আউলিয়াকুলের শিরোমণি গাউসুল আজম বড়পীর আবদুল কাদের জিলানী (রহ.)

যাবতীয় প্রশংসা কেবলই আল্লাহ তাআলার যিনি সমগ্র জগতের মালিক ও রব। আর সালাত ও সালাম নাযিল হোক আমাদের নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর,যিনি সমস্ত নবীগণের সরদার ও সর্বোচ্চ সম্মানের অধিকারী। আরও সালাম নাযিল হোক তার পরিবারপরিজন ও সমগ্র সাথীসঙ্গীদের ওপর।

মাওলা আলী শেরে খোদা কাররামুল্লাহি ওয়াজহাহুল করিম হতে বর্ণিত,দয়াল নবীজি (সাঃকোন এক সময় মহান আল্লাহপাকের দরবারে হাত উঠিয়ে আরজ করলেনগো দয়াময়। তুমি আমার সেই প্রতিনিধির ওপর রহমত ও করুণা বর্ষন করযে আমার পরে পৃথিবীতে আগমন  করবে এবং আমার হাদিস যথাযথ ও সঠিকভাবে বর্ণনা করবে। আমার মৃতপ্রায় দ্বীন ইসলামকে নবজীবন দান করবে।

দয়াল নবিজীর ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী তারই প্রতিনিধিরূপে পৃথিবীতে ৪৭১ হিজরির ১ রমজানের সোমবার সুবহে সাদিকে তাশরিফ আনেন খান্দানে নবুওয়াত তথা আহলে বাইতের সদস্য,মাওলা আলীর বেলায়েতী ক্ষমতার প্রতিভূআউলিয়াকুলের শিরোমণিগাউসুস সাক্‌লাইনহযরতে পীরানে পীর দস্তগীর শায়েখ মহিউদ্দিন আবদুল কাদের জিলানী (রহ.)। আমাদের মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর ওফাতের প্রায় ৫০০ বছর পর হজরত আবদুল কাদের জিলানি (রহ.) জন্মগ্রহণ করেন। তখন ইসলাম ধর্ম এক নাজুক অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছিল। পবিত্র কোরআন ও আল্লাহর রাসুল মুহাম্মদ (সা.)-এর আদর্শ ভুলে মানুষ বিপথে পা বাড়িয়েছিলঠিক এমনি সময় হজরত বড়পীর সাহেব ইসলামের পথে মানুষকে ডাক দিয়েছিলেন।

জন্ম ও বংশ পরিচয়: ১ রমজান ৪৭১ হিজরীতে ইরানের অন্তর্গত জিলান জেলার কাসপিয়ান সমুদ্র উপকূলের নাইদ নামক স্থানে বড় পীর হযরত আবদুল কাদের জিলানী (রহ.) জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম হযরত আবু সালেহ মুছা জঙ্গি (রহ.) ও মাতার নাম সৈয়দা উম্মুল খায়ের ফাতিমা (রহ.)। পিতার দিক দিয়ে তিনি ছিলেন হজরত ইমাম হাসান (রা.) এর বংশধর আর মায়ের দিক থেকে ছিলেন হজরত ইমাম হুসাইন (রা.) এর বংশধর। হাসানি ও হুসাইনি দুই পবিত্র রক্তধারার সম্মিলন ঘটেছিল তাঁর মধ্যে। গাউসূল আজম বড় পীর হিসেবে তিনি সকলের নিকট পরিচিত।

বাল্যশিক্ষা:  হযরত আবদুল কাদের জিলানী (রহঃ)-এর বাল্য শিক্ষা মক্তবে শুরু হয়। প্রথম দিন মক্তবে গিয়ে দেখেন অন্যান্য ছাত্রদের ভিড়ে বসার কোনো জায়গা নেই। হঠাৎ করে উপর হতে গায়বী আওয়াজ আসল,হে মক্তবের ছাত্ররাআল্লাহর অলির বসার স্থান প্রসস্ত করে দাও। গায়বী আওয়াজ আসার সাথে সাথে সকল ছাত্ররা চেপে বসলেন। হযরত আবদুল কাদের জিলানী (রহ.) এর বসার ব্যবস্থা হয়ে গেল। প্রথম দিনেই অবাক কান্ড! মক্তবের শিক্ষক হযরত আবদুল কাদের জিলানী (রহ.) কে আউযু বিল্লাহ ও বিসমিল্লাহ সবক দানের সাথে সাথে হযরত বড় পীর কোরআন মজিদের প্রথম ১৮ পাড়া পর্যন্ত মুখস্ত বলে ফেললেন। মক্তবের শিক্ষক জিজ্ঞাসা করলেনহে বৎসতুমি কিভাবে কোরআন মুখস্ত করেছোআজ মক্তবে তোমার প্রথম দিন। হযরত আবদুল কাদের জিলানী (রহ). বলেনআমার মাতা ১৮ পাড়ার পর্যন্ত কোরআন মুখস্ত করেছিলেন। আমি গর্ভে থাকাকালীন সময় তিনি কোরআন পাঠ করতেন। আমি মায়ের তেলাওয়াত শুনে শুনে ১৮ পাড়া পর্যন্ত মায়ের গর্ভে থাকাকালীন সময়ে মুখস্ত করে ফেলেছি।

ভূমিষ্ঠ হয়ে শরীয়ত পালন: ২৯ শাবান। আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকায় জিলানবাসীদের কেউ রমজানের চাঁদ দেখতে পায়নি। সকলে রোজা রাখা না রাখার বিষয় নিয়ে সংশয়ের মধ্যে পড়ে গেলেন। এমতবস্থায় রাতের শেষাংশে সুবহে সাদেকের পূর্বে তথা ১ রমজান ধরাধামে আসেন হযরত আবদুল কাদের জিলানী (রহ.) । শিশু আবদুল কাদের জিলানী (রহ.) জন্মের পর সুবহে সাদিকের পূর্বে পর্যন্ত দুধ ও মধু পান করেন। কিন্তু সুবহে সাদিকের পর তাকে আর কিছু খাওয়ানো যায়নি। এ আশ্চার্যজনক খবর ছড়িয়ে পড়লে সকলে বুঝতে পারল মাহে রমজান শুরু হয়েছে।

গায়বী জ্ঞান ও ওয়াজ নসিহত: ৫২১ হিজরীর ১৬ শাওয়াল রোজ মঙ্গলবার রাসূল (সা.) স্বপ্নযোগে বলেনহে আবদুল কাদিরতুমি মানুষকে কেন আল্লাহর পথে আহ্বান করছো না। মানুষকে কেন বঞ্চিত করছো। আবদুল কাদের (রহ.) বলেনআমি রাসূল (সা.) ও আলী (রা.)-এর আওলাদ। আমি তো আরবী জানিনা। যদি ইরাকের লোকজন তিরস্কার করেন। তাৎক্ষণিক রাসূল (সা.) বলেনআবদুল কাদের তুমি মুখ খোল। রাসূল (সা.) কিছু একটা পড়ে ৬ বার মুখের মধ্যে ফুক দিলেন এবং রাসূল (সা.)-এর মুখের লালা আবদুল কাদের জিলানীর মুখে লাগিয়ে দিলেন। অতপর বললেনমানুষকে হিকমত এবং উত্তম উপদেশের মাধ্যমে তোমার প্রভুর পথে পরিচালিত করো। (সূরা নাহলআয়াত১২৫। এর পর থেকে হযরত আবদুল কাদের জিলানী (রহ.)-এর মাহফিলে এমন তাসির হতো যেপ্রত্যেক মাহফিলে ২/৩ জন লোক প্রভুর প্রেমে এশকে ফানা হয়ে মারা যেতো।

হিজরত ও সত্যবাদিতা: তৎসময় কালে ইরাকে ভালো পড়াশুনা ও ব্যবসার সুযোগ ছিল। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে পড়াশুনা ও ব্যবসার জন্য মানুষ বাগদাদ আসত। পড়াশুনার উদ্দেশ্যে হযরত আবদুল কাদের জিলানী (রহ.) ব্যবসায়িক কাফেলার সাথে বাগদাদ যাওয়ার পথে ডাকাতের কবলে পড়েন। হযরত আবদুল কাদের জিলানী (রহঃকে ডাকাত সর্দার জিজ্ঞাসা করলেনতোমার সাথে কি আছেতিনি বললেনআমার নিকট ৪০টি স্বর্ণ মুদ্রা আছে। ডাকাত সর্দার আশ্চার্যন্বিত হয়ে পুনরায় নী (রহ.) বললেনমিথ্যা কথা বলতে আমার মা নিষেধ করেছেন। এ কথা শুনে ডাকাত সর্দার বললেনমায়ের আদেশ যুবক তুমি এভাবে পালন কর। নিশ্চয়ই তুমি আল্লাহর আদেশ আরো যত্নের সাথে পালন করো। আর আমি ও অন্যান্য ডাকাতরা তো আল্লাহর আদেশই পালন করি না। মায়ের কথা তো অনেক দূরের কথা। এই বলে ডাকাত সর্দার আপসোস করতে থাকেন ও বলেনহে বালক ! তুমি সাধারণ কোন মানুষ না। হে বালক তুমি আমাকে কলেমা পড়াও। ডাকাত সর্দারের সাথে আরো ৬০ জন অশ্বারোহী ডাকাত ছিলেন। তারাও কলেমা পড়ে মুসলমান হয়ে গেলেন।

স্বভাবচরিত্র : তিনি ছিলেন রাসুলে করিম (সা.) এর পূর্ণ অনুসারী। মানুষে মানুষে তিনি কোনো পার্থক্য করতেন না। বাদশাহফকিরকে দেখতেন একই নজরে। এমনকি গরিবকে দিতেন তিনি প্রাধান্য। আমির লোকদের হাদিয়া তিনি গ্রহণ করতেন না। তবে গরিবের হাদিয়া গ্রহণ করতেন সন্তুষ্ট চিত্তে। জীবনে শাহিদরবারে কখনো গমন করেননি।তাঁর দরবারে যত হাদিয়া উপস্থিত,হতো তিনি দরিদ্র ও অভাবগ্রস্ত লোকদের মধ্যে তা বিলিয়ে দিতেন। মানুষের দুঃখ সহ্য করতে পারতেন না। তা দূর করার জন্য ব্যাকুল ছিলেন। তিনি বন্ধুবৎসল,বিনয়ী,মিষ্টভাষী ও অমায়িক ব্যক্তিত্বসম্পন্ন। অপরের সালামের অপেক্ষা তিনি করতেন না। আগেই সালাম দিতেন,মুসাফাহার জন্য আগেই হাত বাড়িয়ে দিতেন।

ইবাদতের কঠোর সাধনা :  তিনি একাধারে ৪০ বছর পর্যন্ত ইশার নামাজের অযু দিয়ে ফজরের নামাজ আদায় করেছেন। প্রত্যহ শেষ রাত্রে পাঠ করতেনআল মুহিতুল আলমেআর রাব্বুশ শহীদআল হাসীবুল ফায়্যায়িল খাল্লাকিআল খালিকুআল বারিউআল মুসাব্বিরু। উক্ত দোয়া পাঠ করার সাথে সাথে লোক চক্ষুর সামন থেকে অদৃশ্য হয়ে যেতেন। তিনি রাতের একটা সময় জিকির ও মোরাকাবা করে কাটাতেন। যৌবনের অধিকাংশ সময় রোজা রেখে কাটিয়েছেন। যখন নফল নামাজ আদায় করতেন সুরা ফাতেহার পর সূরা আর রহমানসূরা মুজাম্মিল কিম্বা সুরা ইখলাস পড়তেন। তন্দ্রার ভাব আসলে দেখে দেখে কোরআন তেলাওয়াত করতেন।

কাদেরীয়া তরিকার প্রবর্তক: হযরত আবদুল কাদের জিলানী (রহঃবিশ্বব্যাপী ইসলাম প্রচার ও প্রসারে অবিস্মরণীয় ভূমিকা পালন করেছেন। মুসলামানকে ভ্রান্তির বেড়াজাল থেকে মুক্ত করার লক্ষ্যে কোরআন সুন্নাহ ভিত্তিক মানুষকে ইসলামের দাওয়াত দিতে থাকেন। মানুষকে আল্লাহ ও রাসূল (সা.) মুখী করার জন্য বিভিন্ন আমল বাতলিয়ে দিতেন। হযরত আবদুল কাদের জিলানী (রহ.) যখন দুনিয়ার জীবন ত্যাগ করে পরপারে যান। তখন হযরত আবদুল কাদের জিলানী (রহ.) এর ভক্ত অনুসারীরা তাঁর আমল ও চরিত্রকে সমুন্নত রাখার লক্ষ্যে কাদেরীয়া তরিকা প্রবর্তন করেন। সে সময়কাল থেকে কাদেরীয়া তরিকার প্রচলন আমাদের দেশেও প্রচলিত হয়েছে।

বেলায়েতের সম্রাট: বেলায়াতের উচ্চস্তরের গাউসূল আজম সারা জাহানে প্রত্যেক জামানায় ৩১৩ জন অলি জমিনে বিদ্যমান থেকে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সা.) এর শান মান প্রচার ও প্রতিষ্ঠার কাজে নিয়োজিত থাকেন। সূফীতাত্ত্বিক পরিভাষায় তাঁদের আখইয়ার বলা হয়। ৩১৩ জন অলির মধ্যে ৪০ জন আবদাল৭ জনকে আবরার৫ জনকে আওতাদ৩ জন নকীব৪ জন নুজবা ও ১ জন গাউসূল আজম থাকেন। যাকে কুতুবুল আউলিয়া বা সুলতানুল আউলিয়া বলা হয়। বাকিরা অন্যান্য সাধারণ পর্যায়ের অলি। তৎজমানায় গাউসগণের মধ্যে যিনি সর্বোচ্চ মর্যাদায় অভিষিক্তবেলায়েতে ওজমা ও গাউসিয়তে কোবরার সুমহান আসনে অধিষ্ঠিত ছিলেন তিনি হচ্ছেন হযরত আবদুল কাদের জিলানী (রহ.)

উপাধিসমূহ : হযরত আবদুল কাদের জিলানী (রহ.)-এর বেলায়েতের পরিচিতি বিশ্বব্যাপী ছিল। তিনি বিভিন্ন দেশে মানুষের নিকট ভিন্ন উপাধিতে ভূষিত হয়েছেন। তাঁর উপাধিগুলো হলো যথাক্রমে– গাউসূল আজমবড় পীরমাহবুবে সোবহানীমহিউস সুন্নাহকুতুবে রাব্বানীইমামুল আউলিয়াসৈয়দপীরমীরমহিউদ্দিনকামিউল বিদায়াতনূরে হক্কানীপীরানে পীরজিলানী ইত্যাদি।

শায়খের ইন্তেকাল: স্রষ্টার চূড়ান্ত দীদার লাভের উদ্দেশ্যে ১১ রবিউস সানী ৫৬১ হিজরী রোজ সোমবার ইহজগত ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৯১ বছর। বর্তমানে ইরাকের বাগদাদ শহরে তাঁর মাজার শরীফ রয়েছে। ১১ রবিউস সানি বিশ্বব্যাপী পালিত হয় ফাতেহাইয়াজদহম। ইসলামের খিদমতের জন্য তিনি যেসব কাজ করেছেন,সারা দুনিয়ার মুসলমানদের জন্য অনাগতকাল ধরে প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে। তাঁর ইন্তেকালের দিনকেই ফাতেহাইয়াজদহম বলা হয়। এছাড়া প্রত্যেক চন্দ্র মাসের ১১ তারিখ কাদেরীয়া তরিকার অনুসারীরা হযরত আবদুল কাদের জিলানী (রহঃএর ওফাতের তারিখে গেয়ারভী শরীফ পালন করেন।

শেষ কথা : হযরত আবদুল কাদের জিলানী (রহঃ)-এর আদর্শিক জীবনধারা থেকে শিক্ষা নেয়ার মতো অনেক কিছু রয়েছে। বড় পীরের আদর্শিক জীবনের সামান্য অংশ যদি আমরা পালন করতে সক্ষম হই। তাহলে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সা.) এর সন্তোষ্টি অর্জন সম্ভব। আল্লাহ আমাদের ব্যক্তিগত জীবনে মহান অলি হযরত আবদুল কাদের জিলানী (রহ.)-এর আদর্শ বাস্তবায়ন করার তৌফিক দান করুন। আল্লাহতায়ালা তাকে জান্নাতের উচুঁ মাকাম দান করুন। আমীন।

লেখক:

ফখরুল ইসলাম নোমানী

হেড অব ফাইন্যান্স এন্ড একাউন্টস

এপিক হেলথ কেয়ার লিমিটেড