করেই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছিল। অ্যাম্বুলেন্সচালক জহির মিয়া তাকে মুঠোফোনে ফরিদের মৃত্যুর বিষয়টি জানিয়েছে। তার লাশ নরসিংদী সদর হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হচ্ছে। এই ঘটনায় ২ পুলিশ সদস্যসহ অন্তত ১২ জন আহত হয়েছেন।

 

এদিকে নীলফামারী প্রতিনিধি জানান, নীলফামারী জেলার কিশোরগঞ্জ উপজেলার গাড়াগ্রাম ইউনিয়নের একটি ভোটকেন্দ্রে দুই গ্রুপের সংঘর্ষে মো. রুবেল (৩৫) নামে বিজিবির এক সদস্য নিহত হয়েছেন। রোববার রাতে ভোট গণনাকালে এ ঘটনা ঘটে।
কিশোরগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আব্দুল আওয়াল জানান, ভোট গণনার সময় দুই প্রার্থীর সমর্থকরা সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন। পুলিশ ও বিজিবির সদস্যরা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নামেন। সংঘর্ষে নায়েক রুবেল নিহত হন।
তিনি বলেন, গারাগ্রামে লাঙ্গল প্রতীকে চেয়ারম্যান পদের প্রার্থী ছিলেন জাতীয় পার্টির মারুফ হাসান অন্তিক। এই কেন্দ্রেই আনারস প্রতীক নিয়ে লড়ছিলেন জনাব আলী। ইউনিয়নের পশ্চিম দলিরাম মাঝাপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে বিকেলে যখন ভোট গণনা শুরু হয়, তখন জানা যায়, জনাব আলী ৫৪ ভোটে এগিয়ে আছেন।

 

তখনই অন্তিকের সমর্থকরা জনাব আলীর সমর্থকদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ান। এ সময় একদল লোক প্রিজাইডিং ও পোলিং অফিসার এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের অবরুদ্ধ করে দেশীয় অস্ত্র নিয়ে কেন্দ্রে হামলা চালান। রাত ৯টা পর্যন্ত দফায় দফায় এ হামলায় মো. রুবেল নামে বিজিবি সদস্য ঘটনাস্থলে নিহত হন।
পীরগঞ্জ (ঠাকুরগাঁও) প্রতিনিধি জানান,
ঠাকুরগাঁওয়ের পীরগঞ্জ উপজেলায় ইউপি নির্বাচনের ফল ঘোষণার সময় ভোটকেন্দ্রে হামলা, ভাঙচুর ও সংঘর্ষের মধ্যে বিজিবির গুলিতে তিনজন নিহত হয়েছেন। এসময় আহত হয়েছেন আরও চারজন। রোববার রাত সাড়ে ৮টার দিকে পীরগঞ্জ উপজেলার খনগাঁও ইউনিয়নের ঘিডোব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে এ ঘটনা ঘটে।
নিহতরা হলেন- ঘিডোবপুর গ্রামের সাহাবলি আহম্মেদ (৩৫), মোজাহারুল ইসলাম (৪০) ও অবিনাশ চন্দ্রের ছেলে আদিত্য (২০)। এদের মধ্যে ঘটনাস্থলেই দুজন এবং রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথে একজনের মৃত্যু হয়।

 

স্থানীয়রা জানান, রাত ৮টার দিকে ভোটের ফল গণনার সময় বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী নুরুজ্জামান ও তার সমর্থকরা প্রিজাইডিং অফিসারসহ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের ঘিরে ফেলেন। এ সময় পীরগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার ঘটনাস্থলে এলে তার গাড়ি ভাঙচুর করেন তারা। প্রায় দেড়ঘণ্টা অবরুদ্ধ থাকার পর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে বিজিবিসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা ঘটনাস্থলে আসলে তাদের ওপর আক্রমণের চেষ্টা চালানো হয়। এ সময় আইনশৃঙ্খলার বাহিনীর সদস্যরা গুলি ছুড়লে ঘটনাস্থলে হতাহতের ঘটনা ঘটে।
ওদিকে লক্ষ্মীপুর সংবাদদাতা জানান, লক্ষ্মীপুরে রামগঞ্জ উপজেলার ইছাপুর ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে দুই চেয়ারম্যান প্রার্থীর সমর্থকদের সংঘর্ষে ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সভাপতি সজিব হোসেন নিহত হয়েছেন। গতকাল নির্বাচন চলাকালীন সময়ে বিকাল পৌনে ৪টার দিকে ওই ইউনিয়নের নয়নপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভোটকেন্দ্রের সামনে এ ঘটনা ঘটে। আওয়ামী লীগের চেয়ারম্যান প্রার্থী শাহেনাজ আক্তার ও বিদ্রোহী চেয়ারম্যান প্রার্থী আমির হোসেন খানের সমর্থকদের মধ্যে এ ঘটনা ঘটে। নিহত ছাত্রলীগ নেতা সজিব হোসেন আওয়ামী লীগের চেয়ারম্যান প্রার্থী শাহেনাজ আক্তারের সমর্থক ছিলেন।
স্টাফ রিপোর্টার, খুলনা থেকে জানান, নির্বাচনী সহিংসতায় খুলনার তেরখাদা উপজেলার মধুপুর ইউনিয়নে বাবুল শিকদার (৩৮) নামের এক ব্যক্তি নিহত হয়েছেন। তিনি আওয়ামী লীগ সমর্থিত চেয়ারম্যান প্রার্থী মো. মহসিনের সমর্থক ছিলেন। পুলিশ ও স্থানীয়রা জানান, নির্বাচনী বিরোধকে কেন্দ্র করে গত শনিবার দিবাগত রাত ১২টা ১৫ মিনিটের দিকে তেরখাদা উপজেলাধীন মধুপুর ইউনিয়নের কুলাপাটগাতি গ্রামের বাবুল শিকদারকে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী চেয়ারম্যান প্রার্থী কামাল হোসেনের লোকজন হাতুড়িসহ ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে গুরুতর জখম করে পালিয়ে যায়। পরে এলাকাবাসী মাথায় গুরুতর আঘাতপ্রাপ্ত বাবুল শিকদারকে মুমূর্ষু অবস্থায় উদ্ধার করে খুলনা মেডিকেল কলেজ (খুমেক) হাসপাতালে পাঠান। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গতকাল ভোর ৬টা ১৫ মিনিটে বাবুল শিকদার মৃত্যুবরণ করেন।
স্টাফ রিপোর্টার, যশোর থেকে জানান, ইউপি নির্বাচনে পোস্টার লাগানোকে কেন্দ্র করে যশোরের শার্শায় দুই মেম্বার প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে আনারস প্রতীকের সমর্থক কুতুব উদ্দীন (৩৫) নিহত হয়েছেন। গত শনিবার রাত ৯টার দিকে যশোর জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি।