ভাড়া নিয়ে বাকবিতণ্ডা চলছেই

গুগল ম্যাপের তথ্যানুযায়ী ফার্মগেট থেকে শ্যামলীর দূরত্ব চার কিলোমিটার। বর্ধিত ভাড়া অনুযায়ী ভাড়া হয় ৮ টাকা ৬০ পয়সা। মহানগরে বাসের পূর্বের ভাড়া ছিল কিলোমিটারপ্রতি ১ টাকা ৭০ পয়সা। যা বাড়িয়ে করা হয়েছে ২ টাকা ১৫ পয়সা। আগের ভাড়া অনুযায়ী তা হয় ৬ টাকা ৮০ পয়সা। এই যাত্রায় ভাড়া রাখা হতো আগে ১৫ টাকা। এখন নেয়া হচ্ছে ২০ টাকা। বাড়তি রাখা হচ্ছে ১১ টাকা ৪০ পয়সা।

এমএম লাভলী পরিবহন। বাসে বড় করে সাঁটানো ‘ডিজেল চালিত’ স্টিকার। গতকাল বুধবার সকাল সাড়ে ৭টা। সকালে সড়কে ভিড় না থাকলেও বাসে লোকজন দাঁড়িয়ে। আর যাত্রীদের সঙ্গে চলছে ভাড়া নিয়ে বাকবিতণ্ডা।

‘এটা ডিজেলের গাড়ি? ভাড়া বেশি রাখবি কিল্লাইগ্যা? ওই ব্যাটা তুই গাড়ি চিনোস? কোনটা গ্যাসের কোনটা ডিজেলের জানোস?’ এভাবেই কথার জালে জড়িয়ে যান যাত্রী ও সুপার ভাইজার। নতুন তালিকা অনুযায়ী এমএম লাভলী ডিজেলে চললেও বর্ধিত ভাড়া যে দ্বিগুণ আদায় করা হচ্ছে এ নিয়ে কথা বলাও যেন মানা। যারাই প্রশ্ন তুলছেন তাদের বলছেন, আমাদের ভাড়া চেকার দেখে। এক চেক থেকে আরেক চেক ২০ টাকা। আগে ছিল ১৫ টাকা। অর্থাৎ তারা স্পষ্টত সরকারের বেঁধে দেয়া দূরত্বের নিয়ম মানছে না। নিজেদের করা নিয়মেই চলছে। নিজেদের মতো করেই ভাড়া বাড়িয়েছে তারা।

 

সকাল সাড়ে সাতটা। শ্যামলী থেকে গুলশান-১ এর উদ্দেশ্যে যাত্রা। বাসের নাম রইস পরিবহন। এখানেও একই চিত্র। পূর্বের ভাড়া ২০ টাকা হলেও এখন রাখা হচ্ছে ৩০ টাকা। পূর্বের বাসের মতো রুক্ষ্ম মেজাজের না হলেও এ বাসে সুপারভাইজার যাত্রীদের কথার জবাব দিচ্ছেন হাসি মুখে। কথার সুর নরম হলেও টাকা নিতে ইনিয়ে-বিনিয়ে ৩০ টাকা করেই রাখছেন। সুপারভাইজার বলেন, ‘ভাই আমরা কম রাকমু কেমনে? হ্যারা ভাড়া ঠিক করে দিছে আমরা রাখি।’

 

মঙ্গলবার বৈশাখী পরিবহন বাসে শ্যামলী-গুলশান ১ যাত্রাতেও মেলে একই চিত্র। বাড়তি ভাড়ার পরও অতিরিক্ত ভাড়া রাখায় দেখা দেয় ভিন্ন এক পরিবেশ। আগারগাঁওয়ে যাত্রী পূর্ণ থাকার পরও যাত্রী উঠানোয় প্রতিবাদ জানান যাত্রীরা। আবার শ্যামলী থেকে আগারগাঁওয়ের দূরত্ব ২ কিলোমিটার। ভাড়া হওয়ার কথা সর্বনিম্ন ১০ টাকা। কিন্তু ভাড়া রাখা হচ্ছে ১৫ টাকা। মিরপুর কলেজের এক শিক্ষার্থী অর্ধেক ভাড়া দিতে চাইলে রাখেননি বাস চালকের সহকারী। আবার ভাড়ার হিসাব দেখিয়ে ১০ টাকা দিতে চাইলেও নেয়া হয়নি তা। রীতিমতো কথার লড়াই চালানোর পরও ১৫ টাকা দিতে বাধ্য হন তিনি।

 

বৈশাখী পরিবহনে ভাড়া নিয়ে বিতণ্ডার এক পর্যায়ে সুপারভাইজার বলে বসেন, ‘নিয়ম মাইন্যা উঠলে উঠবেন, নইলে দরকার নাই এমন যাত্রী। আমার যাত্রীর অভাব হইব না।’

ভাড়া নিয়ে অভিযোগ সর্বত্র। মিরপুর ১ নম্বর থেকে গুলিস্তানে অফিস করেন আফসার আহমেদ। তিনি ভাড়া বৃদ্ধির হার নিয়ে লেখেন, আগে মিরপুর ১ থেকে গুলিস্তানের ভাড়া দিতাম ২৫ টাকা। এখন দেই ৩৫ টাকা। কোন হিসাবে ১০ টাকা বাড়লো? যাচ্ছেতাইভাবে ভাড়া আদায় করা হয়। আমরা কতটা অসহায় বাসে উঠলেই বোঝা যায়। তার কাছে জানতে চাইলে বলেন, প্রথম দিন ১০ টাকা বেশি না দিয়ে ৫ টাকা বেশি দিতে চেয়েছিলাম। রীতিমতো আমাকে বাস থেকে নামিয়ে দেয়ার হুমকি দেয়। তাই বর্ধিত ভাড়ার পরও এই ডাকাতি মুখ বুঝে মেনে নিচ্ছি।

 

স্বল্প দূরত্বের যাত্রীদের অভিযোগটা সব থেকে বেশি। তাদের অভিযোগ আগে ভাড়া রাখা হতো ১০ ও ১৫ টাকা। যা এখন রাখছে ১৫ ও ২০ টাকা। এর কারণ হিসেবে তারা খুচরা টাকার সংকটকে দায়ী করছেন। আর যাত্রীদের অধিক ভাড়ার বিষয়ে ক্ষোভের জবাবে বলছেন, মালিক তাদের যেভাবে চলতে আদেশ দিয়েছেন সেভাবেই চলছেন তারা।

গতকাল সন্ধ্যায় কাওরান বাজার এলাকায় যানজটে আটকে থাকা আয়াত পরিবহনের সুপারভাইজার মো. ইব্রাহিম জানান, ভাড়া তো আর আমরা ঠিক করি না। আমাদের মালিকরা যেভাবে নির্দেশনা দিয়েছেন সেভাবে ভাড়া নিই। বাসে খুচরা টাকার সংকটের কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘বাসে যদি ২ টাকা ১ টাকার হিসাবে যাওন লাগে তাইলে মুশকিল। ৫ টাকাই পাই না যাত্রীগো দেওনের লাইগা। এহন কিলোমিটারের হিসাব না কইরা এলাকাপ্রতি ভাগ করলে ভাড়া নিয়া ঝামেলা মিটব।’

 

বাসের যাত্রীদের ক্ষোভ শুধু নয়। ক্ষোভ আছে লেগুনার যাত্রীদেরও। খামারবাড়ি মোড় থেকে মিরপুর ২ পর্যন্ত ভাড়া ছিল ২০ টাকা। যা বাড়িয়ে করা হয়েছে ৩০ টাকা। ফার্মগেট থেকে মোহাম্মপুরের ভাড়া ১০ টাকা থেকে করা হয়েছে ১৫ টাকা। তারাও ভাড়া বাড়িয়েছেন নিজেদের মতো করে। আবার নতুন ভাড়ার তালিকাও লাগিয়েছেন লেগুনায়। তবে পূর্বে লেগুনায় ১২ জন যাত্রী নেয়া হলেও এখন নেয়া হয় ১০ জন করে।

ফার্মগেট থেকে মিরপুর-২ যাওয়ার সময় লেগুনাতেও দেখা যায় একই ধরনের চিত্র। সেখানেও চলে ভাড়া নিয়ে কথা কাটাকাটি। এক যাত্রী বলেন, তোমার গাড়ি চলে গ্যাসে। তুমি কেন ভাড়া বাড়াবা? চালক উত্তর দেন, গ্যাসে চললেও কি হবে। ডিজেলের দাম বাড়ানোর পর জমা বাড়ছে ১০০ টাকা। আর মালিকরাই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ভাড়া বাড়ানোর। এই যে চার্টও প্রকাশ করেছেন।

 

মঙ্গলবার ও বুধবার রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, ভাড়া নিয়ে অসন্তুষ্ট ও ক্ষুব্ধ যাত্রীরা। হরহামেশাই যাত্রীদের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছেন বাকবিতণ্ডায়। অসহায় যাত্রীরা গুনতে বাধ্য হচ্ছেন বর্ধিত ও চাপিয়ে দেয়া ভাড়া। সুপারভাইজাররাও বিরক্ত ভাড়া তুলতে গিয়ে। খামাড়বাড়ী এলাকায় একজন চেকারের কাছে জানতে চাইলে বলেন, ‘আমাদের কোনো নির্দেশনা নেই। আগেও আমরা যাত্রী গুনে খাতায় লিখে দিতাম এখনো তাই করি। ভাড়া উঠানের কাম হেগো।’